অবহট্ঠ
অবহট্ঠ অপভ্রংশ ভাষার পরবর্তী স্তর। অপভ্রংশ হচ্ছে মধ্যভারতীয় আর্যভাষা পালি-প্রাকৃতের শেষস্তর এবং তার শেষ পরিণতি অবহট্ঠ। এ অবহট্ঠ ভাষা থেকেই নব্য ভারতীয় আর্যভাষাসমূহের উৎপত্তি। যেমন বাংলা ভাষা পূর্বভারতীয় মাগধী অবহট্ঠের পরিণত রূপ। বাংলা ভাষার উৎপত্তির ক্রমটি এরূপ: মাগধী প্রাকৃত > মাগধী অপভ্রংশ > মাগধী অবহট্ঠ > বাংলা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর মতে গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে বাংলার উৎপত্তি অর্থাৎ গৌড়ীয় প্রাকৃত > গৌড়ীয় অপভ্রংশ > গৌড়ীয় অবহট্ঠ > বাংলা। অবহট্ঠ ভাষার প্রচলন ছিল খ্রিস্টিয় ছয় থেকে পনেরো শতক পর্যন্ত।
অবহট্ঠ ভাষার কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পদের বিভক্তি, বচন ও লিঙ্গভেদের লোপ, হ্রস্বস্বর ব্যবহারের আধিক্য, পদান্তে বা পদমধ্যে সানুনাসিকতার উদ্ভব, স-স্থলে হ-এর ব্যবহার ইত্যাদি। এ ভাষার প্রথম রচনা বৌদ্ধ তান্ত্রিক ও শৈব যোগীদের লেখা দোহাকোষ। এটি ‘দোহা’ নামক কতগুলি প্রকীর্ণ কবিতার সংকলন। সরহপা, কাহ্নপা প্রমুখ যোগী এগুলির রচয়িতা। এতে নীতি ও অধ্যাত্মজ্ঞানের কথা বর্ণিত হয়েছে। বাঙালি কবিদের পাশাপাশি অনেক অবাঙালি কবিও অবহট্ঠ ভাষায় দোহা রচনা করেছেন। ডাকার্ণব গ্রন্থটিও অবহট্ঠ ভাষায় রচিত।
অবহট্ঠ ভাষায় সাধারণ সাহিত্যও রচিত হয়েছে। দশ শতকে বাংলা ভাষার উদ্ভবযুগে বাংলার সঙ্গে এর প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হয়। তাই সে সময় অনেকেই বাংলায় চর্যাপদ এবং অবহট্ঠে দোহা রচনা করেন। অর্থাৎ অবহট্ঠের সঙ্গে সমসাময়িক অন্যান্য ভাষার সংমিশ্রণে একটি মিশ্র ভাষারীতির প্রচলন ছিল কিছুকাল। এভাবে অবহট্ঠ ভাষার চর্চা পনেরো শতক পর্যন্ত বহমান ছিল। আনুমানিক পনেরো শতকে রচিত প্রাকৃতপৈঙ্গল-এর অধিকাংশ শ্লোক অবহট্ঠে রচিত। অবহট্ঠ ভাষার শেষ উল্লেখযোগ্য কবি ছিলেন বিদ্যাপতি (১৫শ শতক)। তাঁর জীবনীকাব্য কীর্তিলতা গদ্যেপদ্যে অবহট্ঠ ভাষায় রচিত। এ ছাড়া শুভঙ্করের আর্যা নামে সাধারণ জ্ঞানবিষয়ক কিছু শ্লোক বাংলায় আধুনিক কাল পর্যন্ত চলে এসেছে, যেমন গণিতবিষয়ক একটি শ্লোক হচ্ছে: ‘কুড়বা কুড়বা কুড়বা লিজ্জে। কাঠায় কুড়বা কাঠায় লিজ্জে\’ এর মূল রূপটি ‘কুডবেঁ কুডবেঁ কুডবেঁ লিজ্জই। কট্ঠাএঁ কুডব কট্ঠাএঁ লিজ্জই\’ এরূপ ছিল বলে গবেষকদের ধারণা। আধুনিক বাংলায় এটি দাঁড়ায় ‘কুড়ায় কুড়া কুড়ায় নিয়ে। কাঠায় কুড়া কাঠায় নিয়ে\’ এরূপ। [দুলাল ভৌমিক]