দৌলতপুর মহসিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়

দৌলতপুর মহসিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। এটি খুলনা জেলার প্রথম হাইস্কুল। বর্তমানে খুলনা শহরের খান এ সবুর রোডে অবস্থিত। দানবীর  হাজী মুহাম্মদ মোহসীনএর পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্যালয়টি গড়ে ওঠে। হাজী মুহাম্মদ মোহসীন-এর জমিদারির অধিকাংশই ছিল খুলনায়। খুলনা জেলার সৈয়দপুর, শোভনা, চরভদ্র প্রভৃতি জমিদারি নিয়ে গঠিত হাজী মোহসীনের ‘সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেট’-এর কাচারি ছিল দৌলতপুরে। এর ম্যানেজার ছিলেন বাবু ক্ষেত্রগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই প্রথম এ স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে এ এস্টেটের ইনচার্জ ডেপুটি কালেক্টর বাবু ব্রহ্মনাথ সোমের সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি সম্মতি দিলে ১৮৬৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এ স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কুলের প্রথম নাম ছিল ‘দৌলতপুর-সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেট স্কুল’। এটি শুরুতে ছিল একটি মাইনর স্কুল। পরে নাম হয় ‘দৌলতপুর মাইনর স্কুল’।

স্কুলের প্রথম ক্লাস শুরু হয় জনৈক ব্যবসায়ী গৌরমোহন সাহার দোকানের এক কামরায়। কয়েক বছরের মধ্যে এটিকে হাই স্কুলে রূপান্তর করা হয়। এ স্কুলের প্রথম সাময়িক প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন অভয়কুমার সেন। কয়েকমাস পরে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন রাজমোহন ঘোষ। প্রথম হেডপন্ডিত নিযুক্ত হন তারকনাথ ভট্টাচার্য। স্কুলটি যাত্রা শুরু করেছিল ৫৪ জন ছাত্র নিয়ে। এক মাসের মধ্যে ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০। ৬ মাসের মধ্যে স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও বেড়ে যাওয়ায় মহেশ্বরপাশা নিবাসী শ্রী উমাচরণ মুখার্জির বাড়িতে স্কুলটি স্থানান্তরিত হয়। এস্টেট অর্থ সাহায্য দিতে থাকে প্রতি মাসে ৫৪ টাকা। ছাত্র বেতন পাওয়া যেত প্রতি মাসে ১৭ টাকা। প্রধান শিক্ষকের বেতন ছিল মাসিক ৩০ টাকা। ১৮৭০ সালে এ স্কুল থেকে ১৩ জন ছাত্র মধ্য ইংরেজি ফাইনাল পরীক্ষা দেয় এবং পাস করে ১২ জন। পরবর্তী বছরগুলিতে ছাত্রদের পরীক্ষার ফলাফল ভাল হওয়ায় ১৮৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্কুলটিকে হাই ইংলিশ স্কুলে উন্নীত করা হয়। সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেটের তৎকালীন এজেন্ট ও যশোরের কালেক্টর মি. জেমস মনরো ট্রাস্টের বাংলোতে স্কুলটি স্থানান্তর করেন। ওই সময়ে নীলচাষ উঠে যায়। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসও উঠে যায়। এগুলির অধীন ভবনগুলি স্কুলকে অর্পণ করায় স্থানসংকট সমস্যার সমাধান হয়। স্কুলে একটি মাদ্রাসা বিভাগ খোলা হয়। এটি প্রতিষ্ঠার ফলে বিলম্বে হলেও মুসলমানরা শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়।

