আলু

আলু (Potato)  অন্যতম খাদ্য ফসল Solanum tuberosum, গোত্র solanaceae। আলু সম্ভবত আমেরিকার স্থানীয় ফসল। প্রি-কলম্বিয়ান সময়ে আমেরিকার আদি অধিবাসীদের মধ্যে এর চাষাবাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের জন্য এটি ছিল প্রধান খাদ্য। এর ইতিহাস জানা কঠিন, কারণ প্রথম দিকের লেখকগণ মিষ্টি আলু (Ipomoea batatas) ও অন্যান্য সম্পর্কবিহীন উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ‘আলু’ নাম ব্যবহার করেছেন। স্পেনীয় অনুসন্ধানকারীরা ষোল শতকে পেরু থেকে এটি নিয়ে আসে স্পেনে যেখান থেকে তা উত্তর ও পূর্বে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা সম্ভবত ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এটিকে উত্তর আমেরিকায় নিয়ে আসে; এভাবে টমেটোর মতো এটি পশ্চিম গোলার্ধে একটি পুনঃউদ্ভাবিত খাদ্যফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি প্রধান ফসল হিসেবে আলু প্রথম গৃহীত হয় ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে। আয়ারল্যান্ডে আঠারো শতকে এটি প্রধান খাদ্যফসলে পরিণত হয় এবং এ কারণে মিষ্টি আলু থেকে পৃথক করার জন্য এটিকে সচরাচর আইরিশ আলু বলা হতো। ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহে বিশ শতকেও আলু গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইউরোপে বিশেষ করে জার্মানিতে যেখানে এটি দুটি বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশটিকে সচল রেখেছিল। উচ্চ শ্বেতসারবিশিষ্ট আলু আজ পশ্চিমাদের একটি প্রধান খাদ্য, একইসঙ্গে স্টার্চ, ময়দা, এলকোহল, ডেক্সট্রিন ও গোখাদ্যের (প্রধানত ইউরোপে) একটি উৎস। এটি সবচেয়ে ভাল জন্মে ঠান্ডা ও আর্দ্র জলবায়ুতে; যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ করে মেইন ও আইডাহোতে (Maine and Idaho)। ইউরোপের সর্বাধিক আলু উৎপাদনকারী দেশগুলি হচ্ছে জার্মানি, রাশিয়া, হল্যান্ড ও পোল্যান্ড।

আলু ও আলুগাছ সৌজন্য: এসএম সায়েম

ভারতীয় উপমহাদেশে কখন আলু চাষ শুরু হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না। ধারণা করা হয় যে, সতেরো শতকের গোড়ার দিকে পর্তুগিজ নাবিকরা ভারতে প্রথম আলু নিয়ে আসে। ১৮৪৭ সালে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত The Gardening Monthly ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যায় ভারতে আলু চাষ সম্পর্কে প্রথম রেকর্ড দেখা যায়। প্রথমদিকে আলুর চাষ হতো কলকাতার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে, সেখান থেকে আলু চাষের প্রবর্তন হয় চেরাপুঞ্জিতে। ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর থাকাকালীন সময়ে (১৭৭২-১৭৮৫), তাঁর উদ্যোগে আলুর চাষ বোম্বেসহ অনেক প্রদেশে বিস্তার লাভ করে। আলু একটি তৃণজাতীয়, বর্ষজীবী ফসল; সাধারণত দু থেকে তিনটি চোখবিশিষ্ট কন্দের রোপণ খন্ড দ্বারা বংশবিস্তার করা হয়। বীজ থেকে একই জাতের হুবহু বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদ পাওয়া যায় না। কান্ড সোজা বা ভূশায়ী, লিকলিকে, কাক্ষিক-শাখাযুক্ত বা শাখাবিহীন। জাতের ওপর নির্ভর করে কান্ড গোলাকার বা কৌণিক, লোমযুক্ত বা মৃসণ, সবুজ বা ঈষৎ রক্তবর্ণযুক্ত।

ফল গোলাকার, বাদামি-সবুজ বা রক্তবর্ণ, কিডনি আকৃতির বীজসহ সাধারণত ১২ থেকে ১৮ মিমি ব্যাসবিশিষ্ট। জাত, মাটি, আবহাওয়া ও তাপমাত্রা এবং আলোক দিবসের ওপর ভিত্তি করে কন্দের আকার, আকৃতি ও বর্ণে প্রচুর পার্থক্য হয়। জনপ্রিয় জাতসমূহের কন্দ সাধারণত গোলাকার, ডিম্বাকার বা উপবৃত্তাকার (oblong) হয়ে থাকে। পুষ্টিগতভাবে কন্দ শ্বেতসার বা স্টার্চসমৃদ্ধ এবং প্রোটিন, ভিটামিন ‘সি’ ও ‘বি’, পটাশিয়াম, ফসফরাস ও আয়রণের একটি উত্তম উৎস। অধিকাংশ খনিজ ও আমিষ চামড়ার নিচে একটি পাতলা স্তরে ঘণীভূত হয় এবং চামড়া নিজেই খাদ্য অাঁশের উৎস।

জাতসমূহ  বিশ্বে কয়েকশত জাতের আলু চাষ হয়। এগুলির পার্থক্য বাহ্যিকরূপ, কন্দের গঠন, আকার ও বর্ণ, পরিপক্কতার সময়, রান্না ও বাজারজাতকরণ গুণাবলী, ফলন এবং রোগ ও পোকা-মাকড় প্রতিরোধ ক্ষমতায়। একটি এলাকার জন্য উপযোগী একটি জাত অন্য এলাকায় উপযোগী নাও হতে পারে। বাংলাদেশে চাষকৃত আলুর জাতসমূহকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়, স্থানীয় ও উচ্চফলনশীল (উফশী)। কথিত স্থানীয় জাতসমূহ প্রকৃতপক্ষে পুরোপুরি স্থানীয় নয়। দূর অতীতে সেগুলি উপমহাদেশের এ অংশে নিয়ে আসা হয় এবং জাত উন্নয়ন প্রচেষ্টার অনুপস্থিতিতে ধীরে ধীরে অবক্ষয়প্রাপ্তির ফলে নিম্নফলনশীল হয়ে পড়ে। নিম্নফলনশীল হওয়া সত্ত্বেও কিছু স্থানীয় জাত ভিন্ন স্বাদের জন্য এখনও চাষ করা হয়।

দেশের বিভিন্ন অংশে স্থানীয় আলুর প্রায় ২৭টি জাত আবাদ করা হয়। এগুলির পরিচিত স্থানীয় নাম রয়েছে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০৪-০৫ সালে প্রায় ১,৮৩,৪৪৬ একর জমিতে স্থানীয় জাতসমূহ চাষ করে ৫,৯৯,৫১৮ মে টন আলু উৎপাদন করা হয়। পরিচিত স্থানীয় জাতসমূহ হচ্ছে (ক) শীলবিলাতী- প্রধানত রংপুরে চাষ করা হয়। কন্দ আয়তাকার, লালচে। প্রতি কন্দের ওজন প্রায় ৩০ গ্রাম। (খ) লালশীল- প্রধানত বগুড়ায় চাষ করা হয়, কন্দ গোলাকৃতির, লালচে, প্রত্যেকটির ওজন হয় প্রায় ৫৫ গ্রাম। এ জাতটি লালমাদ্যা বা বোগরাই নামেও পরিচিত। (গ) লালপাকরী- দিনাজপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়, কন্দ লালচে, গোলাকার, প্রত্যেকটির ওজন হয় প্রায় ৩০ গ্রাম। (ঘ) দোহাজারী- প্রধানত চট্টগ্রাম এলাকায় চাষ করা হয়, গোলাকার ও ফ্যাকাসে, প্রত্যেকটির ওজন প্রায় ২৫ গ্রাম। অন্যান্য দেশি জাতগুলির মধ্যে ঝাউবিলাতী ও সূর্যমুখী উল্লেখযোগ্য।

গত কয়েক দশকে কয়েক ডজন উচ্চফলনশীল আলুর জাত বাংলাদেশে আনা হয় এবং সাধারণ চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত করার পূর্বে স্থানীয় পরিবেশে পরীক্ষামূলকভাবে যাচাই করা হয়। অতঃপর বেশকটি জাত চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত করা হয়। জাতগুলির ফলনশীলতার সুষ্ঠু মূল্যায়ন এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে বর্তমানে প্রায় ৩৬টি উফশী জাত চাষাবাদের জন্য দেশে অবমুক্ত করা হয়েছে। অবশ্য, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (BADC) কৃষকদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রতি বছর প্রায় ২০০ মে টন আলুবীজ আমদানি করে। উফশী জাতের বীজআলু উৎপাদনের জন্য  বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে একটি খামার প্রতিষ্ঠা করেছে। উচ্চফলনশীল জনপ্রিয় জাতসমূহের মধ্যে নিচের জাতগুলি উল্লেখযোগ্য (ক) কার্ডিনাল- আয়তাকার, লালচে কন্দ, অগভীর চোখ, চামড়া মসৃণ। জাতটি হল্যান্ড থেকে আনা হয়েছে। ফলনক্ষমতা হেক্টর প্রতি ২০-৩০ মে টন। (খ) ডায়ামেন্ট- হল্যান্ডের অন্য একটি জাত, ডিম্বাকার থেকে আয়তাকার, ফ্যাকাসে হলুদ কন্দ, চামড়া মৃসণ ও চোখ অগভীর। এটি মোটামুটি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন। হেক্টর প্রতি ফলন ২৫-৩০ মে টন। (গ) কুফরী সিন্দুরী- কন্দ লালচে, গোলাকার, চোখ গভীর, চামড়া খসখসে। ভারত থেকে জাতটি আনা হয়; রোগবালাইয়ের প্রতি তুলনামূলকভাবে কম সংবেদনশীল। তবে বর্তমানে জাতটির আবাদ কমে গেছে। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য উন্নত জাতসমূহের মধ্যে আছে প্যাট্রোনিস, মুলটা, হীরা, মরিন, ওরিগো, আইলসা, গ্রানুলা, ফেলসিনা, রাজা, ডুরা, এস্টারিক্স প্রভৃতি।

১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে BARI-এর কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র আন্তর্জাতিক আলু গবেষণা কেন্দ্র, পেরু ও অন্যান্য উৎস থেকে আলুর অনেক নতুন জাত সংগ্রহ করেছে। বাংলাদেশে এদের কোনোটি চাষাবাদের উপযোগী তা নির্ধারণের জন্য দেশের মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে। কিছু উচ্চফলনশীল আলুর জাত উদ্ভাবনে কেন্দ্রটি ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ২০০৪-০৫ সালে ৬,২২,৮২৮ একর জমিতে উচ্চফলনশীল আলুর চাষ করে ৪২,৫৫,৮৬৩ মে টন আলু উৎপাদন সম্ভব হয়।

চাষাবাদ  শীতকালে বাংলাদেশের সবগুলি জেলায় ব্যাপকভাবে আলু চাষ করা হয়। মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতাসহ ভালভাবে সার প্রয়োগকৃত রৌদ্রোজ্জ্বল জমি আলু লাগানোর জন্য যথোপযুক্ত। উপযুক্ত সময় হচ্ছে নভেম্বরের প্রথম পক্ষ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু স্থানে কৃষকগণ আগাম ফসল তোলার জন্য অক্টোবরে আলু লাগায়। প্রকৃতপক্ষে, দেশের চাষকৃত আলুর পুরোটাই হাতে লাগানো হয়। কৃষকগণ মাটির গুণাগুণ ও আলুর জাতের ওপর নির্ভর করে বীজকন্দ ও পাশাপাশি সারির দূরত্ব নির্ধারণ করে। সারির দূরত্ব সচরাচর ৪৫ থেকে ৬০ সেমি। রোপণের আদর্শ গভীরতা মাটির তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, রোপণের পরবর্তী সময়ের সম্ভাব্য আবহাওয়া এবং পরবর্তী সময়ে মাঠ পরিচর্যা পরিচালনার ধরনের ওপর নির্ভর করে। রোপণ অগভীর, মাত্র প্রায় ৫ সেমি হলে কর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে মাটি ক্রমান্বয়ে সারির উপরে তুলে দিতে হয়। এতে সূর্যালোক ও  কীটপতঙ্গ, রোগবালাই থেকে রক্ষা করতে বর্ধনশীল কন্দসমূহকে মাটি দিয়ে ভালভাবে ঢেকে দেওয়া নিশ্চিত হয়। মৃত্তিকার আর্দ্রতা সংরক্ষণ ও আগাছার বৃদ্ধি রোধ করতে সারির উপরে কচুরিপানা, খড় প্রভৃতি দিয়ে প্রায়শই মালচিং করা হয়।

