ভাসু বিহার
ভাসু বিহার বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বিহার গ্রামের উত্তর দিকে মহাস্থানগড় থেকে প্রায় ৬ কিমি এবং নাগর নদী থেকে ৫০০ মিটার পশ্চিমে অবস্থিত। স্থানীয় অধিবাসীদের নিকট নরপতির ধাপ নামে পরিচিত ভাসু বিহার প্রত্নস্থলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে পরবর্তী গুপ্তযুগের দুটি আয়তক্ষেত্রাকার বৌদ্ধবিহার এবং একটি প্রায় ক্রুশাকৃতি মন্দির উন্মোচিত হয়েছে।
প্রথম বিহার উত্তর-দক্ষিণে ১৪৮.১৩ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৩৯ মিটার পরিমাপের প্রায় আয়তক্ষেত্রাকার বিহারটি পোড়া ইটের তৈরি। দুই ইটের মাঝখানে মর্টার হিসেবে কাদামাটির ব্যবহার লক্ষণীয়। আয়তক্ষেত্রাকার আঙিনার চারদিকে কাদামাটির তৈরি ১১ মিটার × ১০ মিটার আয়তনের মোট ২৬টি কক্ষ রয়েছে। পূর্বদিকের বাহুর মধ্যভাগে তোরণের সম্মুখভাগটি (ফাসাদ) ছিল আকর্ষণীয়। বিহার কক্ষ সারিতে অবস্থিত অভ্যন্তরীণ হলঘরের মতো একটি কক্ষে প্রবেশ করার জন্য একটি স্তম্ভবিশিষ্ট প্রবেশপথ ছিল। তোরণটিতে দুটি রক্ষীকক্ষও ছিল।
দ্বিতীয় বিহার ভূমি পরিকল্পনায় দ্বিতীয় বিহারটি ১ম বিহারের প্রায় অনুরূপ এবং উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত। উন্মুক্ত আঙিনার চারদিকের বারান্দা সংলগ্ন বিহারের ৩০টি কক্ষের অবস্থান। পূর্ব ও পশ্চিমে ৭টি এবং দক্ষিণ বাহুর মাঝখানে প্রবেশপথ ছাড়াও ৮টি করে কক্ষ রয়েছে। দক্ষিণ বাহুর মধ্যখানে প্রধান তোরণটি বাইরের দিকে অভিক্ষিপ্ত এবং সেদিকেই মন্দিরটি অবস্থিত। বিহারটির উত্তর এবং পশ্চিমে গভীর নিচু খাদটি প্রাচীন কোন নদীখাত বা জলাশয়ের চিহ্ন বহন করে। সেকারণে হয়ত বা বিহারের পূর্বদিকে প্রবেশপথ রাখা হয় নি, যা বাংলার বৌদ্ধবিহারের স্থাপত্যিক ঐতিহ্য অনুসারে থাকার কথা ছিল। তোরণটিতে দুটি রক্ষীকক্ষও ছিল।
প্রধান মন্দির প্রধান মন্দিরটি ছিল কমপ্লেক্সের দক্ষিণ-পূর্ব পার্শ্বে, দু নম্বর বিহারের দক্ষিণে এবং এক নম্বর বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব পার্শ্বে। মন্দিরটি প্রায় ক্রুশাকৃতি এবং এখানে ধাপবিশিষ্ট সিঁড়ির প্রদক্ষিণ পথ ছিল। পশ্চিম দিক থেকে মন্দিরে প্রবেশ করতে হতো। সমাবেশ স্থল বা মন্ডপটি ছিল মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতায় প্রদক্ষিণ পথ ছিল। ভিত্তির সর্বনিম্ন অংশের বহিসম্মুখভাগ পোড়ামাটির ফলকে অলঙ্কৃত ছিল। উৎখননের ফলে বিহার এবং মন্দির স্থাপত্যের ভিত্তি ছাড়াও ব্রোঞ্জ মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক, অক্ষর খোদিত পোড়ামাটির সিল, অলঙ্কৃত ইট এবং মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে। কক্ষগুলির অভ্যন্তর থেকে ৬০টিরও অধিক ব্রোঞ্জ মূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে। পন্ডিতদের