সামাজিক চিকিৎসা

সামাজিক চিকিৎসা (Community Medicine)  সমাজের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে সেবাপ্রদানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় প্রতিষেধক ঔষধাবলির ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। পূর্বে মানুষের অসুখকে একটি ব্যক্তিগত সমস্যা রূপে দেখা হতো, যা শুধু আক্রান্ত ব্যক্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করত। প্রকৃতপক্ষে চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে রোগকে ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে তার চিকিৎসা করার জন্যই। আগে অসুস্থতা বা অক্ষমতাকে পাপের শাস্তিরূপে গণ্য করা হতো। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অগ্রগতি এবং রোগের কারণসমূহ বোধগম্য হওয়ার ফলে জীবাণু সম্বন্ধে জ্ঞান, পুষ্টির অভাবের সঙ্গে অসুখের সম্পর্ক আবিষ্কার এবং সংক্রামক রোগবিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটি নতুনমাত্রা যুক্ত হয়, যা বিজ্ঞানের এক বিশেষ শাখা হিসেবে পরিগণিত। সামাজিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং জনস্বাস্থ্য চিকিৎসা ব্যবস্থার মতো বিষয়সমূহ বিজ্ঞানের কতকগুলি অবয়ব বর্ণনা করার জন্য পরিচিত করানো হয়েছিল। এই পরিচিতির কারণে সব রোগের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যক্তির ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে এই বিপরীত ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা হয় যে, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর জন্য সমষ্টির অভিমতকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। স্বীকৃতভাবেই কোন কোন সমস্যাকে জনগণের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তার ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আরও ভালভাবে মোকাবিলা করা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে জাতীয়ভাবে পুষ্টি প্রশিক্ষণ ও প্রচারণা ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ হ্রাসে এবং রাতকানা রোগের প্রতিরোধে এককভাবে কোন ব্যক্তিকে উপকৃত করলেও জনমুখী উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত অনেক কম খরচে সামাজিকভাবে যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয়।

বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা সূচিত হয়েছে ভয়ঙ্কর কলেরা রোগটির দ্বারা। এটি ১৯৫০-এর দশকের ভিয়েতনাম যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় চুক্তিসংস্থা বা সিয়াটো (SEATO), যা ১৯৫৬ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে কমিউনিজমের বিস্তার রোধকল্পে গঠিত হয়েছিল তা কলেরা গবেষণার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদানে এগিয়ে এসেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত যেসব আমেরিকান সৈন্য ওই অঞ্চলে যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল তাদের কলেরা থেকে রক্ষা করা। পাকিস্তান সিয়াটো কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি (PSCRL) ঢাকায় ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি তার কার্যক্রমের সূচনার প্রথম দিকে কলেরা আক্রান্তদের নিয়ে গবেষণা পরিচালনা ও শরীরের পানিশূন্যতা দূরীকরণের জন্য মুখে খাওয়া ঔষধ প্রয়োগের চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এর ভিত্তিতেই বহুল পরিচিত ‘ORS’ বা ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশনের ফরমুলা নির্ধারণ করা হয়। এই কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তরিত হয়। কলেরার মতো মহামারীর বিরুদ্ধে ‘ও আর এস’ ব্যবস্থা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উলে­খযোগ্য আবিষ্কার। বর্তমানে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র (ICDDR,B) তার সম্পদের বড় অংশ ব্যয় করে বিভিন্ন স্বাস্থ্য কার্যক্রমে, যেগুলি সরাসরি জনসমাজকে লক্ষ্য করেই তৈরি।

