হোসেন, আবুল বাশার মোশারফ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

("'''হোসেন, আবুল বাশার মোশারফ''' (১৯৩৪-২০২০) এ.বি.এম হোসেন নামেই..." দিয়ে পাতা তৈরি)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
৪ নং লাইন: ৪ নং লাইন:
এ.বি.এম হোসেন ১৯৩৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বারের (বর্তমানে উপজেলা) ধামতী গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নাম আবদুর রহমান সরকার এবং মাতা বেগম আজিজুন্নেছা সরকার। এ.বি.এম হোসেন দেবিদ্বার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিকুল্যাশন এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯৫১ সালে প্রথম বিভাগে (সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১০ম স্থান) ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে ১৯৫৪ সালে সম্মানসহ বি.এ এবং ১৯৫৫ সালে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এ উভয় পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। [[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়|ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]] থেকে এম.এ ডিগ্রি লাভের পর এ.বি.এম হোসেন তৎকালীন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মেধাবৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান। ১৯৫৮ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাস বিষয়ে বি এ সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি বি এ সম্মান শ্রেণির ৪ বছরের ডিগ্রি দু’বছরে সম্পন্ন করে অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এ.বি.এম হোসেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS)-এ ‘History and Archaeology of Fathpur-Sikri’ বিষয়ে গবেষণা করে ১৯৬০ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর পিএইচডি গবেষণার তত্ত্ববধায়ক ছিলেন বিশ্বখ্যাত শিল্পকলা বিশারদ অধ্যাপক ডি.এস.রাইস এবং কে.বি.ডি কডরিংটন। তাঁর পিএইচ.ডি অভিসর্ন্দভটি পরবর্তীতে পরিমার্জিত রূপে ''Fatehpu-Sikri and its Architecture'' শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।  
এ.বি.এম হোসেন ১৯৩৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বারের (বর্তমানে উপজেলা) ধামতী গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নাম আবদুর রহমান সরকার এবং মাতা বেগম আজিজুন্নেছা সরকার। এ.বি.এম হোসেন দেবিদ্বার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিকুল্যাশন এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯৫১ সালে প্রথম বিভাগে (সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১০ম স্থান) ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে ১৯৫৪ সালে সম্মানসহ বি.এ এবং ১৯৫৫ সালে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এ উভয় পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। [[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়|ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]] থেকে এম.এ ডিগ্রি লাভের পর এ.বি.এম হোসেন তৎকালীন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মেধাবৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান। ১৯৫৮ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাস বিষয়ে বি এ সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি বি এ সম্মান শ্রেণির ৪ বছরের ডিগ্রি দু’বছরে সম্পন্ন করে অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এ.বি.এম হোসেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS)-এ ‘History and Archaeology of Fathpur-Sikri’ বিষয়ে গবেষণা করে ১৯৬০ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর পিএইচডি গবেষণার তত্ত্ববধায়ক ছিলেন বিশ্বখ্যাত শিল্পকলা বিশারদ অধ্যাপক ডি.এস.রাইস এবং কে.বি.ডি কডরিংটন। তাঁর পিএইচ.ডি অভিসর্ন্দভটি পরবর্তীতে পরিমার্জিত রূপে ''Fatehpu-Sikri and its Architecture'' শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।  


