গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ
গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-১৫৩৮) বাংলার হোসেন শাহী বংশের শেষ সুলতান। তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র সুলতান আলাউদ্দীন ফিরুজকে হত্যা করে ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং পাঁচ বছর শাসন করেন।
ভ্রাতুষ্পুত্রকে ক্ষমতাচ্যুত করে গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ অমাত্যদের মধ্যে নিজের শত্রু সৃষ্টি করেন এবং নিজ রাজ্যে অন্তর্বিরোধের বীজ বপন করেন। তাই সিংহাসনে আরোহণের পর তিনি খুব জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মাহমুদ শাহের গভর্নর ও সেনাপতি খুদা বখশ খান তার শাসন কর্তৃত্ব কর্ণফুলী থেকে আরাকানের পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যবর্তী এলাকায় বিস্তৃত করেন এবং প্রায় স্বাধীন শাসকের মতো আচরণ করতে থাকেন। অন্যদিকে রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের রাজনৈতিক শক্তিসমূহ ঐকবদ্ধ হচ্ছিল। মাহমুদ শাহকে বাংলার সুলতান হিসেবে মেনে নিতে হাজীপুরের শাসনকর্তা মখদুম আলম অস্বীকার করেন এবং সুলতান আলাউদ্দীন ফিরুজের হত্যার অজুহাতে তিনি বিহারের উপ-শাসনকর্তা শেরখানের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন এবং বিদ্রোহাত্মক মনোভাব প্রদর্শন করেন। এ সময়ে, জালাল খান লোহানীর অভিভাবক হিসেবে তিনিই ছিলেন বিহারের প্রকৃত শাসনকর্তা।
মাহমুদ শাহ মখদুম আলমকে দমন করতে সক্ষম হলেও শেরখানের শক্তি ও মর্যাদা অপ্রতিহতভাবে বৃদ্ধি পায়। শেরখানের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিহারে দুটি দলের সৃষ্টি করে একটি শেরখানের এবং অপরটি জালাল খানের নেতৃত্বে। জালাল খান শেরখানের বিরুদ্ধে মাহমুদের নিকট সাহায্য চান এবং বাংলার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার ছলে তিনি তার সমর্থকদের নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেন এবং নিজেকে মাহমুদের আশ্রয়ে সমর্পণ করে তার আনুগত্য স্বীকার করে নেন।
বাংলার সুলতানের দরবারে জালাল খানের আশ্রয় গ্রহণ শেরখানকে দমন করার বিশেষ অধিকার মাহমুদ শাহকে প্রদান করে। মাহমুদ শাহ বিহার জয় করার জন্য ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে ইব্রাহিম খানের নেতৃত্বে গোলন্দাজ, অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যসম্বলিত একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। এ অভিযানে জালাল খানও ইব্রাহিম খানের সাথে ছিলেন। শেরখান অতর্কিতে সম্মিলিত বাহিনীকে আক্রমণ করেন এবং ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চে সুরজগড়ে তাদেরকে পরাভূত করেন। এ যুদ্ধে ইব্রাহিম খান পরাজিত ও নিহত হন এবং জালাল খান তার আশ্রয়দানকারী মাহমুদ শাহের নিকট ফিরে যেতে বাধ্য হন।
সুরজগড়ের যুদ্ধ বাংলার সামরিক মর্যাদাকে বিনষ্ট করে দেয়। এরপর লোহানীরা দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেয়। গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ এবং শেরখান উভয়েই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে স্থিরপ্রতীজ্ঞ হন।
ইতোমধ্যে বাংলার উপকূলে পর্তুগিজদের আগমন এবং তাদের কর্মকান্ড মাহমুদকে আরও সমস্যার মধ্যে ফেলে দেয়। ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজগণ বাংলায় বাণিজ্য শুরু করার জন্যই চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। কিন্তু তারা চট্টগ্রামের মুসলিম গভর্নর ও ব্যবসায়ীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। ফলে তারা গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহের নির্দেশে বন্দি হয় এবং তাদেরকে বন্দি হিসেবে গৌড়ে পাঠানো হয়। কিন্তু শেরখানের আক্রমণাত্মক কর্মতৎপরতায়, যা সুরজগড়ে বিজয়ের ফলে আরও তীব্রতর হয়েছিল, মাহমুদ তার কর্মপন্থা পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। শেরখানের সাথে মোকাবিলা করার জন্য মাহমুদ শাহ পর্তুগিজদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তাই তিনি পর্তুগিজ বন্দিদের মুক্তি দেন এবং এমন কি, তিনি ডি. মেলো জুসার্তেকে তার সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। পর্তুগিজদেরকে চট্টগ্রাম ও সাতগাঁওএ (হুগলি) তাদের কারখানা নির্মাণেরও অনুমতি দেওয়া হয়।
