গ্রিয়ারসন, জর্জ আব্রাহাম

গ্রিয়ারসন, জর্জ আব্রাহাম (১৮৫১-১৯৪১)  ইউরোপীয় ভারততত্ত্ববিদ। ১৮৫১ সালের ৭ জানুয়ারি আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন বিশিষ্ট রাজকীয় মুদ্রণশিল্পী। সেন্ট বীস ও শ্রিউয়িসবেরীর বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের পর গ্রিয়ারসন ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখানে  সংস্কৃত ও হিন্দুস্থানী ভাষা শেখেন। সংস্কৃত ভাষাসহ অন্যান্য প্রাচ্যভাষা ও ভাষাতত্ত্বে তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে উক্ত কলেজের অধ্যাপক রবার্ট এ্যাটকিনসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা পরবর্তীকালে গ্রিয়ারসনের সাধনা ও খ্যাতি লাভের ক্ষেত্রে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।

গ্রিয়ারসন ২৩ বছর বয়সে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীনে সিভিল সার্ভেন্টপদে যোগদান করেন। তখন সমগ্র বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা ছিল এ প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত। এ পদে নিযুক্ত হয়েই তিনি এ দেশিয় ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৮৭৪-৯৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গ্রিয়ারসন রংপুর, হাওড়া, গয়া ও পাটনা অঞ্চলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে পাটনা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার নিযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি ১৮৯৮ সালে বিহারের আফিম বিভাগেরও অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে চাকরি করার সুবাদে সে অঞ্চলের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি রচনা করেন মূল্যবান প্রবন্ধসমূহ। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক লোককথার সংগ্রহ ও রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার গতি-প্রকৃতিবিষয়ক আলোচনা। পরের বছর উক্ত পত্রিকারই ২য় খন্ড ৩য় সংখ্যায় তাঁর সংগৃহীত মানিকচন্দ্রের গান ইংরেজি অনুবাদসহ দেবনাগরী লিপিতে প্রকাশিত হয়। তারপর গোপীচাঁদের গীতও উক্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে এ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর মৈথিলী ভাষার ব্যাকরণ An Introduction of the Maithili Language of North India এবং এ সংক্রান্ত আলোচনা। বিহারে থাকাকালে গ্রিয়ারসন সেখানকার কৃষকদের সঙ্গে মিশে তাঁদের ভাষা ও জীবন সম্পর্কে অবহিত হন। ফলে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে তিনি Bihar Peasant Life নামে এক অনন্য গ্রন্থ রচনা করেন। এ ছাড়া ১৮৮৩-৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গ্রিয়ারসন রচিত বিহারের সাতটি উপভাষার ব্যাকরণ Seven Grammars of the Dialects and Subdialects of Bihari Language আট খন্ডে প্রকাশিত হয়।

১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের ভিয়েনা নগরীতে আন্তর্জাতিক প্রাচ্যবিদ্যা গবেষণার যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে অংশগ্রহণ করে গ্রিয়ারসন ভারতীয় ভাষা ও উপভাষাসমূহ সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁর এ অভিমত উক্ত সম্মেলনে গুরুত্বের সঙ্গে গৃহীত হয় এবং সম্মেলনের উদ্যোক্তারা এ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ভারতের ব্রিটিশ সরকারকে এ বিষয়ে গবেষণা পরিচালনার অনুরোধ জানান। ভারত সরকার এ অনুরোধের ভিত্তিতে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রিয়ারসনকে সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত করে উক্ত কাজের ভার দেয়। গ্রিয়ারসন বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে কাজ শুরু করেন এবং ভারতের সকল ভাষার উপাদান সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু সংবাদদাতা ও কর্মী নিয়োগ করেন। কর্মীদের নিকট তিনি বাইবেলের একটি কাহিনী, কিছু শব্দ ও বাক্যাংশসংবলিত কাগজ সরবরাহ করেন। তাতে ভারতের প্রত্যেক ভাষার লোকদের মাধ্যমে যার যার ভাষায় ওই কাহিনীর রূপান্তর, শব্দাবলি ও বাক্যাংশের প্রতিরূপ সংগ্রহ করা হয়। এভাবে তিনি ভারতে ভাষাভিত্তিক জরিপ গবেষণার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রিয়ারসন সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ইংল্যান্ড যান এবং সংগৃহীত ভারতীয় ভাষা সম্পর্কিত তথ্য ও উপাদানের ভিত্তিতে গবেষণা শুরু করেন। এ গবেষণার ফলই তাঁর জীবনের অমর কীর্তি Linguistic Survey of India। ১৯০৩-২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২০ খন্ডে ৮০০০ পৃষ্ঠায় এ মহাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এটি ভারতের ভাষা-জাত-কুল সম্পর্কে যেমন বিজ্ঞানসম্মতভাবে আলোচনা করেছে, তেমনি ভারতের আধুনিক ভাষাতত্ত্বের সূতিকাগার হিসেবেও কাজ করেছে। তাঁর এ অসামান্য গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাঁকে মর্যাদাপূর্ণ Order of Merit উপাধিতে ভূষিত করে। ডাবলিন, অক্সফোর্ড, পাটনা ও Halle (জার্মানি) বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ভারতের তৎকালীন ভাষাতত্ত্ব সমিতি বিশ্বের বিভিন্ন পন্ডিত কর্তৃক ভারতবিদ্যা বিষয়ে লিখিত প্রবন্ধসমূহের একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁকে উৎসর্গ করে। তিনি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত ফেলো মনোনীত হন।

গ্রিয়ারসন রচিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাশ্মীরী ভাষা সংক্রান্ত  অভিধানব্যাকরণ ও প্রবন্ধসংগ্রহ, যেগুলি ১৯১৬-৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে Journal of the Asiatic Society of Bengal, Indian Antiquary-সহ ইউরোপের বিখ্যাত পত্রিকাসমূহে ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি, অশোক লিপি, রাজগৃহের বুদ্ধমূর্তি ও লিপিমালা বিষয়ে প্রচুর গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ ইংল্যান্ডের সারে অঞ্চলের ক্যাম্বারলেস্থ নিজস্ব বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।  [হাকিম আরিফ]