মতে মূর্তিগুলির কিছু হয়ত বিহার নির্মাণ যুগের আগেই তৈরি এবং পরবর্তীকালে সেগুলি বিহারে রাখা হয়েছিল। সমস্ত মূর্তির পেছনে স্লাব এবং উঁচু পেডেস্টাল ছিল। মূর্তিগুলির মধ্যে বুদ্ধ, ধ্যানীবুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব এবং বোধিশক্তি উল্লেখযোগ্য। ধ্যানীবুদ্ধের মধ্যে অক্ষোব্য মূর্তির সংখ্যা বেশি। বোধিসত্ত্ব মূর্তির মধ্যে অবলোকিতেশ্বর সচরাচর পাওয়া যায়; দেবী মূর্তির মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের তারার আধিপত্য দেখা যায়। কোনো প্রমাণ আকারের ব্রোঞ্জ মূর্তি পাওয়া না গেলেও একটি লিপি খোদিত বড় আকারের পেডেস্টাল পাওয়া যায়, যা বড় আকারের কোনো মূর্তির অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে। কিছু মূর্তিতে অবশ্য অক্ষর খোদিত আছে কিন্তু সব মূর্তির স্লাবের পেছনে সিল রয়েছে। ভাসু বিহারে প্রাপ্ত মূর্তির দীর্ঘ হালকা-পাতলা শরীর, ক্ষীণ কটি, প্রশস্ত বুক এবং মার্জিত অন্যান্য বৈশিষ্ট্য পালযুগের ধ্রুপদি শিল্পকলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ময়নামতীর খাটো এবং মোটা, সরল এবং স্থূল প্রকৃতির মূর্তি থেকে ভাসু বিহারের নির্দশনগুলি ভিন্ন রূপের।
মানুষ, পাখি, বিভিন্ন প্রাণী, ফুল, লতাপাতা এবং জ্যামিতিক নকশা ছিল পোড়ামাটির ফলকের বিষয়বস্ত্ত। এ ছাড়া অলঙ্কৃত ইট ও মন্দিরের দেয়ালগাত্রে ব্যবহূত হয়েছিল। পদ্মের পাঁপড়ি, ধাপ-পিরামিড, দন্ত, ঢেউ, ফুল এবং শিকল ইটের নকশা বেশি ব্যবহূত হয়েছে। পাহাড়পুর ও ময়নামতীসহ অন্যান্য বৌদ্ধ স্থাপত্যের মতো ভাসু বিহারে ইট অলঙ্করণে পদ্মের পাঁপড়ি এবং ধাপ-পিরামিড বেশি ব্যবহূত হয়েছে। ২৫০টির বেশি অক্ষর খোদিত সিল পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে এ পর্যন্ত ১০০টির অধিকের পাঠোদ্ধার করা হয়েছে।
আলেকজান্ডার কানিংহাম ভাসু বিহার এবং সাত শতকের চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং উল্লিখিত পো-সি-পো বিহার অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু কোনো কোনো পন্ডিত কানিংহামের শনাক্তীকরণের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন; তাঁদের মতে ভাসু বিহারের মাত্র ৫৬টি কক্ষে হিউয়েন-সাং উল্লিখিত ৭০০ বৌদ্ধ ভিক্ষুর একসঙ্গে বাস করা সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ পর্যন্ত ভাসু বিহার উৎখননে দশ-এগারো শতকের স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে; হিউয়েন-সাং এর সাত শতকের স্তরের সাক্ষাৎ এখনও পাওয়া যায়নি। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে এখনও ভাসু বিহার ও হিউয়েন-সাং-এর পো-সি-পো বিহারের অভিন্নতা প্রমাণ করা সম্ভব হয় নি। [শাহ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান]