স্টিফেনসন, রোল্যান্ড ম্যাকডোনাল্ড
স্টিফেনসন, রোল্যান্ড ম্যাকডোনাল্ড (১৮০৮-১৮৯৫) পূর্ব ভারতে ব্রিটিশ রেলওয়ে প্রযুক্তি প্রবর্তনের অগ্রদূত। পেশাগতভাবে স্টিফেনসন ছিলেন একজন পূর্তপ্রকৌশলী এবং সেই সাথে অসামান্য উদ্যোগী। তিনি ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮২০-এর দশকে রেলওয়ে যুগের সূচনা প্রত্যক্ষ করেন। ১৮৩০-এর দশকে তিনি রেলওয়ে সম্পর্কে মানুষের মধ্যে এমন একটা উদ্দীপনা লক্ষ্য করেন যে, সবাই তখন যেকোন কোম্পানির একটা শেয়ার কেনার জন্য হন্যে হয়ে ছুটছিল। স্টিফেনসন বুঝতে পারেন যে, ইংল্যান্ডে রেলওয়ে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে এবং তাঁর মতো একজন উদ্যোক্তার উচিত উপনিবেশগুলিতে রেলওয়ে প্রবর্তন করে তার প্রথম মুনাফা আদায় করে নেওয়া। এ উদ্দেশ্যে তিনি বেছে নেন ভারতকে। পিতা ও দুই ভাইসহ তাঁর অনেক পূর্বপুরুষ ভারতে বেসামরিক ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ এডওয়ার্ড স্টিফেনসন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য সুযোগ-সুবিধা আদায় করার লক্ষ্যে সুরম্যান এম্ব্যাসির সদস্য হিসেবে ১৭১৭ সালে মুগল দরবারে যান। পরবর্তীসময়ে তিনি ফোর্ট উইলিয়মের প্রেসিডেন্ট এবং গভর্নর হন (১৭২৮)। এভাবে বাংলার সাথে স্টিফেনসনের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক যোগাযোগ থাকায় তিনি তাঁর রেলওয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কলকাতায় আসতে উদ্বুদ্ধ হন।
স্টিফেনসন তাঁর পরিকল্পনার বাস্তবতা যাচাইয়ের জন্য ১৮৪১ সালে কলকাতায় আসেন। তিনি দেখতে পান বর্ধমানের রাণীগঞ্জ থেকে কলকাতায় কয়লা নেওয়া হয় ধীরগতিতে ব্যায়বহুল দেশীয় নৌকার মাধ্যমে। তিনি মনে করেন যে, ইংল্যান্ডের মতো এখানেও রেলপথের মাধ্যমে স্বল্প সময় ও স্বল্প ব্যয়ে কয়লা পরিবহণ করা সম্ভব। বেনারসের মধ্য দিয়ে কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত রেলপথের বাণিজ্যিক ও সামরিক সুবিধাগুলিও তিনি কর্তৃপক্ষের নিকট তুলে ধরেন। কিন্তু তাঁর এ প্রস্তাব কলকাতা সরকার কর্তৃক অবাস্তব পরিকল্পনা (wild project) হিসেবে সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয়। অতঃপর স্টিফেনসন ইংল্যান্ডে ফিরে যান এবং পার্লামেন্টে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ইস্ট ইন্ডিয়া লবি-র নেতৃস্থানীয় লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর পরিকল্পনা সম্পর্কে তাঁদেরকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। তাঁদের কাছে তিনি অধিকার সম্বলিত সনদপত্র এবং সরকারি সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি চান। এছাড়াও তিনি কলকাতায় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বণিকদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। এদের সকলের অনুপ্রেরণায় ১৮৪৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিনি তাঁর রেলপথের পরিকল্পনা কোর্ট অব ডাইরেক্টর্সএর নিকট উপস্থাপন করেন। ১৮৪৫ সালের ৭ মে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স তাঁর রেলওয়ে রিপোর্ট কলকাতায় প্রেরণ করে। সরকারের সাথে আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা সহজতর করার জন্য স্টিফেনসন ১৩ জন সদস্য সমন্বিত বোর্ড অব ডাইরেক্টর্স এবং ৪,০০০,০০০ পাউন্ড স্টার্লিং প্রারম্ভিক মূলধন (১৬০০০ শেয়ার, প্রতিটির মূল্য ২৫০ পাউন্ড স্টার্লিং) নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি গঠন করেন। স্টিফেনসন হন এ কোম্পানির প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
কলকাতা সরকারের নিকট থেকে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স-এর চিঠির প্রত্যুত্তর ত্বরান্বিত করার জন্য স্টিফেনসন কলকাতায় আসেন। কিন্তু ভারতে রেলপথের উন্নয়ন সম্ভাবনা বিষয়ে সন্দিহান সরকার দীর্ঘ দুবছর সময় নেয় তাঁর পরিকল্পনা মূল্যায়ন করতে এবং ১৮৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স-এর রেলওয়ে রিপোর্টের উত্তর পাঠায়। ১৮৪৭ সালের মে মাস থেকে রেলপথ প্রশ্নে লন্ডনে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। অবশেষে, এক পক্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি এবং অপর পক্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও বোর্ড অব কন্ট্রোল, এই দুপক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি কলকাতা সরকারের নিকট থেকে রেলপথ খাতে প্রকৃত বিনিয়োগের ৫% লাভের প্রতিশ্রুতি এবং রেলপথ নির্মাণে প্রয়োজনীয় জমি দখলের অধিকার প্রাপ্ত হয়। রেলপথ নির্মাণের প্রকৃত কাজ শুরু হয় ১৮৫১ সালে। কলকাতা থেকে রাণীগঞ্জ পর্যন্ত নির্মিত প্রথম রেলপথের নামকরণ করা হয় ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে। এভাবেই ভারতে রেলপথ যুগের সূচনা হয়। শীঘ্রই ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের সূত্র ধরে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে, গ্রেট সাউদার্ন রেলওয়ে অব ইন্ডিয়া, ইন্ডাস ভ্যালি স্টেট রেলওয়ে, নর্থ ওয়েস্টার্ন স্টেট রেলওয়েসহ আরও অনেক রেলওয়ে কোম্পানি স্থাপিত হয়। এসব কোম্পানির হোতাগণ সবাই ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্যোক্তা রোল্যান্ড ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনসন-এর ভূমিকাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। ১৮৯৫ সনে রোল্যান্ড ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনসন-এর মৃত্যু হয়। [সিরাজুল ইসলাম]