আহমদ, আসহাবউদ্দীন

আহমদ, আসহাবউদ্দীন (১৯১৪-১৯৯৪)  শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, সাহিত্যিক।  চট্টগ্রাম জেলার  বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর গ্রামে তাঁর জন্ম।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৯ সালে ইংরেজিতে এম.এ পাস করে তিনি  চট্টগ্রাম কলেজকুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চৌদ্দ বছর অধ্যাপনা করেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন ‘বেসরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি’র মুখপত্র Teacher-এর সম্পাদক। তিনি চট্টগ্রাম নাইট (সিটি) কলেজ, বাঁশখালী কলেজ, সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন হাইস্কুল, পশ্চিম বাঁশখালী হাইস্কুল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

আসহাবউদ্দীন আহমদ

১৯৫২ সালে কুমিল্লায়  ভাষা আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে আসহাবউদ্দীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সে সময়ের সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাঁকে বন্দি করে। কট্টর বামপন্থি রাজনীতির কারণে তাঁকে আরও পনেরো বছর আত্মগোপন করে থাকতে হয়। আসহাবউদ্দীনের সাহিত্যকীর্তি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী, তাই তাঁর নিজস্ব রাজনীতির মত ও পথের বিরুদ্ধেও সমালোচনা করতে তিনি দ্বিধা করতেন না। ব্যঙ্গবিদ্রূপ পরিবেশনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। শব্দের ধ্বনিসাম্যে ভিন্ন শব্দের ব্যবহারে ঢ়ঁহ সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।

সর্বদা এক বিক্ষুব্ধ মানসিকতা থেকে রচিত তাঁর বহু রচনা লেখক ও পাঠক উভয়ের জন্য এক অকৃত্রিম রসলোকের সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষের সর্ববিধ মঙ্গলের জন্য তাঁর লেখা আন্তরিকতা ও মমত্ববোধে সমৃদ্ধ। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত দুটি পুস্তিকা মেড্ ভেরি ইজি এবং বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর তাঁর লেখকমন ও মননকে স্পষ্ট করে তোলে। শেষোক্তটি মূলত একটি দীর্ঘ চিঠি এবং এতে কোনো যুক্তাক্ষর ব্যবহূত হয়নি। এ ধারায় তাঁর আরও দুটি রচনা হলো ধার (১৯৫৪) এবং উদ্ধার (১৯৭৮)। এক অকৃত্রিম সারল্য, হাস্যকৌতুক ও যুক্তির সমাহার এবং শেক্সপীয়রীয় সাহিত্যবোধ তাঁর রচনায় সর্বত্র লক্ষণীয়।

ছোটবড় মিলে তাঁর গ্রন্থসংখ্যা একুশ; তবে আরও কিছু  পান্ডুলিপি অপ্রকাশিত রয়েছে। তাঁর সের এক আনা মাত্র (১৯৬৮), জান ও মান (১৯৬৯), লেখক ও পাঠক (১৯৬৯), Bande Votaram (১৯৬৯), হাতের পাঁচ আঙুল (১৯৭০), দাড়ি সমাচার (১৯৭১), বিপ্লব বনাম অতি বিপ্লব (১৯৭২), বাঁশ সমাচার (১৯৭৩), পথ চলিতে (১৯৭৫), আমার সাহিত্য জীবন (১৯৮০), ডেনজার সিগন্যাল (১৯৮০), ঘুষ (১৯৮৬), উজান স্রোতে জীবনের ভেলা (১৯৯০) প্রভৃতি গ্রন্থে সমকালীন রাজনীতি, সমাজবাস্তবতা এবং তাঁর ব্যক্তিগত চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর রচনায়  আবুল ফজল,  মোতাহের হোসেন চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, আহমদ শরীফ প্রমুখ প্রখ্যাত লেখক ও বুদ্ধিজীবীর প্রভাব রয়েছে। জীবনের শেষ পর্যায়ে আসহাবউদ্দীনের বড় পরিচয় মেহনতী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু এবং কলমযোদ্ধা হলেও তাঁর মধ্যে ‘প্রকৃতিকে ভালোবাসুন’, ‘বইকে ভালোবাসুন’ ইত্যাদি শ্লোগান তুলে পরিবেশকে উন্নত করার প্রয়াসও লক্ষ করা যায়। ১৯৯৪ সালের ২৮ মে ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়।  [মাহমুদ শাহ কোরেশী]