আকবর

আকবর (১৫৫৬-১৬০৫)  পিতা হুমায়ুনের আকস্মিক মৃত্যুর পর মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে মুগল সিংহাসনে আরোহণ করেন। একজন বিজয়ী বীর, প্রশাসক ও শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য মহামতি আকবর তাঁর সমসাময়িক বিখ্যাত শাসকদের মধ্যে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন।

আকবর

আকবরের সিংহাসন আরোহণের পরপরই আগ্রা ও দিল্লি আদিল শাহ শূরের সেনাপতি হিমুর অধিকারে চলে যায়। রাজা বিক্রমজিৎ উপাধি গ্রহণ করার পর হিমু আকবর এবং বৈরাম খানের মোকাবেলা করতে অগ্রসর হন। নিষ্পত্তিমূলক পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমু আহত ও বন্দি হন এবং পরবর্তীকালে নিহত হন। আগ্রা ও দিল্লি দখলের মাধ্যমে মুগল শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠিতা ঘটে।

আকবর সিংহাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রবৃত্ত হন। সিংহাসনে আরোহণের সময় তিনি কোনো নির্দিষ্ট ভূখন্ডের অধিপতি ছিলেন বলে মনে হয় না। ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর সময় আকবরের বিশাল সাম্রাজ্য কাবুল থেকে বাংলা এবং হিমালয় থেকে আহমেদনগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম এবং দাক্ষিণাত্যে তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে।

আকবরের রাজত্বকালে বাংলায় মুগল রাজত্বের প্রসার ঘটে। বাংলার সুলতান দাউদ কররানীর বিরুদ্ধে আকবর মুনিম খানকে বাংলা অভিযানে প্রেরণ করেন। দাউদ পালিয়ে যান এবং মুগলদের হাতে পাটনার পতন ঘটে। পরবর্তীকালে মুনিম খান দাউদের রাজধানী  তান্ডা অধিকার করেন। এতদসত্ত্বেও উড়িষ্যায় দাউদ মুগল-বিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। আফগানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য টোডরমল এসে মুনিম খানের সঙ্গে যোগ দেন। ১৫৭৫ সালে তুকারয়-এর যুদ্ধে দাউদ পুনরায় পরাজিত হন। ইতোমধ্যে মুনিম খানের মৃত্যু হয় এবং খান জাহান হুসেন কুলী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে হুসেন কুলী কর্তৃক দাউদ চূড়ান্তভাবে পরাজিত ও নিহত হন। দৃশ্যত বাংলা মুগলদের অধিকারে আসে।

ঈসা খানের নেতৃত্বে বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিত বাংলার শক্তিশালী জমিদারগণ মুগল কর্তৃত্ব অস্বীকার করে বাংলায় তাঁদের স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এঁদের আনুগত্য লাভের উদ্দেশ্যে আকবর তাঁর বেশকিছু সময় বারো ভুঁইয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। তিনি খান জাহান হুসেন কুলী (১৫৭৫-১৫৭৮), শাহবাজ খান (১৫৮০-১৫৮৫), ওয়াজির খান (১৫৮৬-১৫৮৭) এবং রাজা মানসিংহকে (১৫৯৪-১৬০৪) তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে বাংলায় প্রেরণ করেন। তাঁরা ঈসা খান ও তাঁর মিত্রদেরকে মুগল নিয়ন্ত্রণাধীনে আনার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ঈসা খান সন্ধির মাধ্যমে মুগলদের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেন।

সম্রাট আকবর ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রশাসনকে পুনর্বিন্যস্ত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তিনি একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেন এবং তাঁর সাম্রাজ্যকে ১২টি (পরবর্তীকালে ১৫টি) সুবাহ-য় বিভক্ত করেন। তাঁর প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় সরকারের কাঠামো অনুসরণ করে। আকবরের সাম্রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ  সুবাহ ছিল বাংলা। আবুল ফজলের তথ্যানুসারে, বাংলা ১৯টি সরকারে এবং প্রত্যেকটি সরকার আবার কতগুলি পরগণায় বিভক্ত ছিল। আকবর জাবতি প্রথা নামে একটি রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এর মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে ভূমি জরিপ, শ্রেণিকরণ এবং সরকারকে একটি নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এ ব্যবস্থা বাংলায় প্রবর্তিত হয় নি এবং  মুর্শিদকুলী খান এর পূর্বপর্যন্ত বাংলা সুবাহ-র রাজস্ব ব্যবস্থা একটি সুষ্ঠু রূপ পরিগ্রহ করে নি। মনসবদারি পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে আকবর তাঁর সামরিক বাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। এ ব্যবস্থাধীনে প্রত্যেক কর্মকর্তাই মনসব বা পদমর্যাদার অধিকারী ছিলেন এবং প্রত্যেককে নির্দিষ্টসংখ্যক ঘোড়া, হাতি, ভারবাহী পশু এবং শকট রাখতে হতো। নগদ অর্থ বা ভূমি অনুদানের মাধ্যমে তাদের ভাতা প্রদান করা হতো।

আকবরের দ্বীন-ই-ইলাহী  বাংলার জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। পন্ডিতদের মতে, আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক। আকবরের রাজত্বকালে শিল্প ও স্থাপত্যের বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়। বাংলার শহরগুলির মধ্যে রাজমহল (যার নামকরণ করা হয়েছিল ‘আকবরনগর’) এবং হুগলিতে তাঁর সময়ে নির্মিত হয় বেশ কিছু সুরম্য অট্টালিকা।  [কে.এম করিম]