১৮৮৭ সালে কিছু দুষ্কৃতকারী স্কুলে আগুন ধরিয়ে দিলে স্কুলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তদুপরি  ভৈরব নদীর ভাঙনের ফলে অন্যত্র স্কুলটি স্থানান্তর করার প্রয়োজন অনুভূত হয়। পরবর্তীকালে ট্রাস্ট এস্টেটের সুন্দর বাংলোটি স্কুলকে অর্পণ করায় স্কুলের ভবন সমস্যার সুরাহা হয়। ১৮৯৪ সালের জুন মাসে পুনরায় স্কুলে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। ১৯০০ সালে স্কুলের জন্য নির্মিত হয় নতুন পাকাঘর। মোটামুটি স্কুলটি স্থানীয় সাধারণ জনগণ, এস্টেট ও সরকার এ তিন পক্ষের অর্থসাহায্যে চালু ছিল।

১৯১৬ সালে খেলার মাঠ ও হোস্টেলের জন্য স্কুলসংলগ্ন ৫ বিঘা জমি কেনা হয়। এ সময় মুসলমান ছাত্রদের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানরা যাতে শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে আসে। এ স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে যারা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তাদের মধ্যে  সৈয়দ নওশের আলীর নাম অগ্রগণ্য। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ১৯১৯ সালে এ স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীকালে তিনি যশোর জেলা বোর্ডের সভাপতি, রেলওয়ে বোর্ডের সদস্য, বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য ও স্পিকার এবং এ. কে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মুসলিম লীগ নেতা  আবদুস সবুর খান এ স্কুলের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে ফণিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুল হামিদ ও সরোয়ার জাহান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিশিষ্ট লেখক বাঙ্গাল আবু সাঈদ, কবি ও নাট্যকার কাজী আবদুল খালেক ও খগেন্দ্রনাথ বসু, প্রকৌশলী এস.এম শহীদুল্লাহ, অভিনেতা গোলাম মুস্তফা, কণ্ঠশিল্পী শেখ ইসমাইল হোসেন, শ্যামল চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি আ.আ.ম.স আরেফিন সিদ্দিক প্রমুখ এ স্কুলের ছাত্র ছিলেন।  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিছুকাল এ স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

বর্তমানে এ স্কুলে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও কলা বিভাগ চালু রয়েছে। এখানে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শুধু ছাত্রদের পাঠদান করা হয়। প্রতি শ্রেণিতে ৩টি করে সেকশন রয়েছে। ১৭ জন শিক্ষক দ্বারা ৭৫৪ জন ছাত্রের পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন  খেলাধুলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, স্কাউট, বিএনসিসি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচবার বিএনসিসি পরিচালনায় জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্লাটুন নির্বাচিত হয়। ২০০৬ সালে এই বিদ্যালয় মেট্রোপলিটন স্কাউটস সমাবেশে ৩য় স্থান এবং ২০০৭ সালে স্কুলের শতবর্ষ সমাবেশে ১ম স্থান লাভ করে। এছাড়া ফুটবল, ক্রিকেট ও ভলিবলে মুহসিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় বিভিন্ন সময়ে রানারআপ ও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক থানা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। এদের মধ্যে স.ম নাসিমউদ্দিন মাহতাব ২০০২ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক গোল্ড মেডেল প্রাপ্ত হন।

বিদ্যালয়টি ৩.১৫ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে ৩ হাজার বই সম্বলিত একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার এবং আধুনিক সুযোগসুবিধা সম্বলিত কম্পিউটার ল্যাব ও বিজ্ঞানাগার রয়েছে। এছাড়া রয়েছে অডিটোরিয়াম, মসজিদ ও ক্যান্টিন। বিদ্যালয়ে ৪টি দ্বিতল, ১টি একতলা ভবন, চার কক্ষ বিশিষ্ট ১টি টিনশেড হোস্টেল এবং প্রধান শিক্ষকের জন্য ১টি টিনসেড বাসভবন রয়েছে। স্কুলের নিজস্ব ২টি খেলার মাঠ আছে। পরীক্ষার ফলাফলের দিক থেকে এ স্কুল পুরানো ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছে। প্রতিবছর এ স্কুল থেকে যতজন এস.এস.সি পরীক্ষার্থী অংশ নেয় তার ৮০ শতাংশই উত্তীর্ণ হয়।  [শেখ শাহজাহান]