এ.বি.এম হোসেন একজন প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ ও শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬০ সালে [[রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়|রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]] ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে সিনিয়র লেকাচার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষকতা জীবনের সূচনা হয়। ১৯৭২ সালে তিনি এ বিভাগে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৯৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অধ্যাপনার পাশাপশি তিনি একাধিক মেয়াদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, কলা অনুষদের ডিন (১৯৭৮-৮০) এবং সিনেট সদস্য (১৯৭৪-১৯৮৩) সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৫-১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য ছিলেন। প্রফেসর হোসেন ১৯৭৩ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেন্দ্র রিচার্স মিউজিয়ামের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও প্রফেসর হোসেন দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬৫-১৯৬৬ সালে ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একস্ট্রা-মুর‌্যাাল ডিপার্টমেন্টে পাঠদানে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৩-১৯৮৮ সালে তিনি [[ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়|ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়]], কুষ্টিয়ার সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। এ.বি.এম হোসেনের পাণ্ডিত্য এবং শিক্ষক হিসেবে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে সম্মানজনক প্রফেসর ইমেরিটাস পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য যে, তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম প্রফেসর ইমেরিটাস।
এ.বি.এম হোসেন একজন প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ ও শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬০ সালে [[রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়|রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]] ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে সিনিয়র লেকাচার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষকতা জীবনের সূচনা হয়। ১৯৭২ সালে তিনি এ বিভাগে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৯৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অধ্যাপনার পাশাপশি তিনি একাধিক মেয়াদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, কলা অনুষদের ডিন (১৯৭৮-৮০) এবং সিনেট সদস্য (১৯৭৪-১৯৮৩) সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৫-১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য ছিলেন। প্রফেসর হোসেন ১৯৭৩ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেন্দ্র রিচার্স মিউজিয়ামের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও প্রফেসর হোসেন দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬৫-১৯৬৬ সালে ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একস্ট্রা-মুর‌্যাাল ডিপার্টমেন্টে পাঠদানে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৩-১৯৮৮ সালে তিনি [[ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়|ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়]], কুষ্টিয়ার সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। এ.বি.এম হোসেনের পাণ্ডিত্য এবং শিক্ষক হিসেবে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে সম্মানজনক প্রফেসর ইমেরিটাস পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য যে, তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম প্রফেসর ইমেরিটাস।


শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে মৌলিক ও অনন্য অবদানের জন্য এ.বি.এম হোসেন দেশে ও বিদেশে বহু সম্মাননা, পুরস্কার লাভ এবং বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৫৮ সালে গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে অনারারি ফেলো নির্বাচিত করে। তিনি ১৯৬১-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য এবং ১৯৬২-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান হিস্টরিক্যাল রেকর্ড এবং আর্কাইভস কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. হোসেন নাফিল্ড ফাউন্ডেশন ফেলো হিসেবে ১৯৬৪-৬৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্দো-মুসলিম স্থাপত্যের উপর গবেষণা করেন। তাঁর এ গবেষণাকর্মটি পরবর্তীতে ''The Manara in Indo-Muslim Architecture'' শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৭৮ সালে ইউনেস্কো ইন্টারন্যাশনাল ফেলো হিসেবে ভারত, ইরান ও তুরস্কে ইসলামি শিল্পকলা বিষয়ে গবেষণা কাজ করেন। এ.বি.এম হোসেন ১৯৮৬-১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আগা খান ফাউন্ডেশন ফর ইসলামিক আর্কিটেকচারের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সনে নরওয়েজিয়ান পার্লামেন্ট তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য গঠিত বোর্ডের একজন সদস্য মনোনীত করে। তিনি ১৯৭৫-১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে ১৯৮৫ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) পুরস্কার এবং ১৯৯৫ সালে রাজশাহী লেখক পরিষদ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৮৩ সালে তিনি আন্তর্জাতিক বায়োগ্রাফিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ফেলো এবং ১৯৮৮ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউটের গবেষণা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য মনোনীত হন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং ২০১০ সালে বাংলা একাডেমি প্রফেসর ইমেরিটাস এ.বি.এম হোসেনকে আজীবন ফেলো নির্বাচন করে সম্মানিত করে। Who's Who, শিকাগো (১৯৮০-১৯৮১), ক্যাম্ব্রিজ বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টারের ম্যান অব অ্যাচিভম্যান্ট, দ্যা ইন্টারন্যাশনাল বুক অব অনার (ফার্স্ট ওয়ার্লড এডিশন) এবং ডিকশনারি অব ইন্টারন্যাশনাল বায়োগ্রাফি (অস্টাদশ খণ্ড) ইত্যাদিতে এ.বি.এম হোসেনের জীবনী স্থান পেয়েছে।  
শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে মৌলিক ও অনন্য অবদানের জন্য এ.বি.এম হোসেন দেশে ও বিদেশে বহু সম্মাননা, পুরস্কার লাভ এবং বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৫৮ সালে গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে অনারারি ফেলো নির্বাচিত করে। তিনি ১৯৬১-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য এবং ১৯৬২-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান হিস্টরিক্যাল রেকর্ড এবং আর্কাইভস কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. হোসেন নাফিল্ড ফাউন্ডেশন ফেলো হিসেবে ১৯৬৪-৬৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্দো-মুসলিম স্থাপত্যের উপর গবেষণা করেন। তাঁর এ গবেষণাকর্মটি পরবর্তীতে ''The Manara in Indo-Muslim Architecture'' শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৭৮ সালে ইউনেস্কো ইন্টারন্যাশনাল ফেলো হিসেবে ভারত, ইরান ও তুরস্কে ইসলামি শিল্পকলা বিষয়ে গবেষণা কাজ করেন। এ.বি.এম হোসেন ১৯৮৬-১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আগা খান ফাউন্ডেশন ফর ইসলামিক আর্কিটেকচারের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সনে নরওয়েজিয়ান পার্লামেন্ট তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য গঠিত বোর্ডের একজন সদস্য মনোনীত করে। তিনি ১৯৭৫-১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে ১৯৮৫ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) পুরস্কার এবং ১৯৯৫ সালে রাজশাহী লেখক পরিষদ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৮৩ সালে তিনি আন্তর্জাতিক বায়োগ্রাফিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ফেলো এবং ১৯৮৮ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউটের গবেষণা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য মনোনীত হন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং ২০১০ সালে বাংলা একাডেমি প্রফেসর ইমেরিটাস এ.বি.এম হোসেনকে আজীবন ফেলো নির্বাচন করে সম্মানিত করে। Who's Who, শিকাগো (১৯৮০-১৯৮১), ক্যাম্ব্রিজ বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টারের ম্যান অব অ্যাচিভম্যান্ট, দ্যা ইন্টারন্যাশনাল বুক অব অনার (ফার্স্ট ওয়ার্লড এডিশন) এবং ডিকশনারি অব ইন্টারন্যাশনাল বায়োগ্রাফি (অস্টাদশ খণ্ড) ইত্যাদিতে এ.বি.এম হোসেনের জীবনী স্থান পেয়েছে।  
১০ নং লাইন: ১০ নং লাইন:
এ.বি.এম হোসেন দেশ এবং দেশের বাইরে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বহু সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে যোগদান করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৬৫ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ ভাইস-চ্যান্সেলরদের কনফারেন্সে, বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৮৪ সালে মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কায় অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) কনফারেন্সে এবং ১৯৮৫ সালে গ্রিসের এথেন্সে অনুষ্ঠিত মানবাধিকার কমিশনের সভায় একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। প্রফেসর হোসেন ১৯৮৫ সালে ভিআরএম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্মেলনের সভাপতি এবং ১৯৮৭ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের দ্বি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন এবং এর কর্ম-সংসদের বিভিন্ন পদে আসীন থেকে সংগঠনটির অগ্রযাত্রায় অবদান রাখেন। ইতিহাস পরিষদ ছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ইন্ডিয়ান হিস্টিরি কংগ্রেস এবং পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের জীবন সদস্য ছিলেন।  
এ.বি.এম হোসেন দেশ এবং দেশের বাইরে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বহু সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে যোগদান করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৬৫ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ ভাইস-চ্যান্সেলরদের কনফারেন্সে, বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৮৪ সালে মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কায় অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) কনফারেন্সে এবং ১৯৮৫ সালে গ্রিসের এথেন্সে অনুষ্ঠিত মানবাধিকার কমিশনের সভায় একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। প্রফেসর হোসেন ১৯৮৫ সালে ভিআরএম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্মেলনের সভাপতি এবং ১৯৮৭ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের দ্বি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন এবং এর কর্ম-সংসদের বিভিন্ন পদে আসীন থেকে সংগঠনটির অগ্রযাত্রায় অবদান রাখেন। ইতিহাস পরিষদ ছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ইন্ডিয়ান হিস্টিরি কংগ্রেস এবং পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের জীবন সদস্য ছিলেন।  


ইসলামি শিল্পকলাসহ ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ে দেশ-বিদেশের জার্নালে এ.বি.এম হোসেনের প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা শতাধিক। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ''বাংলাপিডিয়া- বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ''-এ তিনি বহুসংখ্যক ভুক্তির রচয়িতা। তিনি বাংলাপিডিয়া’র সম্পাদনা পরিষদের  সদস্য ছিলেন। ইতিহাস, শিল্পকলা ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ সংখ্যা ১৫টি। এর মধ্যে রয়েছে: ''An Introduction to the History of Muslim Culture'' (1958); ''Fatehpur Sikri and its Architecture'' (1970); ''The Manara in Indo-Muslim Architecture (1970); A Historical Survey of the Monuments and Sites in Bangladesh: vol.I Mainamati-Deva-Parbata; Vol.II Gawr-Lakhnawti and vol.III Sonargaon- Panam'' (1997); ''Architecture-A History Through the Age, vol.2 of the Cultural Survey of Bangladesh'' (2007); ''আরব স্থাপত্য'' (১৯৮৪); ''ইসলামী চিত্রকলা'' (২০০৪); ''মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস- অটোমান সাম্রাজ্য থেকে জাতিসত্ত্বা রাষ্ট্র'' (২০১১); ''পড়ন্ত বেলার গল্প'' (আত্মজীবনী) (২০১৫) এবং  ''ইতিহাস ও শিল্পকলা'' (২০১৬) ইত্যাদি। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস-অটোমান সাম্রাজ্য থেকে জাতিসত্তা রাষ্ট্র গ্রন্থটির জন্য তিনি ২০১১ সালে [[বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন|বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন]] পুরস্কারে ভূষিত হন ।  
ইসলামি শিল্পকলাসহ ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ে দেশ-বিদেশের জার্নালে এ.বি.এম হোসেনের প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা শতাধিক। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ''বাংলাপিডিয়া- বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ''-এ তিনি বহুসংখ্যক ভুক্তির রচয়িতা। তিনি বাংলাপিডিয়া’র সম্পাদনা পরিষদের  সদস্য ছিলেন। ইতিহাস, শিল্পকলা ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ সংখ্যা ১৫টি। এর মধ্যে রয়েছে: ''An Introduction to the History of Muslim Culture'' (1958); ''Fatehpur Sikri and its Architecture'' (1970); ''The Manara in Indo-Muslim Architecture (1970); ''A Historical Survey of the Monuments and Sites in Bangladesh'' (vol.I ''Mainamati-Deva-Parbata''; Vol.II ''Gawr-Lakhnawti'' and vol.III ''Sonargaon- Panam'' (1997); ''Architecture'', vol.2 of the Cultural Survey of Bangladesh Series (2007); ''আরব স্থাপত্য'' (১৯৮৪); ''ইসলামী চিত্রকলা'' (২০০৪); ''মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস- অটোমান সাম্রাজ্য থেকে জাতিসত্ত্বা রাষ্ট্র'' (২০১১); ''পড়ন্ত বেলার গল্প'' (আত্মজীবনী) (২০১৫) এবং  ''ইতিহাস ও শিল্পকলা'' (২০১৬) ইত্যাদি। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস-অটোমান সাম্রাজ্য থেকে জাতিসত্তা রাষ্ট্র গ্রন্থটির জন্য তিনি ২০১১ সালে [[বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন|বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন]] পুরস্কারে ভূষিত হন ।  


জাতীয় অধ্যাপক এ.বি.এম হোসেন একজন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তানের সরকারে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সপরিবারে দেশেই অবস্থান করেন। এ সময় একাধিকবার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোকেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে তাঁকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও ভীতি প্রদর্শন করে।
জাতীয় অধ্যাপক এ.বি.এম হোসেন একজন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তানের সরকারে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সপরিবারে দেশেই অবস্থান করেন। এ সময় একাধিকবার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোকেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে তাঁকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও ভীতি প্রদর্শন করে।

১৬:৫৭, ১২ জুলাই ২০২৩ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

হোসেন, আবুল বাশার মোশারফ (১৯৩৪-২০২০) এ.বি.এম হোসেন নামেই সমাধিক পরিচিত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস ও ইসলামি শিল্পকলা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত। ইসলামি শিল্পকলার ইতিহাস তাঁর নিবিড় গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল। তবে, মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস বিষয়েরও তিনি একজন অনুসন্ধানী গবেষক ছিলেন। এসব বিষয়ে মৌলিক গবেষণা ও রচনার জন্য একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেন।

আবুল বাশার মোশারফ হোসেন

এ.বি.এম হোসেন ১৯৩৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বারের (বর্তমানে উপজেলা) ধামতী গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নাম আবদুর রহমান সরকার এবং মাতা বেগম আজিজুন্নেছা সরকার। এ.বি.এম হোসেন দেবিদ্বার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিকুল্যাশন এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯৫১ সালে প্রথম বিভাগে (সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১০ম স্থান) ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে ১৯৫৪ সালে সম্মানসহ বি.এ এবং ১৯৫৫ সালে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এ উভয় পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রি লাভের পর এ.বি.এম হোসেন তৎকালীন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মেধাবৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান। ১৯৫৮ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাস বিষয়ে বি এ সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি বি এ সম্মান শ্রেণির ৪ বছরের ডিগ্রি দু’বছরে সম্পন্ন করে অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এ.বি.এম হোসেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS)-এ ‘History and Archaeology of Fathpur-Sikri’ বিষয়ে গবেষণা করে ১৯৬০ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর পিএইচডি গবেষণার তত্ত্ববধায়ক ছিলেন বিশ্বখ্যাত শিল্পকলা বিশারদ অধ্যাপক ডি.এস.রাইস এবং কে.বি.ডি কডরিংটন। তাঁর পিএইচ.ডি অভিসর্ন্দভটি পরবর্তীতে পরিমার্জিত রূপে Fatehpu-Sikri and its Architecture শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

এ.বি.এম হোসেন একজন প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ ও শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে সিনিয়র লেকাচার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষকতা জীবনের সূচনা হয়। ১৯৭২ সালে তিনি এ বিভাগে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৯৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অধ্যাপনার পাশাপশি তিনি একাধিক মেয়াদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, কলা অনুষদের ডিন (১৯৭৮-৮০) এবং সিনেট সদস্য (১৯৭৪-১৯৮৩) সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৫-১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য ছিলেন। প্রফেসর হোসেন ১৯৭৩ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেন্দ্র রিচার্স মিউজিয়ামের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও প্রফেসর হোসেন দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬৫-১৯৬৬ সালে ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একস্ট্রা-মুর‌্যাাল ডিপার্টমেন্টে পাঠদানে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৩-১৯৮৮ সালে তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। এ.বি.এম হোসেনের পাণ্ডিত্য এবং শিক্ষক হিসেবে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে সম্মানজনক প্রফেসর ইমেরিটাস পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য যে, তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম প্রফেসর ইমেরিটাস।

শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে মৌলিক ও অনন্য অবদানের জন্য এ.বি.এম হোসেন দেশে ও বিদেশে বহু সম্মাননা, পুরস্কার লাভ এবং বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৫৮ সালে গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে অনারারি ফেলো নির্বাচিত করে। তিনি ১৯৬১-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য এবং ১৯৬২-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান হিস্টরিক্যাল রেকর্ড এবং আর্কাইভস কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. হোসেন নাফিল্ড ফাউন্ডেশন ফেলো হিসেবে ১৯৬৪-৬৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্দো-মুসলিম স্থাপত্যের উপর গবেষণা করেন। তাঁর এ গবেষণাকর্মটি পরবর্তীতে The Manara in Indo-Muslim Architecture শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৭৮ সালে ইউনেস্কো ইন্টারন্যাশনাল ফেলো হিসেবে ভারত, ইরান ও তুরস্কে ইসলামি শিল্পকলা বিষয়ে গবেষণা কাজ করেন। এ.বি.এম হোসেন ১৯৮৬-১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আগা খান ফাউন্ডেশন ফর ইসলামিক আর্কিটেকচারের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সনে নরওয়েজিয়ান পার্লামেন্ট তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য গঠিত বোর্ডের একজন সদস্য মনোনীত করে। তিনি ১৯৭৫-১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে ১৯৮৫ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) পুরস্কার এবং ১৯৯৫ সালে রাজশাহী লেখক পরিষদ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৮৩ সালে তিনি আন্তর্জাতিক বায়োগ্রাফিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ফেলো এবং ১৯৮৮ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউটের গবেষণা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য মনোনীত হন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং ২০১০ সালে বাংলা একাডেমি প্রফেসর ইমেরিটাস এ.বি.এম হোসেনকে আজীবন ফেলো নির্বাচন করে সম্মানিত করে। Who's Who, শিকাগো (১৯৮০-১৯৮১), ক্যাম্ব্রিজ বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টারের ম্যান অব অ্যাচিভম্যান্ট, দ্যা ইন্টারন্যাশনাল বুক অব অনার (ফার্স্ট ওয়ার্লড এডিশন) এবং ডিকশনারি অব ইন্টারন্যাশনাল বায়োগ্রাফি (অস্টাদশ খণ্ড) ইত্যাদিতে এ.বি.এম হোসেনের জীবনী স্থান পেয়েছে।

এ.বি.এম হোসেন দেশ এবং দেশের বাইরে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বহু সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে যোগদান করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৬৫ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ ভাইস-চ্যান্সেলরদের কনফারেন্সে, বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৮৪ সালে মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কায় অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) কনফারেন্সে এবং ১৯৮৫ সালে গ্রিসের এথেন্সে অনুষ্ঠিত মানবাধিকার কমিশনের সভায় একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। প্রফেসর হোসেন ১৯৮৫ সালে ভিআরএম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্মেলনের সভাপতি এবং ১৯৮৭ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের দ্বি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন এবং এর কর্ম-সংসদের বিভিন্ন পদে আসীন থেকে সংগঠনটির অগ্রযাত্রায় অবদান রাখেন। ইতিহাস পরিষদ ছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ইন্ডিয়ান হিস্টিরি কংগ্রেস এবং পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের জীবন সদস্য ছিলেন।

ইসলামি শিল্পকলাসহ ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ে দেশ-বিদেশের জার্নালে এ.বি.এম হোসেনের প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা শতাধিক। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাপিডিয়া- বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ-এ তিনি বহুসংখ্যক ভুক্তির রচয়িতা। তিনি বাংলাপিডিয়া’র সম্পাদনা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ইতিহাস, শিল্পকলা ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ সংখ্যা ১৫টি। এর মধ্যে রয়েছে: An Introduction to the History of Muslim Culture (1958); Fatehpur Sikri and its Architecture (1970); The Manara in Indo-Muslim Architecture (1970); A Historical Survey of the Monuments and Sites in Bangladesh (vol.I Mainamati-Deva-Parbata; Vol.II Gawr-Lakhnawti and vol.III Sonargaon- Panam (1997); Architecture, vol.2 of the Cultural Survey of Bangladesh Series (2007); আরব স্থাপত্য (১৯৮৪); ইসলামী চিত্রকলা (২০০৪); মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস- অটোমান সাম্রাজ্য থেকে জাতিসত্ত্বা রাষ্ট্র (২০১১); পড়ন্ত বেলার গল্প (আত্মজীবনী) (২০১৫) এবং ইতিহাস ও শিল্পকলা (২০১৬) ইত্যাদি। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস-অটোমান সাম্রাজ্য থেকে জাতিসত্তা রাষ্ট্র গ্রন্থটির জন্য তিনি ২০১১ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন পুরস্কারে ভূষিত হন ।

জাতীয় অধ্যাপক এ.বি.এম হোসেন একজন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তানের সরকারে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সপরিবারে দেশেই অবস্থান করেন। এ সময় একাধিকবার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোকেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে তাঁকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও ভীতি প্রদর্শন করে।

২০২০ সালের ১১ই জুলাই ইতিহাসবিদ ও গবেষক এ.বি.এম হোসেন ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে ঢাকার মিরপুরস্থ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। [মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান]