বৌদ্ধ বিহার

বৌদ্ধ বিহার  প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভিক্ষুদের বাসস্থান, ধর্মীয় আচারাদি সম্পন্ন ও ধ্যান করার স্থান এবং বৌদ্ধ শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে একে চিহ্নিত করা যায়। ভিক্ষুদের জন্য লিখিত বৌদ্ধ ধর্মের অনুশাসনমূলক গ্রন্থসমূহ থেকে পাঁচ ধরনের আবাসনের (পঞ্চ লেনাণী) কথা জানা যায়। সেগুলি হচ্ছে: বিহার, আদ্যযোগ, পাসাদ, হাম্মীয় এবং গুহা। এগুলির মধ্যে টিকে আছে শুধু বিহার ও গুহা।

লিপিতাত্ত্বিক, সাহিত্যিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র ধারণা দেয় যে, পাঁচ থেকে বারো শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলা (পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশ) ও বিহারে অনেক বৌদ্ধ মঠের ও বিহারের অস্তিত্ব ছিল। এ বিহারগুলি সাধারণত প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কুষাণ রীতিতে গড়া। এগুলি ছিল বর্গাকৃতি ব্লক রীতির এবং একটি অভ্যন্তরীণ অঙ্গনের চারদিকে চার সারিতে ছিল কক্ষসমূহ। সাধারণত এসব বিহার নির্মিত হতো পাথর অথবা ইট দিয়ে। বিহারের সাংগঠনিক কার্যাদি সম্প্রসারিত হলে বিহারসমূহ আরও অনেক আনুষঙ্গিক বস্ত্তসহ ব্যাপকভাবে ইটের কাঠামোতে নির্মিত হতে থাকে। এগুলি সাধারণভাবে কয়েক তলা বিশিষ্ট হতো এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গনসহ স্তম্ভের উপর ভর করে তৈরি করা হতো টানা বারান্দা। এগুলির কোন কোনটির মধ্যে মঞ্চসহ স্তূপ বা কেন্দ্রীয় মন্দির দেখা যেত। মন্দিরের ভেতরে বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব অথবা বৌদ্ধ নারী দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হতো। গুপ্ত ও পাল যুগে কমবেশি এ ধরনের রীতিতেই বিহারসমূহ স্থাপন করা হতো বাংলা ও বিহারে। সময়ের পরিক্রমায় বিহারসমূহ গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়।

হিউয়েন-সাং এর বিবরণ থেকে কয়েকটি বিকাশমান বিহারের নকশা ও কাঠামো সম্পর্কে ধারণা করা যায়। তিনি পুন্ড্রবর্ধনের (মহাস্থান) রাজধানী শহর থেকে প্রায় ৬.৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত বিশাল পো-শি-পো বিহারের কথা উল্লেখ করেছেন। বিহারটি এর প্রশস্ত হলঘর এবং লম্বা লম্বা কক্ষের জন্য বিখ্যাত ছিল। জেনারেল কানিংহাম এই বিহারকে ভাসু বিহার বলে শনাক্ত করেন। হিউয়েন-সাং কর্ণসুবর্ণ এর (রাঙামাটি, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম বাংলা) নিকট অবস্থিত বিখ্যাত লো-টো-মো-শি বিহারের (রক্তমৃত্তিকা বিহার) কথাও উল্লেখ করেছেন। বিহারটির অবস্থান রাঙামাটি অঞ্চলে (বর্তমান চিরুটি, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম বাংলা) শনাক্ত করা হয়েছে। এখানে উৎখননের পর প্রথাগত নকশার ভেতর বিন্যস্ত কয়েকটি মঠ-কক্ষ ছাড়াও পাওয়া গিয়েছে সম্প্রসারিত অংশে কিছু স্থাপনা, যেমন- মন্দির, স্তূপ, প্যাভিলিয়ন ইত্যাদি।

বাংলার প্রাচীনতম বিহারের মধ্যে একটি বিহার পাওয়া গিয়েছে বিহারাইলে (রাজশাহী জেলা, বাংলাদেশ)। বিহারের নকশা প্রাচীন রীতি অনুযায়ী করা হয়েছিল অর্থাৎ প্রধান অঙ্গনের চারদিকে সারিবদ্ধ কক্ষসমূহ নির্মাণ করা হয়েছিল। বিহারটি গুপ্ত যুগে নির্মিত হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া হয়।

সোমপুর মহাবিহার, পাহাড়পুর

প্রাচীন বাংলায় পাল যুগে বেশ কিছুসংখ্যক বিহার গড়ে উঠেছিল। এর একটি মহাস্থান থেকে উত্তর-পশ্চিমে ৪৬.৫ কিলোমিটার দূরে পাহাড়পুরে অবস্থিত সোমপুর মহাবিহার। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, পাল রাজা ধর্মপাল এ বিহারটি নির্মাণ করেছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্দির তৈরিতে প্রথাগত ক্রুশাকৃতি নকশা অনুসরণ করা হয়েছে। অঙ্গনের দেয়ালে ছিল স্বতন্ত্র ১৭৭টি কক্ষ। পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছিল কেন্দ্রীয় ব্লকসমূহ। এগুলি সম্ভবত অতিরিক্ত উপাসনা গৃহ হিসেবে ব্যবহূত হতো। এ ধারার বিহারের মধ্যে এটিই ছিল প্রথম বিহার এবং এর সুখ্যাতি এগারো শতক পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।

বিখ্যাত নালন্দা মহাবিহারটি কয়েক শতক পূর্বে নির্মিত হয়েছিল। হিউয়েন-সাং বিহারটির ঐশ্বর্য ও বিশালত্বের বর্ণনা দিয়েছেন। তিববতীয় ও চৈনিক সূত্রে এ বিহার সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। পাল-পরবর্তী যুগেও বিহারটির খ্যাতি ছড়িয়ে পরেছিল।

তিববতীয় সূত্র থেকে বিক্রমশীলা মহাবিহার সম্পর্কে জানা যায়। বিহারটি নির্মাণ করেছিলেন পাল রাজা ধর্মপাল। এর প্রকৃত অবস্থান ভাগলপুর (বিহার) জেলার ক্ষুদ্র গ্রাম অন্তিচকে। এ বিহারে ১০৭টি মন্দির এবং ৫০টি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ছিল। এ প্রতিষ্ঠানসমূহে ১০৮ জন ভিক্ষুর জন্য কক্ষ বরাদ্দ ছিল। বিহারটি প্রতিবেশী দেশসমূহের শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করেছিল।

তিববতীয় গ্রন্থ পাগ্সাম-যন-জঙ্গ থেকে ওদন্তপুরী বিহারের কথা জানা যায়। কিন্তু তিববতীয় সূত্র থেকে বিহারটির পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায় না। প্রথম গোপাল (৭৫৬-৭৮১খ্রি.) নালন্দার নিকটে এটি নির্মাণ করেন। বখতিয়ার খলজী এই বিহারটিই আক্রমণ করেছিলেন।

খুবই কৌতূহলোদ্দীপক ও গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত অট্টালিকাদির অংশসমূহ আবিষ্কৃত হয়েছে ময়নামতীতে। এখানে বেশ কয়েকটি বিহারের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে শালবন বিহার। এ কমপ্লেক্সটি প্রচলিত পরিকল্পনায় নির্মিত বেশ বড় আকারের বিহার নিয়ে গঠিত ছিল। এ বিহারের কেন্দ্রীয় আঙ্গিনার চারদিকে চার সারিতে মঠ-কক্ষসমূহ ছিল। এর কেন্দ্রে ছিল ক্রুশাকৃতি নকশায় নির্মিত একটি মন্দির। প্রাপ্ত একটি সীলের ভাষ্য অনুযায়ী (প্রত্নস্থলে প্রাপ্ত) বিহারটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দেব বংশ এর রাজা ভবদেব।

পালযুগের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বিহার হচ্ছে ত্রৈকুট, দেবীকোট (প্রাচীন কোটিবর্ষ বা বর্তমান বাণগড়ের সঙ্গে একে শনাক্ত করা হয়েছে), পন্ডিত বিহার এবং জগদ্দল মহাবিহার। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সময়ে উৎখনন কার্য পরিচালনা করার ফলে পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার ভরতপুরে বৌদ্ধ বিহার কমপ্লেক্স আবিষ্কৃত হয়েছে। আদি মধ্যযুগে বিহারটি নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। জগজ্জীবনপুরে (মালদহ জেলা, পশ্চিম বাংলা) সাম্প্রতিক উৎখননের ফলে নয় শতকের আরেকটি বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে। দুর্ভাগ্য যে, বিহারটির উপরিকাঠামোর কিছুই টিকে নেই। তবে প্রত্নস্থলটিতে বারান্দাসহ আয়তাকার আঙ্গিনামুখী বেশ কয়েকটি মঠ-কক্ষ পাওয়া গেছে। এখানে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে যে, এর কোণের কক্ষগুলি ছিল বৃত্তাকার। জগজ্জীবনপুর বিহারের সাধারণ গঠন এবং আকৃতি নালন্দার মতোই ছিল বলে ধারণা করা হয়।

এছাড়াও লিপিতাত্ত্বিক ও অন্যান্য সূত্রে বিচ্ছিন্নভাবে আরও কয়েকটি বিহারের কথা জানা যায়। সেগুলিও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সেগুলির মধ্যে ফুল্লহরি (পশ্চিম মগধ), হলুদ বিহার (পাহাড়পুরের ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে), পরিক্রমণ বিহার (বিহার রাজ্য) ও যশোবর্মপুর বিহারের (বিহার রাজ্য) নাম উল্লেখ করা যায়।  [সারিতা ক্ষেত্রী]