জনস্বাস্থ্য চিকিৎসায় আরও একটি অগ্রণী প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ইন ডায়াবেটিস, এন্ডোক্রাইন অ্যান্ড মেটাবলিক ডিসঅর্ডারস (BIRDEM) বা বারডেম। এটি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি বা DAB এর একটি প্রকল্প। বারডেম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জনস্বাস্থ্যমুখী স্বাস্থ্যসেবার একটি সহযোগী সংস্থা। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশের ৪ মিলিয়ন ডায়াবেটিক রোগীর নিকট স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া। তৃণমূল পর্যায়ে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ৬০টিরও বেশী অধিভুক্ত সমিতি সারাদেশে কাজ করছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক বেসরকারি সংস্থা জনস্বাস্থ্য গবেষণা কার্যক্রমের অংশীদার। উদাহরণস্বরূপ ব্র্যাক (BRAC) ওরাল রিহাইড্রেশন চিকিৎসার মাঠ পর্যায়ের প্রয়োগের কাজে জড়িত রয়েছে। তারা গৃহে ব্যবহূত দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহার করে কম খরচে জনসাধারণের মধ্যে কার্যকর গৃহচিকিৎসার পরামর্শ দিচ্ছে। যেমন লবণ ও গুড় পানিতে মিশ্রণের একটি ফরমুলা তৈরি হয়েছে যাকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় লবণ-গুড়ের পানি। যক্ষ্মা চিকিৎসায়ও এই সংস্থাটি কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে সাধারণ সমস্যা হচ্ছে রোগীরা প্রায়শই এই অপেক্ষাকৃত দীর্ঘকালীন (প্রায় এক বছর) চিকিৎসাকালে চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। ব্র্যাক এক ধরনের পরীক্ষামূলক গবেষণার সূত্রপাত করেছে, যাতে যোগদানকারী রোগীদের জন্য বিশেষ উৎসাহ দানের ব্যবস্থা আছে। রোগীদের প্রথমে যোগদানের নিদর্শনস্বরূপ চিকিৎসার খরচ হিসেবে ১০০ টাকা জমা দিতে বলা হয়, যা বেশির ভাগই চিকিৎসা সমাপ্তির পর ফেরত দেওয়া হয়ে থাকে। এর ফলে চিকিৎসা সম্পন্ন করার হার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ব্যক্তি ও জনসাধারণ খুবই উপকৃত হয়েছে।

বাংলাদেশে বহুসংখ্যক বেসরকারি সংস্থা আছে যার অনেকগুলিই জনসাধারণ পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কাজে নিয়োজিত। বাংলাদেশে যেসব ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তার মধ্যে আছে ভিটামিন ‘এ’র অভাব, আর্সেনিকঘটিত বিষক্রিয়া, উদরাময়, গলগন্ড, কৃমি এবং শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি।

বাংলাদেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য চিকিৎসা প্রদান একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ক্ষেত্র। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধারা থেকে ধারণা করা যায় যে, একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ বাংলাদেশে বসবাস করবে, অর্থাৎ প্রতি বর্গ কিলোমিটারে গ্রামীণ পটভূমিতে প্রায় ১,৭০০ লোক ধারণ করতে হবে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে গ্রামীণ সমস্যাবলি মোকাবিলা করতে হবে, যেমন অস্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, নিরাপদ খাবার পানির অপ্রতুলতা, সংক্রামক রোগের অধিক বোঝা, পুষ্টিসংক্রান্ত সমস্যার বিশালত্ব এবং পরিবেশের অবনতির সঙ্গে পরিবার পর্যায়ে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা। জনগণমুখী স্বাস্থ্য পদক্ষেপ ব্যতীত আর কোন স্বল্পব্যয়ী কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নেই যার সাহায্যে প্রতিরোধযোগ্য ব্যাধিসমূহের বোঝা কমানো সম্ভব হতে পারে এবং দেশের সীমিত স্বাস্থ্যসম্পদ থেকে সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি খাতে গ্রামীণ পটভূমিতে জনস্বাস্থ্যভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ ও এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের স্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যাবলিতে জনসাধারণকে সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে জড়িত করতে পারে। স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষাদান সাধারণ সংক্রামক রোগের বিস্তার সীমিত রাখতে পারে। সফল টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে এর অনেকগুলিকেই সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করা যেতে পারে। চিকিৎসকদের নিকট এই জনস্বাস্থ্য চিকিৎসা ব্যবস্থা যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে এবং দেশের কোন কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে জনস্বাস্থ্য চিকিৎসা বিশেষভাবে চিহ্নিত।  [জিয়া উদ্দিন আহমেদ]

আরও দেখুন আইসিডিডিআর,বি; বারডেম, ব্র্যাক