গাছের অধিকতর বৃদ্ধি ও কন্দের অধিকতর ফলনের জন্য সুষম সার ও সেচ প্রয়োগ প্রায়ই প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সার প্রয়োগের পরিমাণ ও মাত্রা এবং সেচের বণ্টন নির্ধারিত হয় মৃত্তিকার গুণাগুণ এবং বিরাজমান আবহাওয়ার ওপর। কন্দের সন্তোষজনক উৎপাদনের জন্য আগাছা পরিষ্কার ও কীটপতঙ্গ রোগবালাইয়ের জন্য উদ্ভিদ সংরক্ষণ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য কৃষিতাত্ত্বিক পরিচর্যা অনুসরণ করতে হয়।

উৎপাদন  আলুগাছ পরিপক্ক ও কন্দ পুরোপুরি গঠিত হলে পাতাগুলি ধীরে ধীরে হলদে ও পরে বাদামি রঙের হয়ে যায়, এবং পরিশেষে মারা যায়। মাঠে এসব লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর ফসল উত্তোলন করাই উত্তম। এদেশে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে অধিকাংশ জাতের ফসল তোলা হয়। বাংলাদেশে কোদাল বা অন্যান্য হাতিয়ার ব্যবহার করে সাধারণত হাতে কন্দ সংগ্রহ করা হয়।

কাঁচা উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্যগুলির মধ্যে আলু প্রথম স্থানে রয়েছে। এটি বিশ্বের প্রায় সকল দেশে জন্মে। ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডাসহ বিশ্বের অনেক দেশে আলু প্রধান খাদ্য। সারা পৃথিবীর আলু ফসলের প্রায় ৯০% জন্মে ইউরোপে। মাত্র গত ২-৩ দশকে উচ্চফলনশীল জাতসমূহের চাষের ফলে বাংলাদেশে আলু উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ চমৎকার হলেও প্রত্যাশিত বাজারজাতকরণের অভাবে কৃষকগণ সাধারণত অধিক আলু উৎপাদনে উৎসাহী নয়। মোট উৎপাদনের একেবারে নগণ্য অংশ রপ্তানি করা হয়, অন্যদিকে বীজআলুর বিরাট পরিমাণ এখনও আমদানি করা হয়।

২০০৫-০৬ সালে দেশে মোট আলু উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪১,৬১,০০০ মে টন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানা যায় ২০০৭-০৮ সালে দেশে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মোট উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৮২ লক্ষ মে টন। অধিকাংশ প্রান্তিক চাষী আলু, বিশেষ করে স্থানীয় জাতসমূহ ঘরে দেশিয় পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে থাকে। এতে পানি অপসারণ, বালাই ও রোগজীবাণুর আক্রমণের ফলে ব্যাপক ক্ষতি হয়। দেশে প্রায় ২২,০০,০০০ মে টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ২৩৪টি হিমাগার রয়েছে। উৎপাদিত বাকি আলু দেশিয় পদ্ধতিতে নিজস্ব খামার বা কৃষকের বসতবাড়িতে সংরক্ষণ করা হয়।

বীজআলুর উৎপাদন বাংলাদেশে প্রায় ৮,০৬,২৯৪ একরে আলুর চাষ হয়। এজন্য প্রয়োজন প্রায় ৩,৫০,০০০ মে টন বীজ আলুর। ব্যবহূত বীজের অধিকাংশই উচ্চমানসম্পন্ন নয়। কৃষকরা সাধারণত তাদের খাবারের জন্য রাখা আলু বীজ হিসেবে ব্যবহার করে। এতে পরের মৌসুমে নিম্ন ফলন হয়।

সাধারণত দু’ধরনের আলুবীজ সরকার আমদানি করে, একটি ভিত্তি (foundation) বা মৌলবীজ বলে অভিহিত এবং অন্যটি প্রত্যায়িত (certified) বীজ। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন নিজস্ব খামারে বা চুক্তিভিত্তিক কৃষকদের জমিতে আমদানিকৃত ভিত্তিবীজ থেকে উৎপাদিত প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনকারীদের মধ্যে বিতরণ করে। সরাসরি আমদানিকৃত বীজও স্থানীয় BADC অফিসের মাধ্যমে কৃষকদের নিকট বিক্রয় করা হয়। কৃষকদের মধ্যে উচ্চফলনশীল বীজআলু সহজপ্রাপ্য করতে BARI এখন তার নিজস্ব দেবীগঞ্জ খামারে প্রজনন বীজ উৎপাদন করে BADC-সহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিকট সরবরাহ করছে।

ব্যবহার বাংলাদেশে আলু প্রধানত সবজি হিসেবে ব্যবহূত হয়, যদিও বিশ্বের অনেক দেশে এটি প্রধান খাদ্য এবং শ্বেতসার খাদ্য উৎসের ৯০% এর অধিক অবদান রাখছে। ইউরোপে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টন আলু প্রক্রিয়াজাত করে স্টার্চ, এলকোহল, পটেটো মিল (potato meal), ময়দা, ডেক্সট্রোজ ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরি হচ্ছে। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পট্যাটো চিপস, শুষ্ক চটকানো আলু (dehydrated mashed potatoes), ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস্ (French fries) এবং টিনজাত আলুও (canned potatoes) পাওয়া যায়। নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিপুল পরিমাণ আলু উৎপাদন করা হয়, বিশেষ করে এলকোহল, স্টার্চ, পটেটো মিল বা ময়দা ও পশুখাদ্য তৈরির জন্য। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার চেয়ে ইউরোপীয় দেশসমূহে মানুষের খাবার হিসেবে অনেক বেশি পরিমাণে আলু ব্যবহূত হয়। এশীয় দেশসমূহে শ্বেতসার জাতীয় খাদ্য হিসেবে আলুর চেয়ে দানাজাতীয় খাদশস্য অধিক ব্যবহূত হয়।

বাংলাদেশে আলুর প্রধান ব্যবহার  মাছ, মাংস ও ডিমের সঙ্গে সবজিরূপে হলেও আলু গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি বিরাট বৈচিত্র্য রয়েছে। আলু থেকে তৈরি উল্লেখযোগ্য খাদ্যসামগ্রী হচ্ছে সিদ্ধ আলু, ভাজা আলু, চটকানো আলু, আলুর রুটি (baked potato), আলুর চপ, আলুর সবজি মিশ্রণ, আলু সিঙ্গারা, আলু চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই প্রভৃতি। সম্প্রতি দেশের বেকারি ও ফাস্টফুডের দোকানগুলি আলু দিয়ে নানা রকম সুস্বাদু খাবার তৈরি শুরু করেছে।

ক্ষতিকর  পোকামাকড়  আলুগাছ বহু কীটপতঙ্গ, মাইট ও নিমাটোড দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং অনুকূল অবস্থায় এগুলি মাঠের ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে পারে। সর্বাধিক ক্ষতিকারক পোকাগুলির মধ্যে কাটুইপোকা (cutworm), উড়চুঙ্গা, পাতা ফড়িং, আলুর টিউবার মথ, জাবপোকা, বিটল অন্যতম।

কাটুইপোকা (Agrotis ypsilon) রাতে আলুর চারাগাছ মাটির ঠিক উপরিভাগে কেটে কচি কান্ড ও পাতা খায়। C-আকৃতির লার্ভা দিনের বেলায় মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে। বয়স্ক মথ প্রায়ই মাঠে উড়তে দেখা যায়। উড়চুঙ্গা (Field cricket), Brachytrypes portentosus কাটুইপোকার মতোই ক্ষতিসাধন করে। এরা চারাগাছের গোড়া বা মূল কেটে দেয়। বিভিন্ন প্রজাতির পাতাফড়িং আলু গাছ আক্রমণ করে। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে Empoasca devastans (Cicadellidae, Homoptera)। বয়স্ক পোকা ও নিম্ফ উভয়ে একাধারে পাতার রস চুষে নেওয়ার ফলে পাতা কুঁচকে শুকিয়ে যায়। ব্যাপক আক্রমণ থেকে ‘হপার-বার্ন’ সৃষ্টি হতে পারে। এসব পতঙ্গ ভাইরাস রোগও সংক্রমণ করে। জাবপোকা Myzus persicaeApis gossypii (Aphididae, Homoptera) সম্ভবত আলুর সবচেয়ে মারাত্মক আপদ। বয়স্ক ও অপরিণত পোকা উভয়ে পাতা থেকে রস চুয়ে খায়, ফলে পাতা নীচের দিকে কুচকে যায়। অনুকূল পরিবেশে তাদের সংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। খাদ্যগ্রহণ ক্ষতি ছাড়াও জাবপোকা আলুর ভাইরাস রোগসমূহ ছড়ায় বলে জানা যায় যা উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

আলুর টিউবার মথ বা সুতলি পোকা, Phthorimaea operculella (Gelechiidae, Lepidoptera) আলুর আরেকটি মারাত্মক বালাই। শুঁয়াপোকা পাতা ও কান্ডে ছিদ্র করে এবং পরে আলুকে আক্রমণ করে। আলুকে অরক্ষিত অবস্থায় রাখা হলে গুদামে এদের আক্রমণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছয়। এর আক্রমণে অনেক সময় শতকরা ৮০ ভাগ আলু নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দেশিয় জাতগুলির মধ্যে লাল পাকরি বা বগুড়াজাতের আলু এ মথ দ্বারা সহজে আক্রান্ত হয়।

রোগবালাই আলু বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয় যেগুলিকে রোগজীবাণু অনুযায়ী শ্রেণিভুক্ত করা হয়, যেমন  ভাইরাসব্যাকটেরিয়াছত্রাক ও  নিমাটোড আক্রমণজনিত রোগ। পরিবেশগত উপাদান বা শারীরতত্ত্বীয় ঘাটতিজনিত কারণে কিছু রোগও পরিলক্ষিত হয়। ভাইরাসজনিত রোগসমূহের মধ্যে মাইল্ড মোজাইক, রুগোজ মোজাইক ও পাতামোড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। মোজাইক রোগের লক্ষণসমূহের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বর্ণ ও আকারের ছাপছাপ দাগ, নেক্রোসিস (অংশবিশেষ মরে গিয়ে কালো বা মেটে বর্ণ ধারণ) ও পাতা কোঁকড়ানো।

এদেশে আলুর উল্লেখযোগ্য ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগসমূহের মধ্যে রয়েছে ব্ল্যাকলেগ, ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট ও দাদ রোগ। ব্ল্যাকলেগ হয় Erwinia atroseptica দ্বারা, যা বর্ধনশীল গাছ ও গুদামের আলুকে আক্রমণ করে; এতে কান্ডের গোড়া কুঞ্চিত ও কালো হয়ে যায় বলে এ ধরনের নাম দেওয়া হয়।

বাদামি পচা রোগ হয় Ralstonia solanacearum দ্বারা; পাতা নেতিয়ে পড়ে, ব্রোঞ্জ রং ধারণ করে কুঞ্চিত হয় এবং মারা যায়। এ ছাড়া Streptomyces scabies দ্বারা আলুর দাদ রোগ হয় এবং তাতে আলুর গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়।

আলুর গুরুত্বপূর্ণ ছত্রাক রোগসমূহ হচ্ছে নাবিধ্বসা (late blight), আগাম ধ্বসা (early blight), কালো দাগ (black scurf) ও কান্ডপচা। আলুর রোগসমূহের মধ্যে নাবিধ্বসা সবচেয়ে মারাত্মক ও মহামারী রোগ। পরজীবী ছত্রাক Phytopthora infestans এ রোগের কারণ। রোগের প্রাথমিক লক্ষণসমূহ হচ্ছে গাছের উপরের যে কোনো অংশে, প্রধানত পাতায় বাদামি থেকে কালো দাগ।

আগাম ধ্বসা Alternaria solani দ্বারা সৃষ্ট, বাংলাদেশে আলুর আরেকটি মারাত্মক রোগ। প্রাথমিক অবস্থায় পাতায় গাঢ় বাদামি থেকে কালো দাগ দেখা যায়। দাগসমূহ সাধারণত বিভিন্ন আকৃতির, অনেকক্ষেত্রে কয়েকটি দাগ একত্র হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করার ফলে পাতা ঝলসে যায়। কালো দাগ (black scurf) রোগ সাধারণত খুব মারাত্মক না হলেও মাঝে মাঝে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি সাধন করে। এ রোগ Rhizoctonia solanij এর আক্রমণে হয়ে থাকে এবং তাতে আলুর উপরে অত্যন্ত সুস্পষ্ট বাদামি থেকে কালো দাগ দেখা যায়।

আলুর রোগ প্রতিরোধ বা রোগের প্রাদুর্ভাব হ্রাস করার সর্বোচ্চ পন্থা হচ্ছে রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা। রোপণের পূর্বে বীজআলু অবশ্যই ভালভাবে পরীক্ষা করতে হয় এবং প্রয়োজনে সুপারিশকৃত রাসায়নিকসমূহে ডুবিয়ে বীজকে শোধন করতে হয়।  [এস এম হুমায়ুন কবির, জিপি দাস এবং আবুল খায়ের]