মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা
মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা মুর্শিদাবাদে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যগত মুগল ধারার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এক নতুন ধারা। মুর্শিদাবাদ আঠারো শতকের প্রথম চতুর্থাংশে বাংলা প্রদেশের রাজধানী ছিল। প্রদেশটি ছিল পাল ও হোসেন শাহী আমলে শিল্প ও সংস্কৃতির একটি বড় কেন্দ্র। মুগলগণও এ অঞ্চলের শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পতনোন্মুখ মুগল সাম্রাজ্যের দরবারী শিল্পিগণ যখন তাঁদের জীবিকার সন্ধানে মুর্শিদাবাদের দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন, তখন এ প্রদেশের শাসকগোষ্ঠীর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা রীতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আঠারো শতকে ইউরোপীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্থায়ী সরকারের কারণে মুর্শিদাবাদে সমৃদ্ধির এক নতুন যুগের সূত্রপাত হয়।
তবে প্রথম সুবাহদার মুর্শিদকুলী খান এর (১৭০০-১৭২৭) আমলে মুর্শিদাবাদে কোন চিত্রশালা স্থাপিত হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত নয়। তিনি একজন ধার্মিক শাসক ছিলেন এবং সবধরনের বিলাসিতাকে ঘৃণা করতেন। এতদ্সত্ত্বেও তাঁর সময়কার কয়েকটি চিত্র- যেমন, ভাগীরথী নদীর তীরে মুর্শিদকুলী খানের দরবার অনুষ্ঠান’ (আনু. ১৭২০), ‘মুহররম মিছিল’, ‘খাজা খিজিরের উৎসবসমূহ’ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে ক্লাইভ অ্যালবামের একটি পাতায় সংরক্ষিত আছে। এ চিত্রগুলির অংকন পদ্ধতি মুগল শিল্পকলার পরবর্তী ও আঞ্চলিক রূপ হিসেবে ধরা যায়। পরবর্তী সুবাহদার সুজাউদ্দীনের (১৭২৭-১৭৩৯) শাসনকালের কোন চিত্র-শিল্প এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
প্রকৃত মুর্শিদাবাদ শৈলীতে অংকিত চিত্রকর্ম পরবর্তী শাসনকর্তা নবাব আলীবর্দী খানের (১৭৪০-১৭৫৬) সময়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সমসাময়িক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেনের মতে আলীবর্দী খান শিল্প ও সংস্কৃতির একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর দরবারের কয়েকটি চিত্রকর্ম যেমন, ‘হরিণ শিকারে মত্ত নওয়াব আলীবর্দী খান’ (আনু. ১৭৫০-১৭৫৫),‘বাগান চত্বরে ভ্রাতুষ্পুত্রদের সাথে আলাপরত নওয়াব আলীবর্দী খান’ বর্তমানে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। এগুলি প্রাথমিক মুর্শিদাবাদ শিল্পকলার স্বাক্ষর বহন করছে এবং এ বৃদ্ধ শাসক দরবার ও শিকার-দৃশ্য পছন্দ করতেন। তাঁর দরবার ও শিকার দৃশ্যে বিষণ্ণতা, উজ্জ্বল সাদা ও ধূসর রং-এর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
আলীবর্দী খানের দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলে মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে। তাঁর উদার মনোভাবের কারণে মুর্শিদাবাদ দরবারের চিত্রকলা আরও সমৃদ্ধ হয় ও বিস্তার লাভ করে। আনুষ্ঠানিক দরবার দৃশ্য ও কথোপকথন দৃশ্য ব্যতীত তাঁর চিত্রকরদের নিভৃত অন্দরমহল ও রাগমালা দৃশ্য অংকনে উৎসাহিত করা হয়।
সিরাজউদ্দৌলার স্বল্পকালীন শাসন-আমলে শিল্পকলার চর্চায় এক নতুন উদ্যম পরিলক্ষিত হয়। দরবারের শিল্পিরা অনেক রাগ-রাগিণীর দৃশ্য অঙ্কন করেছেন। এসব রাগ-রাগিণীর দৃশ্যের মধ্যে হিন্দোল, গুজরী, ককুভা, মধু-মাধবী, বাঙ্গালী ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময়ের চিত্রসমূহের মধ্যে রোমান্টিক প্রাকৃতিক দৃশ্য অথবা দরবার চত্বর অথবা নদী ভ্রমণে নর-নারীর অন্তরঙ্গ দৃশ্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
পূর্ববর্তী মুগল-চিত্রকরদের ন্যায় মুর্শিদাবাদের চিত্রকরেরা হাতে তৈরি কাগজে জলরং ব্যবহার করে চিত্রাঙ্কণ করতেন। তারা মুগল শিল্প-রীতি অনুসারে অংকনের কাজ করতেন। দিগন্ত সীমায় অর্ধবৃত্তাকার ঝোপের সারি, শান্ত নদীতীরে সারস পাখির দল, দূরে তরঙ্গায়িত টিলার মাঝে অর্ধবৃত্তাকার গুল্মরাজি শোভিত বীথি এ সবই মুর্শিদাবাদ শিল্পরীতির পরিচয় বহন করে।
পরবর্তী শাসনকর্তা মীরজাফরের আমলে (১৭৫৭-১৭৬০) মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা অংকন রীতিতে তেমন কোন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায় না, বরং এ সময় সিরাজউদ্দৌলার আমলের চিত্রকলার সজীবতা ও সৌন্দর্য হ্রাস পেয়েছে। এ সময়ে লক্ষ্ণৌর প্রসিদ্ধ চিত্রকর পুরাননাথ ওরফে হুনহর মুর্শিদাবাদ চিত্রশালায় যোগ দেন। একটি সুন্দর চিত্রকলাতে পুরাননাথ এক বিশাল মাঠে নওয়াব মীরজাফর ও তাঁর পুত্র মিরনের সৈন্যবাহিনী পরিদর্শনের চিত্র অঙ্কন করেন। এটি বর্তমানে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে (Victoria & Albert Museum) সংরক্ষিত আছে। অপরাপর মিনিয়েচার চিত্রসমূহে স্বাভাবিক উপবেশনে নওয়াবের একক চিত্র, আনুষ্ঠানিক দরবার চিত্র ইত্যাদি দেখা যায়। বিষয়বস্ত্ত ও বিষণ্ণ পরিপার্শ্বিক অবস্থার মনোনয়ন এবং হালকা রং বিন্যাসের ক্ষেত্রে সদৃশতার বিচারে এ চিত্রকলাসমূহ আলীবর্দী খানের চিত্রকলার কথা মনে করিয়ে দেয়।
নওয়াব মীরজাফরের সময়ে লক্ষ্ণৌর যেসব চিত্রকর রাজকীয় চিত্রশালায় নিয়োজিত ছিলেন, তারা শাসনকর্তা মীরকাশিম এর (১৭৬০-৬৩) চিত্রশালায়ও কাজ করেন। এ চিত্রকরদের মধ্যে প্রখ্যাত চিত্রকর দীপচাঁদ-এর দক্ষ হাতে অংকিত হয় মীরকাশিমের অন্যতম সভাসদ গুরগান-এর প্রসিদ্ধ প্রতিকৃতি, যা বর্তমানে ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এ সময়ে অংকিত নওয়াবদের আনুষ্ঠানিক দরবার চিত্রসমূহ পূর্ববর্তী শাসন আমলের চিত্রকর্মের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। মীরকাশিমের সময়ে লক্ষ্ণৌর চিত্রকরদের আগমন ও প্রাধান্যের কারণে মুর্শিদাবাদ চিত্রকলার রীতিতে লক্ষণীয় পরিবর্তন সূচিত হয় এবং মুগল চিত্রকলার প্রচলিত রীতির পরিবর্তে লক্ষ্ণৌ চিত্রকলার নতুন রীতি স্থান লাভ করে।
আবেগাপ্লুত নওয়াব ও সভাসদদের প্রতিকৃতি, চিত্রে ধূসর ও ঈষৎ পিঙ্গল বর্ণের পটভূমি, পটভূমিতে ফুলের সমারোহ এ সবই লক্ষ্ণৌ চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য বহন করে। ইংরেজদের হাতে মীরকাশিমের পরাজয় ও ক্ষমতাচ্যুতি এবং বৃদ্ধ ও পুতুলবৎ নওয়াব মীরজাফরের দ্বিতীয়বার মুর্শিদাবাদের মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে শিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশের জন্য যে উপযোগী পরিবেশের প্রয়োজন তা বাধাগ্রস্ত হয়। মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা পৃষ্ঠপোষকতার ভার তখন মুর্শিদাবাদের ধনাঢ্য জমিদার, সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার, হিন্দু ও জৈন-ব্যবসায়ী এবং মুর্শিদাবাদের সন্নিকটে বসবাসকারী ইংরেজ কর্মকর্তাদের উপর ন্যস্ত হয়। এরা বিপর্যস্ত চিত্রকরদের হিন্দু-মুসলমানের পান্ডুলিপি ও মুরক্কাসমূহকে (ছবির অ্যালবাম) চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করার কাজে নিযুক্ত করেন। এ মুরক্কাগুলির মধ্যে মুগল শাসক, নওয়াব, সভাসদ, রাগমালার প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি প্রভৃতি ছিল। পান্ডুলিপি ও অ্যালবামের মধ্যে ‘দস্ত্তর-ই-হিমায়াত’, ‘রজমনামা’, ‘নল-দময়ন্তী’, ‘নবব দমন’, ‘রাগমালা’ এবং ‘নায়ক-নায়িকাভেদ’ পৃষ্ঠপোষকদের আনুকূল্য পায়। হিন্দু দেবতা ও ধর্মীয় বিষয়সমূহ চিত্রাঙ্কণে চিত্রশিল্পিরা বাংলার হিন্দু ধর্মমতের স্থানীয় রূপ- যেমন বৈষ্ণব সংক্রান্ত বিষয় ও তান্ত্রিক রীতিসমূহ চিত্রায়িত করেছেন। ক্ষুদ্রাকৃতির ঐ সকল চিত্র অঙ্কনে চিত্রশিল্পিরা বিশ্বস্ততার সাথে বাংলার উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের ছবি অতিসাধারণভাবে অঙ্কন করেছেন। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ পতনোন্মুখ মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা রীতির শেষ চিহ্নের ওপর আঘাত হানে। দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত চিত্রকরেরা ব্রিটিশ প্রভুদের চিত্র-কর্মশালায় আশ্রয় গ্রহণ করে সমসাময়িক ইউরোপীয় শিল্পকলার ভাব-ধারায় প্রভাবিত কোম্পানি শিল্পকলা রীতি গ্রহণ করে। [নাজমা খান মজলিস]