ব্রজবুলি

ব্রজবুলি  মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় কাব্যভাষা বা  উপভাষা। মিথিলার কবি  বিদ্যাপতি (আনু. ১৩৭৪-১৪৬০) এর উদ্ভাবক। তিনি মৈথিলী ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার মিশ্রণে এই কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষা উদ্ভাবন করেন। এ ভাষায় তিনি রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক বহু পদ রচনা করেন। পদগুলিতে রাধাকৃষ্ণের ব্রজলীলা বর্ণিত হওয়ায় এর নাম হয়েছে ব্রজবুলি। অবশ্য এই পদগুলি তখন ব্রজধামে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল বলেও একে ব্রজবুলি বলা হতো। এর উৎপত্তি বিদ্যাপতির হাতে হলেও পরিপুষ্টি হয়েছে বাঙালি কবিদের হাতে।

বিদ্যাপতির পদগুলি বাংলায় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল; বিশেষত  চৈতন্যদেব এই পদ আস্বাদন করায় এর ভাষার প্রতি বাংলার কবিগণ আকৃষ্ট হন। ষোল শতকের বাঙালি বৈষ্ণব কবিরা বিদ্যাপতির পদের ভাষা ও ছন্দের অনুকরণে রাধাকৃষ্ণবিষয়ক পদ রচনা করতে শুরু করেন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল বৈষ্ণব কবি এ ভাষায় বহু পদ রচনা করেন। এই ধারা উনিশ শতক পর্যন্ত চলেছিল।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী রচনা করেছেন এ ভাষায়।

বাংলা ছাড়া আসাম এবং উড়িষ্যাতেও ব্রজবুলির বেশ চর্চা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম ব্রজবুলি পদ রচনা করেন যশোরাজ খান, আসামে শংকরদেব এবং উড়িষ্যায় রামানন্দ রায়। এঁরা তিনজনই ছিলেন ষোল শতকের কবি। ব্রজবুলির শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ছিলেন  গোবিন্দদাস কবিরাজ (১৬শ-১৭শ শতক)।

ব্রজবুলি ভাষায় প্রচুর পরিমাণে  তৎসম শব্দ ব্যবহূত হয়েছে। অর্ধতৎসম শব্দের ব্যবহারও লক্ষ করা যায়, তবে বিদেশী শব্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে। এ ভাষায় শব্দ পরিবর্তনের কয়েকটি দৃষ্টান্ত হলো: মাস মাহ, লাবণ্য লাবনি, দুস্তর দুতর, দৃষ্টি দিঠি, মেঘ মেহ ইত্যাদি। মধ্যযুগে ব্রজবুলি ভাষায় রচিত বৈষ্ণবপদের একটি নমুনা হলো: ‘গগনে অব ঘন/ মেহ দারুণ/ সঘনে দামিনী চমকই। কুলিশ পাতন/ শবদ ঝন ঝন/ পবন খরতর বলসই\’ ব্রজবুলি ভাষার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এর পদলালিত্য।  [আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ]