আত্মহত্যা

আত্মহত্যা স্বেচ্ছায় নিজেকে নিধন করা। কতিপয় সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণের অভিপ্রায় দেশপ্রেম বা ধর্মীয় বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে বীরত্বব্যঞ্জক সামরিক মৃত্যু কিংবা আত্মঘাতী বোমা মারার মতো ঘটনার সঙ্গে সবসময় তুলনীয় নয়। কার্যকারণসূত্রে আত্মহত্যাকে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়, যেমন পরার্থী, অহংবাদী ও নৈরাজ্যমূলক। পরার্থী আত্মহত্যাকারী নিজের জীবন বিসর্জনের জন্য কিছু সামাজিক আদর্শ ও উদ্দেশ্য দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়। আদর্শ এবং তজ্জাত আবেগ আত্মদানকে করে স্বতস্ফূর্ত। কোনো কোনো গোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস পরলোকে চিরসুখ লাভের জন্য ব্যক্তিগতভাবে বা দলবদ্ধভাবে আত্মনিধনের মাধ্যমে জীবন বির্সজনের দীক্ষা দেয়। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য সমাজে তেমনি দলবদ্ধভাবে বহু আত্মহত্যার ঘটনা দেখা যায়। কিন্তু অহংবাদী আত্মহত্যায় ব্যক্তিমানুষ সমাজের ভেতরে পর্যাপ্ত সংহতি এবং আত্মহত্যা ঠেকাতে পারে এমন সংঘবদ্ধ শক্তির অভাবে কষ্ট পেয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়। নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যার উদ্ভব ঘটে সমাজের আদর্শহীনতা থেকে যেখানে ব্যক্তির ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা পরিপূরণের উপায়গুলি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

১৮২৯ সালে ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক নিষিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত সহমরণ অর্থাৎ স্বামীর চিতায় হিন্দু বিধবার বলিদান ভারতে বহু শতবর্ষ কালব্যাপী একটি ধর্মীয় প্রথা ছিল। প্রাচীন হিন্দু সমাজে বৈধব্য নারীর জন্য প্রত্যক্ষ দুর্যোগ হিসেবে বিবেচিত ছিল, কারণ তার জন্য পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। তাকে অর্ধভুক্ত থেকে কৃশকায় থাকতে হতো ও স্বামীর পুণ্যস্মৃতি লালন এবং স্বামীর আত্মার শান্তির জন্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতে হতো। ধর্মশাস্ত্রে সহমরণকে বৈধব্যের বিকল্পরূপে বিধান দেওয়া হয়েছে। জাপানে হারাকিরি আরেক আনুষ্ঠানিক আত্মহত্যা যাতে ছুরি দিয়ে উদর চিরে ফেলা হয়। মর্যাদাহানি বা মৃত্যুদন্ড হলে যোদ্ধাশ্রেণীর ব্যক্তিরা এরকম করত। তবে কখনও আত্মহত্যাকারীর বীভৎস আচরণ সমাজের সমর্থন পায়নি। অধিকাংশ বিশ্বধর্ম কোনো কিছুর প্রতিকারের উপায় হিসেবে আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না। হিন্দুধর্মও কেবল সহমরণ ব্যতীত আত্মহত্যাকে ভয়ঙ্কর পাপ হিসেবে গণ্য করে। ইসলাম ধর্মের মতে যে ব্যক্তি তার নিজের জীবন হনন করে সে আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায়। সে ব্যক্তি আত্মার মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় দাফনকাফনের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা পেতে পারে না। আইনে আত্মহত্যা একটি অপরাধজনক কাজ এবং তা শাস্তিযোগ্য।

সঠিক পরিসংখ্যান নেই বলে বাংলাদেশে আত্মহত্যার ঘটনার বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ অসুবিধাজনক। এখানে আত্মহত্যার ঘটনার সংখ্যা দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির মতোই অনেক বেশি। পুলিশ কিংবা সংবাদপত্র সব আত্মহত্যার ঘটনা (বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের) অবহিত হয় না প্রধানত আইনগত ঝামেলা এবং পুলিশ ও আইনজীবীদের অত্যাচার এড়ানোর কারণে। বাংলাদেশের যুবতী মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে  যৌতুকএর টাকা না দেওয়ার জন্য স্বামীর বাড়িতে নিপীড়ন, ধর্ষণের জন্য সামাজিক লজ্জা, বিয়ের আগে গর্ভধারণ, স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতা, তালাক এবং সন্তান জন্মদানে অক্ষমতার কারণে। আত্মহত্যার অন্যান্য সাধারণ কারণ হলো চরম দারিদ্রে্যর জন্য ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণে অক্ষমতা, পরীক্ষা পাসের ব্যর্থতা এবং দীর্ঘকাল রোগযন্ত্রণা।  দারিদ্র্যজনিত আত্মহত্যা সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, ভিক্ষার অবশ্যম্ভাবিতা, অথবা তরুণী মেয়েদের পতিতালয়ে গমনের দিকটিই নির্দেশ করে। সাধারণত আত্মহত্যা করা হয় অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি বা কীটনাশক খেয়ে, সিলিংফ্যান বা কড়িকাঠে গলায় ফাঁস দিয়ে, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে, ধাবমান যানবাহন বা চলন্ত ট্রেনের সামনে পড়ে এবং পানিতে ডুবে।

বাংলাদেশে সরকারিভাবে আত্মহত্যার কোনো পরিসংখ্যান রাখা হয় না। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান ব্যুরো বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন জনবহুল দেশে আত্মহত্যার একটি অনুমিত পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায় যে, ২০০৪ সালে বাংলাদেশে আনুমানিক ১৫,১৭২ জন আত্মহত্যা করেছে। তবে এই সংখ্যা একটি অনুমিত পরিসংখ্যান মাত্র। আরেক হিসাবে দেখা যায় যে, ১৪ ও ১৭ বছর বয়সী তরুণীরা সাধারণত ছেলেদের তুলনায় বেশি আত্মহত্যা করে অথবা আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ হেলথ ইনজুরি-এর ২০০৫ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২,২০০ তরুণতরুণী আত্মহত্যা করে। অর্থ্যাৎ প্রতিদিন প্রায় ৬ জন। এসব পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি আত্মহত্যা করে। ২০১০ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রায় ৬.৫ মিলিয়ন মানুষ আত্মহত্যা প্রবণ। প্রতিবছর এক লক্ষ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ১২৮.৮ জন আত্মহত্যা করে। এদের মধ্যে ৮৯% নারী। ২০১১ সালের এপ্রিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী ১৯,৬৯৭ জন বাংলাদেশে আত্মহত্যা করে করেছে যা মোট মৃত্যুর মধ্যে ২.০৬%।   [এনামুল হক]