মুষাহার

মুষাহার  বাংলাদেশের অন্যতম আদিবাসী জনগোষ্ঠী। প্রায় দেড়শো বছর আগে মুষাহারেরা ভারতের বিহার রাজ্যের ছোট নাগপুর অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার তেলিয়াপাড়া, রেমা প্রভৃতি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে এবং চা শ্রমিকের জীবন বেছে নেয়। বাংলাদেশে বসবাসকারী মুষাহারের সংখ্যা আনুমানিক তিন হাজার।

মুষাহাররা দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এদেশীয় মুষাহারদের প্রধান ভাষা বাংলা। বাংলা ছাড়াও তারা হিন্দিভাষা ব্যবহার করে থাকে। মুষাহারদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই কম, শতকরা মাত্র ৮ জন। চা বাগানের বাইরে অন্য কোনো পেশায়ও তাদের দেখা যায় না।

মুষাহার সমাজ ছয়টি উপগোত্রে বিভক্ত। এগুলি হলো: রিখিয়ান, মাঘাইয়া, ত্রিহুতিয়া, খাইরাওয়ার, দরওয়ার এবং ঘাটোয়ার। এই উপগোত্রগুলি আবার কয়েকটি বংশে বিভক্ত। একই বংশের মধ্যে বিবাহ মুষাহার সমাজে নিষিদ্ধ। বংশকে তারা কুরিয়া বলে। পিতার মৃত্যুর পর পরিবারের পুত্রসন্তানগণ সম্পত্তির মালিক হয়। পিতার অবর্তমানে জ্যেষ্ঠপুত্র পরিবারের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন। মুষাহার সমাজে যৌথ পরিবার দেখা যায়।

বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিরসনে মুষাহাররা সাধারণত আইন-আদালত কিংবা পুলিশ প্রশাসনের দ্বারস্থ না হয়ে নিজেরাই ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। কেউ অনৈতিক কাজ করলে সমাজের প্রধান ব্যক্তিরা তাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন। শাস্তি হিসেবে এমনকি সমাজ থেকে বহিস্কার করাও হয়।

বিভিন্ন উপলক্ষে তারা শুকরের মাংস সহযোগে ভোজের আয়োজন করে। গোমাংস তারা আহার করে না। মাঘ মাসে মুলা আহারে তারা বিরত থাকে। পৌষ মাসের শেষ দিনে তারা পিঠা উৎসব পালন করে। এ উৎসবকে বলা হয় আলন্তি।

মুষাহারেরা সনাতন হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী। তারা হোলি উৎসব, দেওয়ালী উৎসব, রামনবমী ও শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী পালন করে। দেবদেবীর মধ্যে শীতলাদেবী তাদের প্রধান উপাস্য দেবী। সত্যনারায়ণ পূজা তারা নিয়মিত করে থাকে এবং সত্যনারায়ণের কথাপাঠ গুরুত্বসহকারে শ্রবণ করে। দুর্গাপূজা এবং কালী বা শ্যামাপূজায়ও তারা অংশগ্রহণ করে। পাপপুণ্য সম্পর্কে তাদের স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে এবং কর্মফল অনুযায়ী পুনর্জন্মে তারা বিশ্বাসী। হিন্দুদের মতই তারা তীর্থযাত্রায় বিশ্বাসী এবং তারা গয়া, কাশী, কালীঘাট প্রভৃতি তীর্থক্ষেত্রে গমন করে থাকে। মুষাহারেরা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী কোনো দেবদেবীর আরাধনা কিংবা আচারঅনুষ্ঠানাদি পালন করে না।

মুষাহারদের সামাজিক অনুষ্ঠানাদির মধ্যে বিবাহ উৎসব সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সাধারণত পিতা-মাতা অথবা অভিভাবকেরাই বিবাহের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে থাকেন। বিবাহের ৫ দিন আগে লগন অনুষ্ঠিত হয়। এইদিন বর ও কনে উভয়কে স্ব স্ব গৃহে গায়ে হলুদ দেওয়া হয়, তেল মাখানো হয় এবং কপালে শ্বেতচন্দনের তিলক পরানো হয়। পুরোহিত কনের পিতৃগৃহের প্রাঙ্গণে একটি স্থান বেছে নিয়ে স্থানটি শুদ্ধ করেন এবং সেখানে বিবাহ মঞ্চ তৈরি করেন। বিবাহ মঞ্চকে মারাহু বলা হয়।

বিবাহের একদিন আগে বর-কনের পিতৃমাতৃগৃহে কহার ভাত অনুষ্ঠান উদ্যাপিত হয়। এই অনুষ্ঠানে বর ও কনে উভয়ের বাড়িতে পাঁচজন করে অবিবাহিতা মেয়ে গৃহপ্রাঙ্গণে ভাত ও নিরামিষ তরকারি রান্না করে এবং যার যার গৃহে বর ও কনেকে নিয়ে একত্রে আহার করে। লগন এবং কহার ভাত অনুষ্ঠানের মাঝে কনের আত্মীয়স্বজনেরা বরের বাড়িতে আগমন করে সত্যনারায়ণ কথা অনুষ্ঠান পালন করে।

বিবাহের দিন বরযাত্রীরা কনের বাড়িতে উপস্থিত হলে তাদের মুখোমুখি হতে হয় দুয়ারচেকাইয়ের। আনুষ্ঠানিকভাবে সাজানো প্রবেশপথ আটকে দাঁড়ানো ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বখশিস দেওয়ার পরই কেবল তারা ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পায়। গৃহপ্রাঙ্গনে প্রবেশ করে বরকে দুয়ারপুজা সেরে নিতে হয়।

বিবাহের আনুষ্ঠানিকতাকে মুষাহাররা বলে পর্চাবন। মারাহু অর্থাৎ বিবাহ মঞ্চে সত্যনারায়ণ কথাপাঠের মাধ্যমে বিবাহ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। সত্যনারায়ণ কথা পাঠ সমাপ্ত হলে শুরু হয় ঘটবন্ধন, কন্যাদান, ভানুয়ার এবং সিঁদুরদান অনুষ্ঠান। পরে নবদম্পতিকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তারা উভয়ে দেওকুর অর্থাৎ গৃহদেবতার আসনের সম্মুখে প্রণত হয়। এরপর বরযাত্রীদের জন্য এক ভোজের আয়োজন করা হয়। কন্যাপক্ষের মহিলারা বরযাত্রীদের উদ্দেশ্যে হাস্যরসাত্মক গান পরিবেশন করে। আহার শেষে বরপক্ষ গায়িকাদলকে বখ্শিস প্রদান করে। এই গীত পরিবেশনাকে বলা হয় গারি গাওয়াই।

পরদিন সকালে বরযাত্রীদের জন্য আবার ভোজের আয়োজন করা হয়। এ পর্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য মানানা বা মানভঞ্জন, যেখানে বরকে নানা উপঢৌকন দিয়ে আহারে রাজি করানো হয়। বরের পিতাও এ সময় কনের পিতার নিকট থেকে তেল, ধূতি এবং জামা ইত্যাদি অন্যান্য উপঢৌকন গ্রহণ করেন। এটি মুষাহারদের নিকট তেলাবান নামে পরিচিত। বরযাত্রীদের বিদায় নেওয়ার প্রাক্কালে বর ও কনের পিতা কোলাকুলি করেন এবং কোলাকুলি শেষে দুজনে মিলে বিবাহ মঞ্চটি নাড়া দেন। এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় মারাহুয়া হিলানা। বাড়ি পৌঁছার পর বরের মা নববধূকে অভ্যর্থনা জানান। সে সময় নববধূ ঘরের দরজার সামনে প্রণিপাত হয়ে কপাল চৌকাঠে ঠেকিয়ে ঘরের দরজা অতিক্রম করে। একে বলা হয় দুয়ার-লঙ্গাই অনুষ্ঠান। এরপর আত্মীয় এবং পাড়াপ্রতিবেশী মহিলারা উপহারসামগ্রী নববধূর হাতে তুলে দিয়ে তার মুখদর্শন করেন। এই অনুষ্ঠানকে মুষাহারেরা মূহ্-দেখাই বলে। বরের পিতা ঐদিন এক ভোজের আয়োজন করেন।

মুষাহাররা মৃতদেহ দাহ করে। শ্মশানে মৃতদেহটি স্নান করানো হয় এবং মৃতব্যক্তির আত্মার উদ্দেশ্যে অন্নজল উৎসর্গ করা হয়। মুষাহারেরা আঘর অর্থাৎ অকুলীন ব্রাহ্মণের সহায়তা নিয়ে মৃতের শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন করে। মৃতব্যক্তির জ্যেষ্ঠপুত্র মুখাগ্নি করে এবং চিতা প্রজ্জ্বলিত করে। শোক পালনের শুরুতে মৃতব্যক্তির নিকটাত্মীয়েরা নগ্নপদে থাকে এবং তেল ও সাবান ব্যবহার করে না। দশম দিনে মৃতের উদ্দেশ্যে পিন্ডদান-এর পর শোকপালনকারীরা তেল, হলুদ ও লবণ ব্যবহার করে তাদের আহার্যসামগ্রী তৈরি ও গ্রহণ করে। শোক পালনের শেষদিনে অর্থাৎ ষোলতম দিবসে মৃতব্যক্তির স্মরণে শরহাইয়া শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। শ্রাদ্ধের ভোজে কেবল নিরামিষ খাদ্য পরিবেশিত হয়। পরদিন অর্থাৎ মৃত্যুর সতেরতম দিন থেকে শোকপালনকারীরা স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসে এবং আমিষ খাদ্যদ্রব্যাদি গ্রহণ করে। [সুভাষ জেংচাম]