গুজরাটে হুমায়ুনের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে শেরখান ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভাগলপুর পর্যন্ত ভূভাগ তার রাজ্যভুক্ত করেন। অতঃপর তিনি তেলিয়াগড়ে উপস্থিত হন (১৫৩৬ খ্রি.)। এ সময়ে পর্তুগিজদের সহায়তায় মাহমুদের সৈন্য বাহিনী তেলিয়াগড়ি গিরিপথ সুরক্ষিত করে রেখেছিল। তেলিয়াগড় গিরিপথকে দুর্ভেদ্য দেখে শেরখান তার গতিপথ পরিবর্তন করেন এবং অপ্রত্যাশিতভাবে ঝাড়খন্ডের পথে গৌড়ে উপস্থিত হন। এভাবে তিনি মাহমুদের সকল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরিকল্পনাকে নিষ্ফল করে দেন। শেরখানের আকস্মিক উপস্থিতিতে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তার পর্তুগিজ মিত্রগণ তাকে তাদের সাহায্য না পৌঁছা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন। কিন্তু মাহমুদ শাহ সে সময় পর্যন্ত অপেক্ষা না করে শান্তি স্থাপনের জন্য শেরখানের নিকট প্রস্তাব দেন। শেরখান তার শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং প্রচুর পরিমাণে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিহারে প্রত্যাবর্তন করেন।
১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে শেরখান পুনরায় বাংলায় আসেন এবং রাজধানী অবরোধ করেন। এ সময়ে হুমায়ুন চুনার দখল করার জন্য পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। হুমায়ুনের এ অগ্রযাত্রার গুরুত্ব অনুধাবন করে শেরখান তার পুত্র জালাল খান ও খাবাস খানকে গৌড় অবরোধের কাজ অব্যাহত রাখার দায়িত্ব দিয়ে মুগলদেরকে ব্যস্ত রাখার উদ্দেশ্যে অতি দ্রুত চুনারে চলে যান। মাহমুদ শাহ দুর্গ থেকে বের হয়ে আসেন এবং শত্রুদের আক্রমণ করেন। যুদ্ধে তিনি আহত হন এবং পরাজিত হয়ে উত্তর বিহারের হাজীপুরের দিকে পালিয়ে যান। এভাবে গৌড় ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল আফগানদের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে যায়।
এ সময় হুমায়ুন চুনার অধিকার করার পর বারকুন্ডায় অবস্থান করছিলেন। উত্তর বিহার থেকে মাহমুদ হুমায়ুনকে বাংলার দিকে তার অভিযান পরিচালনা এবং সেখান থেকে আফগানদেরকে বিতাড়িত করার অনুরোধ জানান। হুমায়ুন এ অনুরোধে সাড়া দিয়ে বাংলা অভিমুখে তার অভিযান পরিচালনা করেন। মাহমুদ শাহ দরবেশপুরে তাঁর সঙ্গে যোগদেন। খলগাঁওয়ে তাদের উপস্থিতির পর মাহমুদ জানতে পারেন যে, আফগানদের হাতে গৌড়ে তার দুই পুত্র নিহত হয়েছে। এ সংবাদে শোকে তাঁর মৃত্যু হয়। এভাবে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে হোসেন শাহী বংশের অবসান হয় এবং এর সাথে সাথে বাংলার স্বাধীন সালতানাতেরও অবসান ঘটে।
গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ দুর্বল, আরাম প্রিয় এবং সহজ প্রকৃতির সুলতান ছিলেন। সিংহাসনে আরোহণকালে তিনি যে রাজনৈতিক সমস্যাবলির সম্মুখীন হয়েছিলেন তা সমাধান করার মতো কূটনৈতিক দূরদর্শিতা কিংবা বাস্তব জ্ঞান তাঁর ছিল না।
মাহমুদ শাহের ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাঁর রাজত্বকাল গঠনমূলক কর্মকান্ডবিহীন ছিল না। স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি গৌড়ে দুটি মসজিদ এবং ময়মনসিংহে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে দিনাজপুর জেলার ধোরাইলে একটি সেতু, ১৫৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য একটি তোরণ এবং ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে পূর্ণিয়াতে একটি সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন। [এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমদ]