ভূমিস্বত্ব সম্পর্ক: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
২ নং লাইন: ২ নং লাইন:
'''ভূমিস্বত্ব সম্পর্ক'''  রাষ্ট্র কিংবা কোন ব্যক্তি-স্বত্বাধিকারী কর্তৃক নির্দিষ্ট শর্তে জোত বা জমিজমার মালিকানা গ্রহণ। বঙ্গীয় বদ্বীপ তথা আজকের বাংলাদেশ মূলত নদনদীর পলি দ্বারা গঠিত অঞ্চল। এ বদ্বীপটি ঐতিহাসিকভাবে ভাল ফসল ও কৃষিভিত্তিক নানা শিল্পপণ্যের জন্য সুপরিচিত। শিল্পবিপ্লব-পূর্ব বিশ্বে কৃষি ছিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল বুনিয়াদ। তখন কৃষিভিত্তিক অঞ্চলরূপে বাংলা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ও মর্যাদার অধিকারী ছিল। এদেশে ঐতিহাসিক কালানুক্রমে লক্ষ্য করা যায় যে কৃষি ও অন্যান্য সম্পদের আকর্ষণে দেশ-দেশান্তর থেকে নানা সময়ে বাণিজ্য ও সমরাভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানকারীরা প্রায় ক্ষেত্রেই এদেশে তাদের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ও তাদের নিজস্ব ধারায় এদেশ শাসন করে। ভূমিই রাষ্ট্রীয় রাজস্বের প্রধান উৎস হওয়ায় বাংলার ক্ষমতাসীন শাসকবর্গ সর্বদাই সচেতনভাবে প্রচলিত ভূমিসংস্কার ব্যবস্থাকে তাদের নিজ নিজ সুবিধা অনুযায়ী রদবদল করে নেওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। তাই বাংলার গোটা ইতিহাসে একই ধরনের ভূমিব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায় না। এ দেশের কোন শাসকবংশই পুরানো ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা পুরোপুরি যেমন গ্রহণ করে নি, তেমনি পুরোপুরি নতুন কোন ব্যবস্থাও প্রবর্তন করে নি। তাই নিরবচ্ছিন্নতা ও পরিবর্তন বরাবরই ছিল বাংলার ভূমিব্যবস্থার যুগপৎ বৈশিষ্ট্য।
'''ভূমিস্বত্ব সম্পর্ক'''  রাষ্ট্র কিংবা কোন ব্যক্তি-স্বত্বাধিকারী কর্তৃক নির্দিষ্ট শর্তে জোত বা জমিজমার মালিকানা গ্রহণ। বঙ্গীয় বদ্বীপ তথা আজকের বাংলাদেশ মূলত নদনদীর পলি দ্বারা গঠিত অঞ্চল। এ বদ্বীপটি ঐতিহাসিকভাবে ভাল ফসল ও কৃষিভিত্তিক নানা শিল্পপণ্যের জন্য সুপরিচিত। শিল্পবিপ্লব-পূর্ব বিশ্বে কৃষি ছিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল বুনিয়াদ। তখন কৃষিভিত্তিক অঞ্চলরূপে বাংলা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ও মর্যাদার অধিকারী ছিল। এদেশে ঐতিহাসিক কালানুক্রমে লক্ষ্য করা যায় যে কৃষি ও অন্যান্য সম্পদের আকর্ষণে দেশ-দেশান্তর থেকে নানা সময়ে বাণিজ্য ও সমরাভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানকারীরা প্রায় ক্ষেত্রেই এদেশে তাদের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ও তাদের নিজস্ব ধারায় এদেশ শাসন করে। ভূমিই রাষ্ট্রীয় রাজস্বের প্রধান উৎস হওয়ায় বাংলার ক্ষমতাসীন শাসকবর্গ সর্বদাই সচেতনভাবে প্রচলিত ভূমিসংস্কার ব্যবস্থাকে তাদের নিজ নিজ সুবিধা অনুযায়ী রদবদল করে নেওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। তাই বাংলার গোটা ইতিহাসে একই ধরনের ভূমিব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায় না। এ দেশের কোন শাসকবংশই পুরানো ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা পুরোপুরি যেমন গ্রহণ করে নি, তেমনি পুরোপুরি নতুন কোন ব্যবস্থাও প্রবর্তন করে নি। তাই নিরবচ্ছিন্নতা ও পরিবর্তন বরাবরই ছিল বাংলার ভূমিব্যবস্থার যুগপৎ বৈশিষ্ট্য।


'''প্রাচীনকাল''' জমি মালিকানার বিষয়ে ভারততত্ত্ববিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কোন কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে রাজাই জমির মালিক। আবার কারও মতে, চাষিই জমির মালিক। তৃতীয় এক অভিমত অনুযায়ী, রাজা বা চাষিরা নয়, জমির প্রকৃত মালিক গ্রামের জনসমাজ। গ্রামীণ জনসমাজের জমি মালিকানার তত্ত্বটি অবশ্য বিনা প্রশ্নেই বাতিল করে দেওয়া যায় এই কারণে যে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের জনসমাজ যেভাবে গড়ে উঠেছে বাংলার জনসমাজ সেভাবে বিকশিত হয় নি। পন্ডিতরা মনে করেন, বাংলার প্রাচীন জনবসতিগুলি খুবই বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠে। বিভিন্ন খানায় বিভক্তি ও পরিবারের বিক্ষিপ্ত অবস্থানের কারণে সামাজিক সংগঠন তেমন নিবিড় বুনটে গড়ে উঠতে পারে নি। চাষিদের জমির মালিকানার তত্ত্বটি অংশত গ্রহণ করা যেতে পারে এই ভিত্তিতে যে, তারা বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারসূত্রে ও নিরবচ্ছিন্নভাবে রীতিমাফিক কিংবা রাজা প্রণীত আইনের ভিত্তিতে প্রদেয় অর্থ পরিশোধ করে ঐ জমি চাষাবাদ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জমির মালিকানা যুগ্মভাবে রাজা এবং চাষি উভয় তরফেরই ছিল অর্থাৎ রাজার জমিদারির সাথে সমন্বিত রূপে ছিল চাষির স্বত্বাধিকার। এক পক্ষের সে অধিকার হলো সার্বভৌমত্বের। আরেক পক্ষের অধিকার হলো প্রকৃত চাষির। চাষি তার জমিতে যা উৎপাদন করে তাতে রাজার অধিকারের বিষয়টি কেবল রাজার ক্ষমতাসাপেক্ষ নয় বরং ঐ জমিতে সেচ দেওয়ার প্রকল্প সংগঠন, ভূমি পুনরুদ্ধার উদ্যোগ এবং দেশের ভিতরের বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ও বাইরের হানাদারদের হামলা থেকে তাদের রক্ষাব্যবস্থার সংগঠনও তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। জমি মঞ্জুরি ও বিক্রয় সংক্রান্ত গুপ্তযুগের যেসব তাম্রফলক নিদর্শনের অস্তিত্ব আছে সেগুলির বেশির ভাগেই ভূমিতে রাজার অধিকারের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে।
'''''প্রাচীনকাল''''' জমি মালিকানার বিষয়ে ভারততত্ত্ববিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কোন কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে রাজাই জমির মালিক। আবার কারও মতে, চাষিই জমির মালিক। তৃতীয় এক অভিমত অনুযায়ী, রাজা বা চাষিরা নয়, জমির প্রকৃত মালিক গ্রামের জনসমাজ। গ্রামীণ জনসমাজের জমি মালিকানার তত্ত্বটি অবশ্য বিনা প্রশ্নেই বাতিল করে দেওয়া যায় এই কারণে যে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের জনসমাজ যেভাবে গড়ে উঠেছে বাংলার জনসমাজ সেভাবে বিকশিত হয় নি। পন্ডিতরা মনে করেন, বাংলার প্রাচীন জনবসতিগুলি খুবই বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠে। বিভিন্ন খানায় বিভক্তি ও পরিবারের বিক্ষিপ্ত অবস্থানের কারণে সামাজিক সংগঠন তেমন নিবিড় বুনটে গড়ে উঠতে পারে নি। চাষিদের জমির মালিকানার তত্ত্বটি অংশত গ্রহণ করা যেতে পারে এই ভিত্তিতে যে, তারা বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারসূত্রে ও নিরবচ্ছিন্নভাবে রীতিমাফিক কিংবা রাজা প্রণীত আইনের ভিত্তিতে প্রদেয় অর্থ পরিশোধ করে ঐ জমি চাষাবাদ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জমির মালিকানা যুগ্মভাবে রাজা এবং চাষি উভয় তরফেরই ছিল অর্থাৎ রাজার জমিদারির সাথে সমন্বিত রূপে ছিল চাষির স্বত্বাধিকার। এক পক্ষের সে অধিকার হলো সার্বভৌমত্বের। আরেক পক্ষের অধিকার হলো প্রকৃত চাষির। চাষি তার জমিতে যা উৎপাদন করে তাতে রাজার অধিকারের বিষয়টি কেবল রাজার ক্ষমতাসাপেক্ষ নয় বরং ঐ জমিতে সেচ দেওয়ার প্রকল্প সংগঠন, ভূমি পুনরুদ্ধার উদ্যোগ এবং দেশের ভিতরের বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ও বাইরের হানাদারদের হামলা থেকে তাদের রক্ষাব্যবস্থার সংগঠনও তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। জমি মঞ্জুরি ও বিক্রয় সংক্রান্ত গুপ্তযুগের যেসব তাম্রফলক নিদর্শনের অস্তিত্ব আছে সেগুলির বেশির ভাগেই ভূমিতে রাজার অধিকারের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে।


রাজার করারোপের ক্ষমতাটি রীতিপ্রথা ও ধর্মশাস্ত্রের অনুশাসন দ্বারা সীমিত ছিল। রাজা একজন প্রজাকে তার জোতজমার দখল থেকে উৎখাত করতে পারতেন। আবার, তার এই ক্ষমতা ধর্মীয় বিধিনিষেধ ও তার নিজের আইন দ্বারা সীমিতও ছিল। তখন খাজনামুক্ত স্থায়িভূমি মধ্যস্বত্ব ছিল যা সাধারণত রাজা পুনর্গ্রহণ করতে পারতেন না। যেমন, এক্ষেত্রে জমির নিভি-ধর্ম মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা যায়। এই ধরনের ভূমি-মধ্যস্বত্ব সংঘ বা বিহার ইত্যাদি বা অন্যান্য দাতব্য উদ্দেশে প্রদান করা হতো। আর এরকম ভূমিস্বত্ব একবার মঞ্জুর করা হলে যে পক্ষকে এরকম ভূমিস্বত্ব মঞ্জুর করা হতো তাদের তরফে কোনরকম গুরুতর ক্রটি-বিচ্যুতি না ঘটা পর্যন্ত ঐ ভূমিস্বত্ব পুনর্গ্রহণ বা প্রত্যাহার করা যেত না। গুপ্ত শাসনামলের শেষের দিকে অবশ্য নিভি-ধর্ম ব্যবস্থার পাশাপাশি ভূমি ছিদ্রন্যায় মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। অবশ্য এই দুই ধরনের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে সুনিশ্চিত যে, উভয় ব্যবস্থাই ছিল রাজস্বমুক্ত মঞ্জুরি। এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য হতে পারত কেবল মঞ্জুরি প্রদানের সাথে সংশ্লিষ্ট শর্তাবলিতে।
রাজার করারোপের ক্ষমতাটি রীতিপ্রথা ও ধর্মশাস্ত্রের অনুশাসন দ্বারা সীমিত ছিল। রাজা একজন প্রজাকে তার জোতজমার দখল থেকে উৎখাত করতে পারতেন। আবার, তার এই ক্ষমতা ধর্মীয় বিধিনিষেধ ও তার নিজের আইন দ্বারা সীমিতও ছিল। তখন খাজনামুক্ত স্থায়িভূমি মধ্যস্বত্ব ছিল যা সাধারণত রাজা পুনর্গ্রহণ করতে পারতেন না। যেমন, এক্ষেত্রে জমির নিভি-ধর্ম মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা যায়। এই ধরনের ভূমি-মধ্যস্বত্ব সংঘ বা বিহার ইত্যাদি বা অন্যান্য দাতব্য উদ্দেশে প্রদান করা হতো। আর এরকম ভূমিস্বত্ব একবার মঞ্জুর করা হলে যে পক্ষকে এরকম ভূমিস্বত্ব মঞ্জুর করা হতো তাদের তরফে কোনরকম গুরুতর ক্রটি-বিচ্যুতি না ঘটা পর্যন্ত ঐ ভূমিস্বত্ব পুনর্গ্রহণ বা প্রত্যাহার করা যেত না। গুপ্ত শাসনামলের শেষের দিকে অবশ্য নিভি-ধর্ম ব্যবস্থার পাশাপাশি ভূমি ছিদ্রন্যায় মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। অবশ্য এই দুই ধরনের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে সুনিশ্চিত যে, উভয় ব্যবস্থাই ছিল রাজস্বমুক্ত মঞ্জুরি। এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য হতে পারত কেবল মঞ্জুরি প্রদানের সাথে সংশ্লিষ্ট শর্তাবলিতে।
৮ নং লাইন: ৮ নং লাইন:
পরবর্তীকালে, ব্যবহার ও উর্বরতা অনুযায়ী জমির শ্রেণিবিন্যস করা হতো। খ্রিস্টীয় আট শতকের আগের বিভিন্ন তাম্রফলক লিপিতে দেখা যায়, সে সময় জমি বিভক্ত ছিল প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে, আর এ শ্রেণিবিভক্তি ছিল রাষ্ট্র ও কৃষককুলের মধ্যকার সম্পর্কেরও নিয়ামক। এগুলি হলো বাস্ত্ত (বাস্ত্তভিটা), ক্ষেত্র (কৃষিজমি) ও খিল (আবাদযোগ্য পতিত জমি)। এসব শ্রেণির জমির জন্য রাজস্ব বা খাজনার কাঠামোও আলাদা ছিল। তবে জমি দান বা জমির বিক্রয় সংক্রান্ত উৎকীর্ণলিপিতে দেখা যায়, সকল শ্রেণির জমির দাম ছিল অভিন্ন। যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে জমির দামের ভিন্নতা না থাকার ধাঁধার কোন সমাধান পাওয়া না। বিভিন্ন উৎকীর্ণলিপিতে গোচর বা পশুচারণ ক্ষেত্র হিসেবে আরও একশ্রেণির জমির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, গোচর জমিও করমুক্ত ছিল। এই শ্রেণির জমিকে সাধারণ বা সামাজিক মালিকানাধীন জোত বিবেচনা করা হতো। উৎকীর্ণলিপিতে গোচর জমিকে সবসময়েই গ্রামের সীমায় দেখানো হয়েছে। এ থেকে ধরে নেওয়া যায়, গোচারণের জমিই কার্যত গ্রামের আবাদি জমির প্রান্তসীমা নির্দেশ করে।
পরবর্তীকালে, ব্যবহার ও উর্বরতা অনুযায়ী জমির শ্রেণিবিন্যস করা হতো। খ্রিস্টীয় আট শতকের আগের বিভিন্ন তাম্রফলক লিপিতে দেখা যায়, সে সময় জমি বিভক্ত ছিল প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে, আর এ শ্রেণিবিভক্তি ছিল রাষ্ট্র ও কৃষককুলের মধ্যকার সম্পর্কেরও নিয়ামক। এগুলি হলো বাস্ত্ত (বাস্ত্তভিটা), ক্ষেত্র (কৃষিজমি) ও খিল (আবাদযোগ্য পতিত জমি)। এসব শ্রেণির জমির জন্য রাজস্ব বা খাজনার কাঠামোও আলাদা ছিল। তবে জমি দান বা জমির বিক্রয় সংক্রান্ত উৎকীর্ণলিপিতে দেখা যায়, সকল শ্রেণির জমির দাম ছিল অভিন্ন। যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে জমির দামের ভিন্নতা না থাকার ধাঁধার কোন সমাধান পাওয়া না। বিভিন্ন উৎকীর্ণলিপিতে গোচর বা পশুচারণ ক্ষেত্র হিসেবে আরও একশ্রেণির জমির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, গোচর জমিও করমুক্ত ছিল। এই শ্রেণির জমিকে সাধারণ বা সামাজিক মালিকানাধীন জোত বিবেচনা করা হতো। উৎকীর্ণলিপিতে গোচর জমিকে সবসময়েই গ্রামের সীমায় দেখানো হয়েছে। এ থেকে ধরে নেওয়া যায়, গোচারণের জমিই কার্যত গ্রামের আবাদি জমির প্রান্তসীমা নির্দেশ করে।


'''মধ্যযুগ''' সুলতানি আমলের ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কিত তথ্যাদি প্রাচীন যুগের ভূমি বিবরণের মতোই অপ্রতুল। অবশ্য, এ বিষয় স্পষ্ট যে, সুলতানগণ পূর্ববর্তী ভূমি ব্যবস্থায় খুব বড়রকমের কোন পরিবর্তন সাধন করেননি যদিও তারা ভূমিস্বত্ব সম্পর্কিত অনেক নতুন পরিভাষার প্রবর্তন করেছিলেন। সুলতানগণ আগের মতোই অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি ভূমিরাজস্ব আদায় করেন আর এই কর সংগ্রহের কাজে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই ভূমিরাজস্ব আদায়ে অবশ্য মাজমাদার পদবিধারী মধ্যবর্তী একটি শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। এরা রাজস্ব আদায় কাজে সম্পর্কিত চাষি হিসেবে খাজনা-সংগ্রাহক কায়েমি স্বার্থের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করে। এই মাজমাদারি ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কতটা ব্যাপক ও সংগঠিত ছিল তা খুব স্পষ্ট না হলেও সুলতানগণ যে রাজস্ব আদায়ে সম্পর্কিত চাষিদের মাধ্যমে জমির খাজনা সংগ্রহ শুরু করেছিলেন তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বাংলার পূর্বাঞ্চলে কোন কোন উপকূলীয় এলাকায় কিছু পর্তুগিজকে (ফিরিঙ্গি) রাজস্ব আদায় কাজে সম্পর্কিত চাষি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, মাজমাদারগণ চিরস্থায়ী মধ্যস্বত্বধারী ছিলেন না। তাদেরকে একটা মেয়াদের জন্য নিযুক্ত করা হতো। এজন্য তাদেরকে চাষিদের কাছ থেকে আদায়কৃত মোট খাজনা থেকে শাহি রাজকোষে একটি নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ জমা দিতে হতো। ভারতের প্রাচীন শাসকদের নিভি-ধর্ম মধ্যস্বত্ব প্রদানের মতো সুলতানগণও ধর্মীয় ও দাতব্য সংগঠন এবং ব্যক্তিবিশেষকে লাখেরাজ বা নিষ্কর জমির মঞ্জুরি দিতেন, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের মঞ্জুরির ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল।
'''''মধ্যযুগ''''' সুলতানি আমলের ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কিত তথ্যাদি প্রাচীন যুগের ভূমি বিবরণের মতোই অপ্রতুল। অবশ্য, এ বিষয় স্পষ্ট যে, সুলতানগণ পূর্ববর্তী ভূমি ব্যবস্থায় খুব বড়রকমের কোন পরিবর্তন সাধন করেননি যদিও তারা ভূমিস্বত্ব সম্পর্কিত অনেক নতুন পরিভাষার প্রবর্তন করেছিলেন। সুলতানগণ আগের মতোই অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি ভূমিরাজস্ব আদায় করেন আর এই কর সংগ্রহের কাজে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই ভূমিরাজস্ব আদায়ে অবশ্য মাজমাদার পদবিধারী মধ্যবর্তী একটি শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। এরা রাজস্ব আদায় কাজে সম্পর্কিত চাষি হিসেবে খাজনা-সংগ্রাহক কায়েমি স্বার্থের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করে। এই মাজমাদারি ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কতটা ব্যাপক ও সংগঠিত ছিল তা খুব স্পষ্ট না হলেও সুলতানগণ যে রাজস্ব আদায়ে সম্পর্কিত চাষিদের মাধ্যমে জমির খাজনা সংগ্রহ শুরু করেছিলেন তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বাংলার পূর্বাঞ্চলে কোন কোন উপকূলীয় এলাকায় কিছু পর্তুগিজকে (ফিরিঙ্গি) রাজস্ব আদায় কাজে সম্পর্কিত চাষি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, মাজমাদারগণ চিরস্থায়ী মধ্যস্বত্বধারী ছিলেন না। তাদেরকে একটা মেয়াদের জন্য নিযুক্ত করা হতো। এজন্য তাদেরকে চাষিদের কাছ থেকে আদায়কৃত মোট খাজনা থেকে শাহি রাজকোষে একটি নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ জমা দিতে হতো। ভারতের প্রাচীন শাসকদের নিভি-ধর্ম মধ্যস্বত্ব প্রদানের মতো সুলতানগণও ধর্মীয় ও দাতব্য সংগঠন এবং ব্যক্তিবিশেষকে লাখেরাজ বা নিষ্কর জমির মঞ্জুরি দিতেন, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের মঞ্জুরির ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল।


মুগল শাসকগণ ভূমি বন্দোবস্ত পদ্ধতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করেন। মুগল ব্যবস্থার আওতায় জমি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন হলেও অনেক ক্ষেত্রেই জমির ব্যক্তি বা বেসরকারি মালিকানা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। পন্ডিতদের বিশ্বাস, মুগল শাসকরা ব্যক্তিপর্যায়ে জমি বিক্রয় করে এবং তাদেরকে ঐ জমি বা ভূ-সম্পত্তির মালিক হিসেবে মেনে নিয়ে জমিজমার বেসরকারি মালিকানাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তবে এ ধরনের মালিকানা কোন প্রচলিত বিষয় ছিল না বরং ব্যতিক্রমই ছিল এবং সাধারণভাবে জমি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিই রয়ে গিয়েছিল। সরকার [[জমিদার|জমিদার]] ও [[তালুকদার|তালুকদার]] নামে অভিহিত রাজস্ব সংগ্রাহক নিয়োগ করতেন। জমিদার ও তালুকদারগণ সাধারণত উত্তরাধিকারসূত্রে বংশানুক্রমে রাজস্ব আদায়ের অধিকার ভোগ করতেন। সরকারের অবশ্য সর্বদাই এ ধরনের রাজস্ব সংগ্রাহককে অপসারণ করার অধিকার থাকত। তবে তারা গুরুতর ও জটিল রকমে খেলাপি কিংবা অবাধ্য না হলে রাজস্ব সংগ্রাহক হিসেবে তাদের এ মধ্যস্বত্বাধিকার বংশপরম্পরায় অব্যাহত থাকত। এই জমিদার ও তালুকদারগণ কেবল রাজস্ব সংগ্রাহক ছিলেন। সরকার থেকে কোন নির্দেশ ছাড়া জমির খাজনার হার পরিবর্তনের কোন অধিকার তাদের ছিল না। পাট্টা ও কবুলিয়ত-এ সন্নিবিষ্ট শর্তাদির ভিত্তিতে জমিতে রীতিপ্রথামাফিক বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার ভোগ করত রায়ত। জমিতে মধ্যস্বত্বাধিকার সম্পর্কে বলা যায় যে, ঐ সময় প্রধানত দুই শ্রেণির রায়ত ছিল খুদকাশ্ত ও পাইকাশ্ত। খুদকাশ্ত রায়ত ছিল সংশ্লিষ্ট গ্রামের স্থায়ী অধিবাসী, জমিতে তাদের অধিকার ছিল রীতিপ্রথামাফিক। তাদের জমিতে স্থায়ী ভোগদখলস্বত্বের অধিকার যেমন ছিল তেমনি তারা কবুলিয়ত বা চুক্তির শর্তাদি পালনসাপেক্ষে বরাবর নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী ঐ জমির ব্যবহারও করতে পারত। পরগনার প্রমিত রাজস্বের হারে বা পরগনা নিরিখ-এ তাদের রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বা জমা শাহি কোষাগারে পরিশোধ করার অধিকার ছিল। পাইকাশ্তবর্গের রায়তগণ ছিল অনিবাসী চাষি যারা প্রতিযোগিতামূলক খাজনার হারে একটি মৌসুমের চাষাবাদের জন্য কৃষিজমির সন্ধানে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত। তারা জমির জন্য যে খাজনা বা রাজস্ব প্রদান করত তা ছিল খুদকাশ্ত রায়তদের প্রদেয় খাজনার তুলনায় অনেক কম। যেহেতু তারা মূলত যাযাবর ধরনের চাষি সেহেতু যে জমি তারা চাষ করত তাতে তাদের কোন অধিকার ছিল না।
মুগল শাসকগণ ভূমি বন্দোবস্ত পদ্ধতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করেন। মুগল ব্যবস্থার আওতায় জমি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন হলেও অনেক ক্ষেত্রেই জমির ব্যক্তি বা বেসরকারি মালিকানা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। পন্ডিতদের বিশ্বাস, মুগল শাসকরা ব্যক্তিপর্যায়ে জমি বিক্রয় করে এবং তাদেরকে ঐ জমি বা ভূ-সম্পত্তির মালিক হিসেবে মেনে নিয়ে জমিজমার বেসরকারি মালিকানাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তবে এ ধরনের মালিকানা কোন প্রচলিত বিষয় ছিল না বরং ব্যতিক্রমই ছিল এবং সাধারণভাবে জমি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিই রয়ে গিয়েছিল। সরকার [[জমিদার|জমিদার]] ও [[তালুকদার|তালুকদার]] নামে অভিহিত রাজস্ব সংগ্রাহক নিয়োগ করতেন। জমিদার ও তালুকদারগণ সাধারণত উত্তরাধিকারসূত্রে বংশানুক্রমে রাজস্ব আদায়ের অধিকার ভোগ করতেন। সরকারের অবশ্য সর্বদাই এ ধরনের রাজস্ব সংগ্রাহককে অপসারণ করার অধিকার থাকত। তবে তারা গুরুতর ও জটিল রকমে খেলাপি কিংবা অবাধ্য না হলে রাজস্ব সংগ্রাহক হিসেবে তাদের এ মধ্যস্বত্বাধিকার বংশপরম্পরায় অব্যাহত থাকত। এই জমিদার ও তালুকদারগণ কেবল রাজস্ব সংগ্রাহক ছিলেন। সরকার থেকে কোন নির্দেশ ছাড়া জমির খাজনার হার পরিবর্তনের কোন অধিকার তাদের ছিল না। পাট্টা ও কবুলিয়ত-এ সন্নিবিষ্ট শর্তাদির ভিত্তিতে জমিতে রীতিপ্রথামাফিক বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার ভোগ করত রায়ত। জমিতে মধ্যস্বত্বাধিকার সম্পর্কে বলা যায় যে, ঐ সময় প্রধানত দুই শ্রেণির রায়ত ছিল খুদকাশ্ত ও পাইকাশ্ত। খুদকাশ্ত রায়ত ছিল সংশ্লিষ্ট গ্রামের স্থায়ী অধিবাসী, জমিতে তাদের অধিকার ছিল রীতিপ্রথামাফিক। তাদের জমিতে স্থায়ী ভোগদখলস্বত্বের অধিকার যেমন ছিল তেমনি তারা কবুলিয়ত বা চুক্তির শর্তাদি পালনসাপেক্ষে বরাবর নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী ঐ জমির ব্যবহারও করতে পারত। পরগনার প্রমিত রাজস্বের হারে বা পরগনা নিরিখ-এ তাদের রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বা জমা শাহি কোষাগারে পরিশোধ করার অধিকার ছিল। পাইকাশ্তবর্গের রায়তগণ ছিল অনিবাসী চাষি যারা প্রতিযোগিতামূলক খাজনার হারে একটি মৌসুমের চাষাবাদের জন্য কৃষিজমির সন্ধানে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত। তারা জমির জন্য যে খাজনা বা রাজস্ব প্রদান করত তা ছিল খুদকাশ্ত রায়তদের প্রদেয় খাজনার তুলনায় অনেক কম। যেহেতু তারা মূলত যাযাবর ধরনের চাষি সেহেতু যে জমি তারা চাষ করত তাতে তাদের কোন অধিকার ছিল না।
১৪ নং লাইন: ১৪ নং লাইন:
মুগল ভূমি মধ্যস্বত্ব বন্দোবস্ত ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল জায়গির ব্যবস্থা। এর আওতায় জমি বা তালুক বরাদ্দ করা হতো। মুগল সম্রাটদের অভিজাত রাজকর্মকর্তাদেরকে নগদ অর্থে বেতন না দিয়ে প্রায় ক্ষেত্রেই তার পরিবর্তে জায়গির প্রদান করা হতো। জায়গির ছিল ভিন্ন ভিন্ন এলাকার তালুকবিশেষ যা থেকে অনুমিত হিসাব অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার জন্য বেতনের যে মঞ্জুরি রয়েছে তার সমপরিমাণ অর্থ আয় হিসেবে পাওয়া যেত। জায়গির সাধারণত বংশানুক্রমে উত্তরাধিকারমূলক ছিল না। জায়গির কি মেয়াদে বহাল থাকবে তাও নির্দিষ্ট বা নির্ধারিত ছিল না। তবে লক্ষ্য করা গেছে যে জায়গিরদারের গোটা জীবদ্দশার জন্যও জায়গির মঞ্জুর করা হয়েছে। ব্যক্তিবিশেষকে স্থায়ী ভোগদখলের জন্যও জায়গির মঞ্জুর করা হতো। জায়গিরদারগণ কার্যত মধ্যস্বত্বভোগী, এদের কেউ ছিল অস্থায়ী মেয়াদের, কেউবা স্থায়ী জায়গিরদার। রায়তদের কাছে জায়গিরদার ছিল জমিদারতুল্য। তারা জমিদারকে প্রদেয় খাজনার মতোই জায়গিরদারকে খাজনা বা রাজস্ব প্রদান করত। তবু জায়গিরদারের অধিকার কখনও রায়তের জন্য নির্ধারিত অধিকারগুলিকে প্রভাবিত বা পরিবর্তন করতে পারত না। এক্ষেত্রে রায়তের অধিকার রীতিপ্রথা ও আচার দ্বারা সংরক্ষিত থাকত। জায়গির ছাড়াও মুগল ভূমি ব্যবস্থায় [[লাখেরাজ|লাখেরাজ]] বা নিষ্কর রাজস্ব মঞ্জুরিরও ব্যবস্থা ছিল। সাধারণত এ ব্যবস্থাটি মদদ-ই-মাশ (জীবনধারণ সাহায্যভাতা) নামে পরিচিত। বিদ্বান, জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ, ধর্মীয় সাধকপুরুষ এবং অভিজাত খানদানি বংশধারার যারা চাকরিতে নিয়োজিত হবেন না এমন ব্যক্তিদের মদদ-ই-মাশ মঞ্জুরি দেওয়া হতো। এরকম মঞ্জুরির বিনিময়ে সুবিধাভোগীর কাছ থেকে কোন সেবা আশা করা হতো না। মদদ-ই-মাশ হস্তান্তরযোগ্য ছিল না। এছাড়া আরও অন্যান্য ধরনের লাখেরাজ মঞ্জুরিও ছিল। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ইনাম-ই আত-তামঘা (রাজকর্মকর্তার পরিবারকে প্রদত্ত উত্তরাধিকারভিত্তিক মঞ্জুরি) এবং ওয়াক্ফ (ধর্মীয় পবিত্র স্থান, মাযার বা মাদ্রাসার মতো প্রতিষ্ঠানকে প্রদেয়)।
মুগল ভূমি মধ্যস্বত্ব বন্দোবস্ত ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল জায়গির ব্যবস্থা। এর আওতায় জমি বা তালুক বরাদ্দ করা হতো। মুগল সম্রাটদের অভিজাত রাজকর্মকর্তাদেরকে নগদ অর্থে বেতন না দিয়ে প্রায় ক্ষেত্রেই তার পরিবর্তে জায়গির প্রদান করা হতো। জায়গির ছিল ভিন্ন ভিন্ন এলাকার তালুকবিশেষ যা থেকে অনুমিত হিসাব অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার জন্য বেতনের যে মঞ্জুরি রয়েছে তার সমপরিমাণ অর্থ আয় হিসেবে পাওয়া যেত। জায়গির সাধারণত বংশানুক্রমে উত্তরাধিকারমূলক ছিল না। জায়গির কি মেয়াদে বহাল থাকবে তাও নির্দিষ্ট বা নির্ধারিত ছিল না। তবে লক্ষ্য করা গেছে যে জায়গিরদারের গোটা জীবদ্দশার জন্যও জায়গির মঞ্জুর করা হয়েছে। ব্যক্তিবিশেষকে স্থায়ী ভোগদখলের জন্যও জায়গির মঞ্জুর করা হতো। জায়গিরদারগণ কার্যত মধ্যস্বত্বভোগী, এদের কেউ ছিল অস্থায়ী মেয়াদের, কেউবা স্থায়ী জায়গিরদার। রায়তদের কাছে জায়গিরদার ছিল জমিদারতুল্য। তারা জমিদারকে প্রদেয় খাজনার মতোই জায়গিরদারকে খাজনা বা রাজস্ব প্রদান করত। তবু জায়গিরদারের অধিকার কখনও রায়তের জন্য নির্ধারিত অধিকারগুলিকে প্রভাবিত বা পরিবর্তন করতে পারত না। এক্ষেত্রে রায়তের অধিকার রীতিপ্রথা ও আচার দ্বারা সংরক্ষিত থাকত। জায়গির ছাড়াও মুগল ভূমি ব্যবস্থায় [[লাখেরাজ|লাখেরাজ]] বা নিষ্কর রাজস্ব মঞ্জুরিরও ব্যবস্থা ছিল। সাধারণত এ ব্যবস্থাটি মদদ-ই-মাশ (জীবনধারণ সাহায্যভাতা) নামে পরিচিত। বিদ্বান, জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ, ধর্মীয় সাধকপুরুষ এবং অভিজাত খানদানি বংশধারার যারা চাকরিতে নিয়োজিত হবেন না এমন ব্যক্তিদের মদদ-ই-মাশ মঞ্জুরি দেওয়া হতো। এরকম মঞ্জুরির বিনিময়ে সুবিধাভোগীর কাছ থেকে কোন সেবা আশা করা হতো না। মদদ-ই-মাশ হস্তান্তরযোগ্য ছিল না। এছাড়া আরও অন্যান্য ধরনের লাখেরাজ মঞ্জুরিও ছিল। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ইনাম-ই আত-তামঘা (রাজকর্মকর্তার পরিবারকে প্রদত্ত উত্তরাধিকারভিত্তিক মঞ্জুরি) এবং ওয়াক্ফ (ধর্মীয় পবিত্র স্থান, মাযার বা মাদ্রাসার মতো প্রতিষ্ঠানকে প্রদেয়)।


'''ব্রিটিশ আমল''' ১৭৯৩ সালে [[চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত|চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত]] প্রথা প্রবর্তনের আগে [[ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি|ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি]] ভূমি মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থা নিয়ে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। দ্বৈত শাসনামলে (১৭৬৫-১৭৭২) রাজস্ব আদায়ের মুগল ব্যবস্থা মোটামুটি বহাল রাখা হয়। এই ব্যবস্থার আওতায় জমিদার, তালুকদার ও লাখেরাজদার প্রতিষ্ঠানকে তেমন কোন বড় রকমের পরিবর্তন ছাড়াই বহাল রাখা হয়। ১৭৯৩ সালে এই ঐতিহ্যবাহী ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন আনা হয়। এই পরিবর্তনের আওতায় জমির পুরানো মালিকদের পাশ কাটিয়ে খামার পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়। খামার পদ্ধতিতে জমির মালিকদেরকে তাদের জমির দখল থেকে সরিয়ে দিয়ে ঐ জমি বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য সর্বোচ্চ ডাকদাতাকে ইজারা দেওয়া হয়। তবে খামার পদ্ধতি সরকারের লক্ষ্য অর্জনে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়। ১৭৭৮ সালে জমিদারির অধিকারগুলি পুনরায় বলবৎ করা হয়। তবে এক্ষেত্রে বন্দোবস্ত দেওয়া হয় একটা সীমিত মেয়াদের জন্য মাত্র। এ মেয়াদ ছিল ন্যূনতম এক বছর থেকে সর্বাধিক তিন বছর। ১৭৮৪ সালের পিট-এর ভারত আইনের আওতায় কলকাতায় সরকারকে রাজস্ব প্রশাসন নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং জমিদার ও অন্যান্য সনাতন জমির মালিকদের সাথে রফা করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ঐ নির্দেশ অনুসারে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তন করা হয়।
'''''ব্রিটিশ আমল''''' ১৭৯৩ সালে [[চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত|চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত]] প্রথা প্রবর্তনের আগে [[ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি|ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি]] ভূমি মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থা নিয়ে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। দ্বৈত শাসনামলে (১৭৬৫-১৭৭২) রাজস্ব আদায়ের মুগল ব্যবস্থা মোটামুটি বহাল রাখা হয়। এই ব্যবস্থার আওতায় জমিদার, তালুকদার ও লাখেরাজদার প্রতিষ্ঠানকে তেমন কোন বড় রকমের পরিবর্তন ছাড়াই বহাল রাখা হয়। ১৭৯৩ সালে এই ঐতিহ্যবাহী ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন আনা হয়। এই পরিবর্তনের আওতায় জমির পুরানো মালিকদের পাশ কাটিয়ে খামার পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়। খামার পদ্ধতিতে জমির মালিকদেরকে তাদের জমির দখল থেকে সরিয়ে দিয়ে ঐ জমি বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য সর্বোচ্চ ডাকদাতাকে ইজারা দেওয়া হয়। তবে খামার পদ্ধতি সরকারের লক্ষ্য অর্জনে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়। ১৭৭৮ সালে জমিদারির অধিকারগুলি পুনরায় বলবৎ করা হয়। তবে এক্ষেত্রে বন্দোবস্ত দেওয়া হয় একটা সীমিত মেয়াদের জন্য মাত্র। এ মেয়াদ ছিল ন্যূনতম এক বছর থেকে সর্বাধিক তিন বছর। ১৭৮৪ সালের পিট-এর ভারত আইনের আওতায় কলকাতায় সরকারকে রাজস্ব প্রশাসন নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং জমিদার ও অন্যান্য সনাতন জমির মালিকদের সাথে রফা করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ঐ নির্দেশ অনুসারে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তন করা হয়।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নিয়ামক প্রবিধানসমূহের আওতায় জমিদারগণ জমিতে তাদের স্বত্বাধিকার প্রাপ্ত হন। জমির মালিক হিসেবে এরপর থেকে জমিদার তার জমি অবাধে বিক্রয়, দান, ইজারা ইত্যাদি আকারে হস্তান্তর করার অধিকারী হন। জমিদারদের কাছে সরকারের রাজস্বের দাবি চিরস্থায়িভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়। জমিদারগণ তাদের জমিতে মালিকানার অধিকার পেলেও কোম্পানি সরকার জমিদারদের রায়তদের মর্যাদা কী হবে সে বিষয়ে নীরব থাকে। অথচ মুগল আমলে এই রায়তদের তাদের জমিতে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার ছিল এবং তাদের প্রদেয় খাজনার হার রীতিপ্রথা ও আচার অনুযায়ী নির্ধারিত ছিল। আর নীতিমাফিক নির্ধারিত হার জমিদার ও অন্যান্য খাজনা আদায়কারী প্রতিনিধিমূলক প্রতিষ্ঠান তাদের ইচ্ছামতো বদলাতে পারত না। অবশ্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে নিয়ামক প্রবিধানগুলিতে কৃষক সমাজের লোকজন এতদিন ঐতিহ্যগতভাবে যে অধিকার ভোগ করে আসছিল সেই একই অধিকার তাদের এখন রইল কি-না এতে সে বিষয়টির কোন সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। এর পরিণামে দেওয়ানি আদালতে বিচারকগণ রায়তদের রীতিপ্রথা অনুযায়ী অধিকারের বিষয়ে পরস্পরবিরোধী রায় দিতে থাকেন। কোন কোন আদালত এই মর্মে মত প্রকাশ করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিতে চাষির রীতিপ্রথাগত অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় নি। আবার কিছু আদালত ঠিক এর বিপরীত অভিমত প্রকাশ করেন। এইসব আদালতের মতে জমিতে জমিদারের মালিকানা-অধিকার প্রদত্ত হওয়ার কারণে রায়তদের রীতিপ্রথামাফিক অধিকারগুলির অবসান ঘটেছে। কেননা রায়তগণ অতঃপর জমিদারের ইচ্ছাধীন প্রজায় পরিণত হন।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নিয়ামক প্রবিধানসমূহের আওতায় জমিদারগণ জমিতে তাদের স্বত্বাধিকার প্রাপ্ত হন। জমির মালিক হিসেবে এরপর থেকে জমিদার তার জমি অবাধে বিক্রয়, দান, ইজারা ইত্যাদি আকারে হস্তান্তর করার অধিকারী হন। জমিদারদের কাছে সরকারের রাজস্বের দাবি চিরস্থায়িভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়। জমিদারগণ তাদের জমিতে মালিকানার অধিকার পেলেও কোম্পানি সরকার জমিদারদের রায়তদের মর্যাদা কী হবে সে বিষয়ে নীরব থাকে। অথচ মুগল আমলে এই রায়তদের তাদের জমিতে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার ছিল এবং তাদের প্রদেয় খাজনার হার রীতিপ্রথা ও আচার অনুযায়ী নির্ধারিত ছিল। আর নীতিমাফিক নির্ধারিত হার জমিদার ও অন্যান্য খাজনা আদায়কারী প্রতিনিধিমূলক প্রতিষ্ঠান তাদের ইচ্ছামতো বদলাতে পারত না। অবশ্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে নিয়ামক প্রবিধানগুলিতে কৃষক সমাজের লোকজন এতদিন ঐতিহ্যগতভাবে যে অধিকার ভোগ করে আসছিল সেই একই অধিকার তাদের এখন রইল কি-না এতে সে বিষয়টির কোন সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। এর পরিণামে দেওয়ানি আদালতে বিচারকগণ রায়তদের রীতিপ্রথা অনুযায়ী অধিকারের বিষয়ে পরস্পরবিরোধী রায় দিতে থাকেন। কোন কোন আদালত এই মর্মে মত প্রকাশ করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিতে চাষির রীতিপ্রথাগত অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় নি। আবার কিছু আদালত ঠিক এর বিপরীত অভিমত প্রকাশ করেন। এইসব আদালতের মতে জমিতে জমিদারের মালিকানা-অধিকার প্রদত্ত হওয়ার কারণে রায়তদের রীতিপ্রথামাফিক অধিকারগুলির অবসান ঘটেছে। কেননা রায়তগণ অতঃপর জমিদারের ইচ্ছাধীন প্রজায় পরিণত হন।


'''মধ্যবর্তী ভূমি স্বত্বাধিকারীর আবির্ভাব'''  মালিকানার অধিকার সম্বলিত জমিদারি ভূমিব্যবস্থার কারণে অচিরেই মধ্যবর্তী এক ভূমিস্বত্ব প্রথার আবির্ভাব ঘটে। জমিদার ও জমির প্রকৃত চাষির মধ্যে মধ্যবর্তী ভূমিস্বত্বাধিকারী অবস্থান নেওয়ায় জমিদার ও চাষিরা পৃথক হয়ে যায়। জমিদার ও চাষির মধ্যবর্তী স্বার্থধারীরা তাদের অধিকারগুলি একে অন্যের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে প্রায় ক্ষেত্রেই তারা নিজেরাও কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চাপের মুখে বহু জমিদারি প্রকাশ্য নিলামে বিক্রয় হয়ে যায়। সরকারি রাজস্ব যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থতার ফলে জমিদারি হারানোর আতঙ্কে বহু জমিদার নগদ সোলামি ও এক ধরনের ছাড়-খাজনার বিনিময়ে নিজ নিজ জমিদারিতে স্থায়ী নানা ভূমিস্বত্ব সৃষ্টি করেন। এই অভিনব ব্যবস্থা গ্রহণে পথিকৃৎ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বর্ধমানের রাজা। তিনি পত্তনি নামে এক ধরনের অভিনব মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। রাজা তার গোটা জমিদারিকে কয়েকটি ভাগ বা লটে বিভক্ত করেন। প্রতিটি লট একেক জন মধ্যস্বত্বধারীকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। তাতে শর্ত থাকে যে, তিনি চিরস্থায়িভাবে নির্ধারিত একটি খাজনা হারের সুবিধা ভোগ করবেন। তাকে এই যে আনুকূল্য বা সুবিধা দেওয়া হলো তার পরিবর্তে তাকে একটি অঙ্কের নগদ সোলামি প্রদান করতে হবে, আর এই শর্ত থাকবে যে, তিনি যদি যথাসময়ে খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হন তাহলে তার মধ্যস্বত্বাধিকার নিলামে বিক্রয় হবে। এই পত্তনি ব্যবস্থা বর্ধমানের রাজাকে সূর্যাস্ত আইনের কবল থেকে রক্ষা করে। আর তাতে তিনি যথেষ্ট অবস্থাপন্ন হতেও সক্ষম হন। তার এই সাফল্যে অন্যান্য জমির মালিকগণ প্রভাবিত হন ও তারাও রাজার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। এভাবে তারা পত্তনি ধরনের একাধিক মধ্যবর্তী ভূমিস্বত্বের সৃষ্টি করেন। পত্তনি ভূমিস্বত্বাধিকারীরা আবার তাদের নিজেদের দিক থেকেই একের পর এক দ্বিতীয় ও তৃতীয় এমনকি চতুর্থ স্তরের পত্তনিদার সৃষ্টি করেন। আর এভাবেই জমিদারি মধ্যস্বত্ব ও রায়তি অধিকারের মধ্যে স্থায়ী মধ্যবর্তী একাধিক অধিকারের সৃষ্টি হয়। আইনের দৃষ্টিতে পত্তনি মধ্যস্বত্বাধিকার ছিল সম্পত্তির অধীন সম্পত্তিবিশেষ। তাই বিভিন্ন মাত্রা বা স্তরের পত্তনিদারগণ তাদের ঊর্ধ্বতন স্বার্থাধিকারীকে নিয়মিতভাবে ছাড়-খাজনা প্রদানের শর্তে জমির মালিক হন।
'''''মধ্যবর্তী ভূমি স্বত্বাধিকারীর আবির্ভাব'''''  মালিকানার অধিকার সম্বলিত জমিদারি ভূমিব্যবস্থার কারণে অচিরেই মধ্যবর্তী এক ভূমিস্বত্ব প্রথার আবির্ভাব ঘটে। জমিদার ও জমির প্রকৃত চাষির মধ্যে মধ্যবর্তী ভূমিস্বত্বাধিকারী অবস্থান নেওয়ায় জমিদার ও চাষিরা পৃথক হয়ে যায়। জমিদার ও চাষির মধ্যবর্তী স্বার্থধারীরা তাদের অধিকারগুলি একে অন্যের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে প্রায় ক্ষেত্রেই তারা নিজেরাও কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চাপের মুখে বহু জমিদারি প্রকাশ্য নিলামে বিক্রয় হয়ে যায়। সরকারি রাজস্ব যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থতার ফলে জমিদারি হারানোর আতঙ্কে বহু জমিদার নগদ সোলামি ও এক ধরনের ছাড়-খাজনার বিনিময়ে নিজ নিজ জমিদারিতে স্থায়ী নানা ভূমিস্বত্ব সৃষ্টি করেন। এই অভিনব ব্যবস্থা গ্রহণে পথিকৃৎ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বর্ধমানের রাজা। তিনি পত্তনি নামে এক ধরনের অভিনব মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। রাজা তার গোটা জমিদারিকে কয়েকটি ভাগ বা লটে বিভক্ত করেন। প্রতিটি লট একেক জন মধ্যস্বত্বধারীকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। তাতে শর্ত থাকে যে, তিনি চিরস্থায়িভাবে নির্ধারিত একটি খাজনা হারের সুবিধা ভোগ করবেন। তাকে এই যে আনুকূল্য বা সুবিধা দেওয়া হলো তার পরিবর্তে তাকে একটি অঙ্কের নগদ সোলামি প্রদান করতে হবে, আর এই শর্ত থাকবে যে, তিনি যদি যথাসময়ে খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হন তাহলে তার মধ্যস্বত্বাধিকার নিলামে বিক্রয় হবে। এই পত্তনি ব্যবস্থা বর্ধমানের রাজাকে সূর্যাস্ত আইনের কবল থেকে রক্ষা করে। আর তাতে তিনি যথেষ্ট অবস্থাপন্ন হতেও সক্ষম হন। তার এই সাফল্যে অন্যান্য জমির মালিকগণ প্রভাবিত হন ও তারাও রাজার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। এভাবে তারা পত্তনি ধরনের একাধিক মধ্যবর্তী ভূমিস্বত্বের সৃষ্টি করেন। পত্তনি ভূমিস্বত্বাধিকারীরা আবার তাদের নিজেদের দিক থেকেই একের পর এক দ্বিতীয় ও তৃতীয় এমনকি চতুর্থ স্তরের পত্তনিদার সৃষ্টি করেন। আর এভাবেই জমিদারি মধ্যস্বত্ব ও রায়তি অধিকারের মধ্যে স্থায়ী মধ্যবর্তী একাধিক অধিকারের সৃষ্টি হয়। আইনের দৃষ্টিতে পত্তনি মধ্যস্বত্বাধিকার ছিল সম্পত্তির অধীন সম্পত্তিবিশেষ। তাই বিভিন্ন মাত্রা বা স্তরের পত্তনিদারগণ তাদের ঊর্ধ্বতন স্বার্থাধিকারীকে নিয়মিতভাবে ছাড়-খাজনা প্রদানের শর্তে জমির মালিক হন।


আরও এক ধরনের মধ্যবর্তী মধ্যস্বত্ব ছিল হাওলাস্বত্ব। দক্ষিণ বাংলার জেলাগুলিতে বনজঙ্গল ও জলা থেকে উদ্ধারকৃত বা উদ্ধারযোগ্য জমির জন্য এই ধরনের মধ্যস্বত্ব প্রথার প্রচলন ঘটে। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে জমির ওপর চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে। জমির ওপর জনসংখ্যার এই চাপের কারণে আজকের সুন্দরবন অঞ্চলে এবং বৃহত্তর নোয়াখালী, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ, খুলনা ও যশোর জেলার জমি পুনরুদ্ধার করার তৎপরতা দেখা দেয়। আর এক্ষেত্রে মূল বনজঙ্গল পরিষ্কারের অঞ্চলগুলির মধ্যে কেন্দ্রীয় এলাকা ছিল বাকেরগঞ্জ। সুন্দরবন অঞ্চলে সীমান্তবর্তী জমিদারগণ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আর এই তৎপরতার আওতায় বনজঙ্গল পরিষ্কার করে উদ্ধারকৃত জমিকে হাওলা নামে অভিহিত করা হয়। এই হাওলার মালিক বা হাওলাদারগণ আশপাশের জেলাগুলি থেকে জমিহীন চাষিদেরকে ঐসব জমি উদ্ধার ও আবাদযোগ্য করার কাজে নিয়োজিত করার জন্য নিয়ে আসেন। এসব পথিকৃৎ ও উদ্যমী চাষিকে বনজঙ্গল সাফ, জলা থেকে জমি উদ্ধার ও আবাদযোগ্য করে তোলার কাজে প্রাণিত করার জন্য তাদেরকে উদ্ধারকৃত ঐ জমিতে স্থায়ী মধ্যস্বত্বাধিকার দেওয়া হয়। ওসাত হাওলাদার নামে দ্বিতীয় স্তরেরও এক শ্রেণির হাওলাদারের সৃষ্টি হয়। ওসাত হাওলাদারের পরের স্তরের হাওলাদারদের নিম-ওসাত হাওলাদার বা এরকম আরও কিছু নাম দেওয়া হয়। এভাবে উনিশ শতকে দক্ষিণ বাংলায় স্থায়ী মধ্যস্বত্বাধিকার লাভের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন স্তরের কিছু ভূ-সম্পত্তিগত স্বার্থধারী শ্রেণি বিকাশ লাভ করে। অনেকে এরকমভাবে জঙ্গল পরিষ্কার করে ভূমি পুনরুদ্ধার ও আবাদযোগ্য করার মাধ্যমে জমিতে মধ্যস্বত্ব ও উপ-মধ্যস্বত্বাধিকার সৃষ্টিকে উপসামন্তায়ন বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এ ধরনের নামকরণ সম্ভবত ঠিক নয়, কারণ উপসামন্তায়ন একটি সামন্ততান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কিন্তু হাওলা বলতে বোঝায় একটি পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থা। কেননা এ ধরনের মধ্যস্বত্বাধিকারী হাওলাদারগণ বনজঙ্গল ও জলাভূমি থেকে জমি উদ্ধার, পরিষ্কার ও আবাদযোগ্য করার কাজে তাদের পুঁজি ও শ্রম নিয়োজিত করেন।
আরও এক ধরনের মধ্যবর্তী মধ্যস্বত্ব ছিল হাওলাস্বত্ব। দক্ষিণ বাংলার জেলাগুলিতে বনজঙ্গল ও জলা থেকে উদ্ধারকৃত বা উদ্ধারযোগ্য জমির জন্য এই ধরনের মধ্যস্বত্ব প্রথার প্রচলন ঘটে। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে জমির ওপর চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে। জমির ওপর জনসংখ্যার এই চাপের কারণে আজকের সুন্দরবন অঞ্চলে এবং বৃহত্তর নোয়াখালী, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ, খুলনা ও যশোর জেলার জমি পুনরুদ্ধার করার তৎপরতা দেখা দেয়। আর এক্ষেত্রে মূল বনজঙ্গল পরিষ্কারের অঞ্চলগুলির মধ্যে কেন্দ্রীয় এলাকা ছিল বাকেরগঞ্জ। সুন্দরবন অঞ্চলে সীমান্তবর্তী জমিদারগণ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আর এই তৎপরতার আওতায় বনজঙ্গল পরিষ্কার করে উদ্ধারকৃত জমিকে হাওলা নামে অভিহিত করা হয়। এই হাওলার মালিক বা হাওলাদারগণ আশপাশের জেলাগুলি থেকে জমিহীন চাষিদেরকে ঐসব জমি উদ্ধার ও আবাদযোগ্য করার কাজে নিয়োজিত করার জন্য নিয়ে আসেন। এসব পথিকৃৎ ও উদ্যমী চাষিকে বনজঙ্গল সাফ, জলা থেকে জমি উদ্ধার ও আবাদযোগ্য করে তোলার কাজে প্রাণিত করার জন্য তাদেরকে উদ্ধারকৃত ঐ জমিতে স্থায়ী মধ্যস্বত্বাধিকার দেওয়া হয়। ওসাত হাওলাদার নামে দ্বিতীয় স্তরেরও এক শ্রেণির হাওলাদারের সৃষ্টি হয়। ওসাত হাওলাদারের পরের স্তরের হাওলাদারদের নিম-ওসাত হাওলাদার বা এরকম আরও কিছু নাম দেওয়া হয়। এভাবে উনিশ শতকে দক্ষিণ বাংলায় স্থায়ী মধ্যস্বত্বাধিকার লাভের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন স্তরের কিছু ভূ-সম্পত্তিগত স্বার্থধারী শ্রেণি বিকাশ লাভ করে। অনেকে এরকমভাবে জঙ্গল পরিষ্কার করে ভূমি পুনরুদ্ধার ও আবাদযোগ্য করার মাধ্যমে জমিতে মধ্যস্বত্ব ও উপ-মধ্যস্বত্বাধিকার সৃষ্টিকে উপসামন্তায়ন বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এ ধরনের নামকরণ সম্ভবত ঠিক নয়, কারণ উপসামন্তায়ন একটি সামন্ততান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কিন্তু হাওলা বলতে বোঝায় একটি পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থা। কেননা এ ধরনের মধ্যস্বত্বাধিকারী হাওলাদারগণ বনজঙ্গল ও জলাভূমি থেকে জমি উদ্ধার, পরিষ্কার ও আবাদযোগ্য করার কাজে তাদের পুঁজি ও শ্রম নিয়োজিত করেন।
২৮ নং লাইন: ২৮ নং লাইন:
১৯৪০-এর দশক ও তার পরবর্তীকালে জমির মধ্যস্বত্বের প্রশ্নটি এক নতুন মাত্রা লাভ করে। একে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হতে থাকে। সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক শ্রেণী জমিদারি ও মধ্যবর্তী মধ্যস্বত্বাধিকার সরাসরি লোপের পক্ষে এবং রায়ত স্বার্থকে অন্তত তাত্ত্বিকভাবে হলেও জমির নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির অভিব্যক্তি বা বহিঃপ্রকাশ ঘটে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ আইনে। ১৯৫০ সালের এই আইনে সকল জমিদারি ও মধ্যবর্তী ভূমি মধ্যস্বত্বাধিকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয় এবং রায়ত বা প্রজাদেরকে মালিক বা জমির অধিকারী বলে ঘোষণা করা হয়। সার্বভৌম স্বত্বাধিকারে রাষ্ট্র হয়ে ওঠে খাজনা সংগ্রাহক কর্তৃপক্ষ। সরকার খাজনার পরিবর্তে এখন রাজস্ব আদায় করতে থাকে। মালিকও আর প্রজা রইলেন না। তাই তিনি খাজনা নয়, ভূমিরাজস্ব প্রদান করতে থাকেন। এরপরও প্রজাস্বত্বের প্রশ্নে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ আইনের আওতায় অনেক বিষয় থেকে যায় অমীমাংসিত।
১৯৪০-এর দশক ও তার পরবর্তীকালে জমির মধ্যস্বত্বের প্রশ্নটি এক নতুন মাত্রা লাভ করে। একে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হতে থাকে। সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক শ্রেণী জমিদারি ও মধ্যবর্তী মধ্যস্বত্বাধিকার সরাসরি লোপের পক্ষে এবং রায়ত স্বার্থকে অন্তত তাত্ত্বিকভাবে হলেও জমির নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির অভিব্যক্তি বা বহিঃপ্রকাশ ঘটে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ আইনে। ১৯৫০ সালের এই আইনে সকল জমিদারি ও মধ্যবর্তী ভূমি মধ্যস্বত্বাধিকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয় এবং রায়ত বা প্রজাদেরকে মালিক বা জমির অধিকারী বলে ঘোষণা করা হয়। সার্বভৌম স্বত্বাধিকারে রাষ্ট্র হয়ে ওঠে খাজনা সংগ্রাহক কর্তৃপক্ষ। সরকার খাজনার পরিবর্তে এখন রাজস্ব আদায় করতে থাকে। মালিকও আর প্রজা রইলেন না। তাই তিনি খাজনা নয়, ভূমিরাজস্ব প্রদান করতে থাকেন। এরপরও প্রজাস্বত্বের প্রশ্নে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ আইনের আওতায় অনেক বিষয় থেকে যায় অমীমাংসিত।


'''১৯৫০-পরবর্তী সময়ে ভূমিস্বত্ব''' ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রাদেশিক আইন পরিষদে পাশকৃত পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০, ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন সংক্রান্ত ইতিহাসে ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই আইনে সরকার ও জমি চাষকারী কৃষকের মধ্যবর্তী খাজনা গ্রহণকারী সকল প্রকার স্বত্ব অধিগ্রহণপূর্বক জমিদারি প্রথার বিলোপ সাধন করা হয়। প্রজাদের সরাসরি সরকারের অধীনে আনয়ন করা হয়। নতুন আইনের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সরকার ও রায়তের মধ্যে পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যের পরিবর্তন।
'''''১৯৫০-পরবর্তী সময়ে ভূমিস্বত্ব''''' ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রাদেশিক আইন পরিষদে পাশকৃত পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০, ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন সংক্রান্ত ইতিহাসে ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই আইনে সরকার ও জমি চাষকারী কৃষকের মধ্যবর্তী খাজনা গ্রহণকারী সকল প্রকার স্বত্ব অধিগ্রহণপূর্বক জমিদারি প্রথার বিলোপ সাধন করা হয়। প্রজাদের সরাসরি সরকারের অধীনে আনয়ন করা হয়। নতুন আইনের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সরকার ও রায়তের মধ্যে পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যের পরিবর্তন।


জমিদারি প্রথার বিলোপ এই অঞ্চলে রায়তওয়ারি পদ্ধতি প্রবর্তনের পথ সৃষ্টি করে। সরকার ঊর্ধ্বতন ভূম্যধিকারীর মর্যাদায় থেকে যায় এবং প্রজা বা রায়তগণ সরকারের অধীনে ভূমির মালিকানা বা দখলিস্বত্ব লাভ করেন। রায়তগণ সরকারকে সরাসরি রাজস্ব প্রদান করে থাকেন, এবং বন্দোবস্ত প্রদানের উপযোগী জমি সরকারের প্রতিনিধি জেলা কালেক্টরদের মাধ্যমে সরাসরি প্রজাদের নিকট বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়ে থাকে। কবুলিয়ত নামে পরিচিত বন্দোবস্ত দলিলের শর্তানুযায়ী প্রজাদের অধিকার ও দায়িত্বাবলি নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে এবং আদালতের মাধ্যমে এই কবুলিয়ত কার্যকর করা হয়।
জমিদারি প্রথার বিলোপ এই অঞ্চলে রায়তওয়ারি পদ্ধতি প্রবর্তনের পথ সৃষ্টি করে। সরকার ঊর্ধ্বতন ভূম্যধিকারীর মর্যাদায় থেকে যায় এবং প্রজা বা রায়তগণ সরকারের অধীনে ভূমির মালিকানা বা দখলিস্বত্ব লাভ করেন। রায়তগণ সরকারকে সরাসরি রাজস্ব প্রদান করে থাকেন, এবং বন্দোবস্ত প্রদানের উপযোগী জমি সরকারের প্রতিনিধি জেলা কালেক্টরদের মাধ্যমে সরাসরি প্রজাদের নিকট বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়ে থাকে। কবুলিয়ত নামে পরিচিত বন্দোবস্ত দলিলের শর্তানুযায়ী প্রজাদের অধিকার ও দায়িত্বাবলি নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে এবং আদালতের মাধ্যমে এই কবুলিয়ত কার্যকর করা হয়।
৬০ নং লাইন: ৬০ নং লাইন:
বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়-এর মতো সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে অনেক প্রজাই তাদের ক্ষুদ্র জোত বিক্রয় করতে বাধ্য হতেন। এসব দরিদ্র প্রজাদের কষ্ট লাঘবের জন্য ১৯৮৯ সালে ঋণ সালিসি আইন নামে একটি আইন পাস করা হয়। সরকার এবং ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের প্রতিনিধি সমন্বয়ে প্রতি থানায় একটি করে ঋণ সালিসি বোর্ড গঠন করার জন্য এই আইনে বিধান করা হয়। কয়েক প্রকারের জমি বিক্রয় অবৈধ ঘোষণা করা ও বোর্ডকে অন্য কয়েক প্রকারের বন্ধক ৭ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর মালিক বরাবর প্রত্যর্পণ করার আদেশ প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফসলের অগ্রিম ক্রয় এবং সাদা কাগজে স্বাক্ষর অথবা টিপসহি নিয়ে তা সংরক্ষণ করার বিষয়টি বাতিল ঘোষণা করা হয়।
বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়-এর মতো সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে অনেক প্রজাই তাদের ক্ষুদ্র জোত বিক্রয় করতে বাধ্য হতেন। এসব দরিদ্র প্রজাদের কষ্ট লাঘবের জন্য ১৯৮৯ সালে ঋণ সালিসি আইন নামে একটি আইন পাস করা হয়। সরকার এবং ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের প্রতিনিধি সমন্বয়ে প্রতি থানায় একটি করে ঋণ সালিসি বোর্ড গঠন করার জন্য এই আইনে বিধান করা হয়। কয়েক প্রকারের জমি বিক্রয় অবৈধ ঘোষণা করা ও বোর্ডকে অন্য কয়েক প্রকারের বন্ধক ৭ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর মালিক বরাবর প্রত্যর্পণ করার আদেশ প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফসলের অগ্রিম ক্রয় এবং সাদা কাগজে স্বাক্ষর অথবা টিপসহি নিয়ে তা সংরক্ষণ করার বিষয়টি বাতিল ঘোষণা করা হয়।


'''আদিবাসীদের ভূমিস্বত্ব'''  ব্রিটিশ শাসনামলে নিজ নিজ দখলি ভূমির উপর আদিবাসীদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত ছিল। অবশ্য দখলি জমির মালিকানা দলিল নিয়ে তাদের তেমন ভাবনা ছিল না। জমির অর্থনৈতিক মূল্য সম্বন্ধে তাদের সচেতনতাও ছিল সামান্য। ১৯০৮ সালের ছোট নাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন ছিল তাদের জমাজমির রক্ষাকবচ। এই আইনে আদিবাসীদের জমি জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া বিক্রয় বা হস্তান্তর ছিল অবৈধ। ১৯৭৭ সালে দেশের উত্তরাঞ্চলে ‘উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি’ নামে একটি সংস্থা গঠিত হয়। আদিবাসীদের জমিজমা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে এই সংস্থার অনুমতি লাভের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাস্তবে এই বিধান প্রায়ই উপেক্ষা করে উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা দুরবস্থার সময় তাদের জমিজমা বিক্রয় করে ফেলে। আদিবাসী [[গারো|গারো]] দের মাতৃসূত্রীয় পরিবারে মহিলারাই হচ্ছেন জমিজমার মালিক। আর এ জন্য অনেক অ-উপজাতি ব্যক্তি সম্পত্তির লোভে গারো মহিলাদের বিয়ে করে থাকেন।
'''''আদিবাসীদের ভূমিস্বত্ব'''''  ব্রিটিশ শাসনামলে নিজ নিজ দখলি ভূমির উপর আদিবাসীদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত ছিল। অবশ্য দখলি জমির মালিকানা দলিল নিয়ে তাদের তেমন ভাবনা ছিল না। জমির অর্থনৈতিক মূল্য সম্বন্ধে তাদের সচেতনতাও ছিল সামান্য। ১৯০৮ সালের ছোট নাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন ছিল তাদের জমাজমির রক্ষাকবচ। এই আইনে আদিবাসীদের জমি জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া বিক্রয় বা হস্তান্তর ছিল অবৈধ। ১৯৭৭ সালে দেশের উত্তরাঞ্চলে ‘উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি’ নামে একটি সংস্থা গঠিত হয়। আদিবাসীদের জমিজমা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে এই সংস্থার অনুমতি লাভের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাস্তবে এই বিধান প্রায়ই উপেক্ষা করে উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা দুরবস্থার সময় তাদের জমিজমা বিক্রয় করে ফেলে। আদিবাসী [[গারো|গারো]] দের মাতৃসূত্রীয় পরিবারে মহিলারাই হচ্ছেন জমিজমার মালিক। আর এ জন্য অনেক অ-উপজাতি ব্যক্তি সম্পত্তির লোভে গারো মহিলাদের বিয়ে করে থাকেন।


টাঙ্গাইল জেলার [[মধুপুর গড়|মধুপুর]] বনাঞ্চলের অধিকাংশ আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ভুক্ত। এদের অনেকেই তাদের বাস্ত্তভিটা এবং চাষযোগ্য উঁচু জমির জন্য কখনও কোন দলিল গ্রহণ করা প্রয়োজন মনে করে নি। ধান আবাদযোগ্য জমির অধিকাংশই তারা দলিলের মাধ্যমে লাভ করত এবং কর প্রদান করে ভোগদখল করত। ১৯২৭ সালের বন আইনের (Forest Act, 1927-Act-XVI of 1927) অধীনে তারা দখলিস্বত্ব লাভ করে এবং ষাট বছর পর্যন্ত উঁচু জমির দখলে বহাল থাকার অধিকার লাভ করে। তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাস ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কেউ ছিল না। নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি ও কৃষি কাজ নিয়ে তারা অরণ্যসন্তান হিসেবে বসবাস করত। মধুপুরের আদিবাসীরা নাটোরের রাজার (জমিদার) নিয়ন্ত্রণে এলে তাদের কর ও শ্রমের বিনিময়ে বনভূমিতে বসবাস করার অনুমতি দেওয়া হয়। বনের উৎকর্ষ সংরক্ষণ সাপেক্ষে তাদের জুম (জঙ্গল কেটে তা পুড়িয়ে ও পরিষ্কার করে চাষাবাদ (slash-and-burn cultivation) চাষেরও অনুমতি প্রদান করা হয়। গারোদের তাদের দখলি জমির জন্য জমিদার কর্তৃক পাট্টা প্রদান করা হতো। পাট্টা পদ্ধতিতে তারা কর প্রদানপূর্বক জমি চাষাবাদ করতে পারত এবং উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তর করতে পারত; কিন্তু জমি বিক্রি করার অধিকার লাভ করত না। অবশ্য সাধারণের ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জমি ক্ষতিপূরণ প্রদান না করেই জমিদার পাট্টাকৃত জমির আংশিক বা সম্পূর্ণ ফিরিয়ে নিতে পারতেন। দীর্ঘদিন ধরে জমিতে ধান চাষ করে এবং নিয়মিত কর পরিশোধ করে গারোগণ জমিতে অধিকতর স্থায়ী অধিকার হিসেবে পত্তন লাভ করে। পত্তন পদ্ধতিতে তারা জমি বিক্রয় করতে পারত এবং জমিদার কর্তৃক জমি ফেরত নেওয়া হলে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারত। পত্তন অবশ্য জুমচাষের ক্ষেত্রে কার্যকর ছিল না।
টাঙ্গাইল জেলার [[মধুপুর গড়|মধুপুর]] বনাঞ্চলের অধিকাংশ আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ভুক্ত। এদের অনেকেই তাদের বাস্ত্তভিটা এবং চাষযোগ্য উঁচু জমির জন্য কখনও কোন দলিল গ্রহণ করা প্রয়োজন মনে করে নি। ধান আবাদযোগ্য জমির অধিকাংশই তারা দলিলের মাধ্যমে লাভ করত এবং কর প্রদান করে ভোগদখল করত। ১৯২৭ সালের বন আইনের (Forest Act, 1927-Act-XVI of 1927) অধীনে তারা দখলিস্বত্ব লাভ করে এবং ষাট বছর পর্যন্ত উঁচু জমির দখলে বহাল থাকার অধিকার লাভ করে। তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাস ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কেউ ছিল না। নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি ও কৃষি কাজ নিয়ে তারা অরণ্যসন্তান হিসেবে বসবাস করত। মধুপুরের আদিবাসীরা নাটোরের রাজার (জমিদার) নিয়ন্ত্রণে এলে তাদের কর ও শ্রমের বিনিময়ে বনভূমিতে বসবাস করার অনুমতি দেওয়া হয়। বনের উৎকর্ষ সংরক্ষণ সাপেক্ষে তাদের জুম (জঙ্গল কেটে তা পুড়িয়ে ও পরিষ্কার করে চাষাবাদ (slash-and-burn cultivation) চাষেরও অনুমতি প্রদান করা হয়। গারোদের তাদের দখলি জমির জন্য জমিদার কর্তৃক পাট্টা প্রদান করা হতো। পাট্টা পদ্ধতিতে তারা কর প্রদানপূর্বক জমি চাষাবাদ করতে পারত এবং উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তর করতে পারত; কিন্তু জমি বিক্রি করার অধিকার লাভ করত না। অবশ্য সাধারণের ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জমি ক্ষতিপূরণ প্রদান না করেই জমিদার পাট্টাকৃত জমির আংশিক বা সম্পূর্ণ ফিরিয়ে নিতে পারতেন। দীর্ঘদিন ধরে জমিতে ধান চাষ করে এবং নিয়মিত কর পরিশোধ করে গারোগণ জমিতে অধিকতর স্থায়ী অধিকার হিসেবে পত্তন লাভ করে। পত্তন পদ্ধতিতে তারা জমি বিক্রয় করতে পারত এবং জমিদার কর্তৃক জমি ফেরত নেওয়া হলে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারত। পত্তন অবশ্য জুমচাষের ক্ষেত্রে কার্যকর ছিল না।

০৪:৫৮, ২ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

ভূমিস্বত্ব সম্পর্ক  রাষ্ট্র কিংবা কোন ব্যক্তি-স্বত্বাধিকারী কর্তৃক নির্দিষ্ট শর্তে জোত বা জমিজমার মালিকানা গ্রহণ। বঙ্গীয় বদ্বীপ তথা আজকের বাংলাদেশ মূলত নদনদীর পলি দ্বারা গঠিত অঞ্চল। এ বদ্বীপটি ঐতিহাসিকভাবে ভাল ফসল ও কৃষিভিত্তিক নানা শিল্পপণ্যের জন্য সুপরিচিত। শিল্পবিপ্লব-পূর্ব বিশ্বে কৃষি ছিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল বুনিয়াদ। তখন কৃষিভিত্তিক অঞ্চলরূপে বাংলা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ও মর্যাদার অধিকারী ছিল। এদেশে ঐতিহাসিক কালানুক্রমে লক্ষ্য করা যায় যে কৃষি ও অন্যান্য সম্পদের আকর্ষণে দেশ-দেশান্তর থেকে নানা সময়ে বাণিজ্য ও সমরাভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানকারীরা প্রায় ক্ষেত্রেই এদেশে তাদের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ও তাদের নিজস্ব ধারায় এদেশ শাসন করে। ভূমিই রাষ্ট্রীয় রাজস্বের প্রধান উৎস হওয়ায় বাংলার ক্ষমতাসীন শাসকবর্গ সর্বদাই সচেতনভাবে প্রচলিত ভূমিসংস্কার ব্যবস্থাকে তাদের নিজ নিজ সুবিধা অনুযায়ী রদবদল করে নেওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। তাই বাংলার গোটা ইতিহাসে একই ধরনের ভূমিব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায় না। এ দেশের কোন শাসকবংশই পুরানো ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা পুরোপুরি যেমন গ্রহণ করে নি, তেমনি পুরোপুরি নতুন কোন ব্যবস্থাও প্রবর্তন করে নি। তাই নিরবচ্ছিন্নতা ও পরিবর্তন বরাবরই ছিল বাংলার ভূমিব্যবস্থার যুগপৎ বৈশিষ্ট্য।

প্রাচীনকাল জমি মালিকানার বিষয়ে ভারততত্ত্ববিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কোন কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে রাজাই জমির মালিক। আবার কারও মতে, চাষিই জমির মালিক। তৃতীয় এক অভিমত অনুযায়ী, রাজা বা চাষিরা নয়, জমির প্রকৃত মালিক গ্রামের জনসমাজ। গ্রামীণ জনসমাজের জমি মালিকানার তত্ত্বটি অবশ্য বিনা প্রশ্নেই বাতিল করে দেওয়া যায় এই কারণে যে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের জনসমাজ যেভাবে গড়ে উঠেছে বাংলার জনসমাজ সেভাবে বিকশিত হয় নি। পন্ডিতরা মনে করেন, বাংলার প্রাচীন জনবসতিগুলি খুবই বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠে। বিভিন্ন খানায় বিভক্তি ও পরিবারের বিক্ষিপ্ত অবস্থানের কারণে সামাজিক সংগঠন তেমন নিবিড় বুনটে গড়ে উঠতে পারে নি। চাষিদের জমির মালিকানার তত্ত্বটি অংশত গ্রহণ করা যেতে পারে এই ভিত্তিতে যে, তারা বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারসূত্রে ও নিরবচ্ছিন্নভাবে রীতিমাফিক কিংবা রাজা প্রণীত আইনের ভিত্তিতে প্রদেয় অর্থ পরিশোধ করে ঐ জমি চাষাবাদ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জমির মালিকানা যুগ্মভাবে রাজা এবং চাষি উভয় তরফেরই ছিল অর্থাৎ রাজার জমিদারির সাথে সমন্বিত রূপে ছিল চাষির স্বত্বাধিকার। এক পক্ষের সে অধিকার হলো সার্বভৌমত্বের। আরেক পক্ষের অধিকার হলো প্রকৃত চাষির। চাষি তার জমিতে যা উৎপাদন করে তাতে রাজার অধিকারের বিষয়টি কেবল রাজার ক্ষমতাসাপেক্ষ নয় বরং ঐ জমিতে সেচ দেওয়ার প্রকল্প সংগঠন, ভূমি পুনরুদ্ধার উদ্যোগ এবং দেশের ভিতরের বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ও বাইরের হানাদারদের হামলা থেকে তাদের রক্ষাব্যবস্থার সংগঠনও তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। জমি মঞ্জুরি ও বিক্রয় সংক্রান্ত গুপ্তযুগের যেসব তাম্রফলক নিদর্শনের অস্তিত্ব আছে সেগুলির বেশির ভাগেই ভূমিতে রাজার অধিকারের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে।

রাজার করারোপের ক্ষমতাটি রীতিপ্রথা ও ধর্মশাস্ত্রের অনুশাসন দ্বারা সীমিত ছিল। রাজা একজন প্রজাকে তার জোতজমার দখল থেকে উৎখাত করতে পারতেন। আবার, তার এই ক্ষমতা ধর্মীয় বিধিনিষেধ ও তার নিজের আইন দ্বারা সীমিতও ছিল। তখন খাজনামুক্ত স্থায়িভূমি মধ্যস্বত্ব ছিল যা সাধারণত রাজা পুনর্গ্রহণ করতে পারতেন না। যেমন, এক্ষেত্রে জমির নিভি-ধর্ম মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা যায়। এই ধরনের ভূমি-মধ্যস্বত্ব সংঘ বা বিহার ইত্যাদি বা অন্যান্য দাতব্য উদ্দেশে প্রদান করা হতো। আর এরকম ভূমিস্বত্ব একবার মঞ্জুর করা হলে যে পক্ষকে এরকম ভূমিস্বত্ব মঞ্জুর করা হতো তাদের তরফে কোনরকম গুরুতর ক্রটি-বিচ্যুতি না ঘটা পর্যন্ত ঐ ভূমিস্বত্ব পুনর্গ্রহণ বা প্রত্যাহার করা যেত না। গুপ্ত শাসনামলের শেষের দিকে অবশ্য নিভি-ধর্ম ব্যবস্থার পাশাপাশি ভূমি ছিদ্রন্যায় মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। অবশ্য এই দুই ধরনের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে সুনিশ্চিত যে, উভয় ব্যবস্থাই ছিল রাজস্বমুক্ত মঞ্জুরি। এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য হতে পারত কেবল মঞ্জুরি প্রদানের সাথে সংশ্লিষ্ট শর্তাবলিতে।

পরবর্তীকালে, ব্যবহার ও উর্বরতা অনুযায়ী জমির শ্রেণিবিন্যস করা হতো। খ্রিস্টীয় আট শতকের আগের বিভিন্ন তাম্রফলক লিপিতে দেখা যায়, সে সময় জমি বিভক্ত ছিল প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে, আর এ শ্রেণিবিভক্তি ছিল রাষ্ট্র ও কৃষককুলের মধ্যকার সম্পর্কেরও নিয়ামক। এগুলি হলো বাস্ত্ত (বাস্ত্তভিটা), ক্ষেত্র (কৃষিজমি) ও খিল (আবাদযোগ্য পতিত জমি)। এসব শ্রেণির জমির জন্য রাজস্ব বা খাজনার কাঠামোও আলাদা ছিল। তবে জমি দান বা জমির বিক্রয় সংক্রান্ত উৎকীর্ণলিপিতে দেখা যায়, সকল শ্রেণির জমির দাম ছিল অভিন্ন। যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে জমির দামের ভিন্নতা না থাকার ধাঁধার কোন সমাধান পাওয়া না। বিভিন্ন উৎকীর্ণলিপিতে গোচর বা পশুচারণ ক্ষেত্র হিসেবে আরও একশ্রেণির জমির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, গোচর জমিও করমুক্ত ছিল। এই শ্রেণির জমিকে সাধারণ বা সামাজিক মালিকানাধীন জোত বিবেচনা করা হতো। উৎকীর্ণলিপিতে গোচর জমিকে সবসময়েই গ্রামের সীমায় দেখানো হয়েছে। এ থেকে ধরে নেওয়া যায়, গোচারণের জমিই কার্যত গ্রামের আবাদি জমির প্রান্তসীমা নির্দেশ করে।

মধ্যযুগ সুলতানি আমলের ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কিত তথ্যাদি প্রাচীন যুগের ভূমি বিবরণের মতোই অপ্রতুল। অবশ্য, এ বিষয় স্পষ্ট যে, সুলতানগণ পূর্ববর্তী ভূমি ব্যবস্থায় খুব বড়রকমের কোন পরিবর্তন সাধন করেননি যদিও তারা ভূমিস্বত্ব সম্পর্কিত অনেক নতুন পরিভাষার প্রবর্তন করেছিলেন। সুলতানগণ আগের মতোই অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি ভূমিরাজস্ব আদায় করেন আর এই কর সংগ্রহের কাজে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই ভূমিরাজস্ব আদায়ে অবশ্য মাজমাদার পদবিধারী মধ্যবর্তী একটি শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। এরা রাজস্ব আদায় কাজে সম্পর্কিত চাষি হিসেবে খাজনা-সংগ্রাহক কায়েমি স্বার্থের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করে। এই মাজমাদারি ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কতটা ব্যাপক ও সংগঠিত ছিল তা খুব স্পষ্ট না হলেও সুলতানগণ যে রাজস্ব আদায়ে সম্পর্কিত চাষিদের মাধ্যমে জমির খাজনা সংগ্রহ শুরু করেছিলেন তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বাংলার পূর্বাঞ্চলে কোন কোন উপকূলীয় এলাকায় কিছু পর্তুগিজকে (ফিরিঙ্গি) রাজস্ব আদায় কাজে সম্পর্কিত চাষি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, মাজমাদারগণ চিরস্থায়ী মধ্যস্বত্বধারী ছিলেন না। তাদেরকে একটা মেয়াদের জন্য নিযুক্ত করা হতো। এজন্য তাদেরকে চাষিদের কাছ থেকে আদায়কৃত মোট খাজনা থেকে শাহি রাজকোষে একটি নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ জমা দিতে হতো। ভারতের প্রাচীন শাসকদের নিভি-ধর্ম মধ্যস্বত্ব প্রদানের মতো সুলতানগণও ধর্মীয় ও দাতব্য সংগঠন এবং ব্যক্তিবিশেষকে লাখেরাজ বা নিষ্কর জমির মঞ্জুরি দিতেন, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের মঞ্জুরির ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল।

মুগল শাসকগণ ভূমি বন্দোবস্ত পদ্ধতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করেন। মুগল ব্যবস্থার আওতায় জমি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন হলেও অনেক ক্ষেত্রেই জমির ব্যক্তি বা বেসরকারি মালিকানা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। পন্ডিতদের বিশ্বাস, মুগল শাসকরা ব্যক্তিপর্যায়ে জমি বিক্রয় করে এবং তাদেরকে ঐ জমি বা ভূ-সম্পত্তির মালিক হিসেবে মেনে নিয়ে জমিজমার বেসরকারি মালিকানাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তবে এ ধরনের মালিকানা কোন প্রচলিত বিষয় ছিল না বরং ব্যতিক্রমই ছিল এবং সাধারণভাবে জমি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিই রয়ে গিয়েছিল। সরকার জমিদারতালুকদার নামে অভিহিত রাজস্ব সংগ্রাহক নিয়োগ করতেন। জমিদার ও তালুকদারগণ সাধারণত উত্তরাধিকারসূত্রে বংশানুক্রমে রাজস্ব আদায়ের অধিকার ভোগ করতেন। সরকারের অবশ্য সর্বদাই এ ধরনের রাজস্ব সংগ্রাহককে অপসারণ করার অধিকার থাকত। তবে তারা গুরুতর ও জটিল রকমে খেলাপি কিংবা অবাধ্য না হলে রাজস্ব সংগ্রাহক হিসেবে তাদের এ মধ্যস্বত্বাধিকার বংশপরম্পরায় অব্যাহত থাকত। এই জমিদার ও তালুকদারগণ কেবল রাজস্ব সংগ্রাহক ছিলেন। সরকার থেকে কোন নির্দেশ ছাড়া জমির খাজনার হার পরিবর্তনের কোন অধিকার তাদের ছিল না। পাট্টা ও কবুলিয়ত-এ সন্নিবিষ্ট শর্তাদির ভিত্তিতে জমিতে রীতিপ্রথামাফিক বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার ভোগ করত রায়ত। জমিতে মধ্যস্বত্বাধিকার সম্পর্কে বলা যায় যে, ঐ সময় প্রধানত দুই শ্রেণির রায়ত ছিল খুদকাশ্ত ও পাইকাশ্ত। খুদকাশ্ত রায়ত ছিল সংশ্লিষ্ট গ্রামের স্থায়ী অধিবাসী, জমিতে তাদের অধিকার ছিল রীতিপ্রথামাফিক। তাদের জমিতে স্থায়ী ভোগদখলস্বত্বের অধিকার যেমন ছিল তেমনি তারা কবুলিয়ত বা চুক্তির শর্তাদি পালনসাপেক্ষে বরাবর নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী ঐ জমির ব্যবহারও করতে পারত। পরগনার প্রমিত রাজস্বের হারে বা পরগনা নিরিখ-এ তাদের রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বা জমা শাহি কোষাগারে পরিশোধ করার অধিকার ছিল। পাইকাশ্তবর্গের রায়তগণ ছিল অনিবাসী চাষি যারা প্রতিযোগিতামূলক খাজনার হারে একটি মৌসুমের চাষাবাদের জন্য কৃষিজমির সন্ধানে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত। তারা জমির জন্য যে খাজনা বা রাজস্ব প্রদান করত তা ছিল খুদকাশ্ত রায়তদের প্রদেয় খাজনার তুলনায় অনেক কম। যেহেতু তারা মূলত যাযাবর ধরনের চাষি সেহেতু যে জমি তারা চাষ করত তাতে তাদের কোন অধিকার ছিল না।

মুগল ভূমি মধ্যস্বত্ব বন্দোবস্ত ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল জায়গির ব্যবস্থা। এর আওতায় জমি বা তালুক বরাদ্দ করা হতো। মুগল সম্রাটদের অভিজাত রাজকর্মকর্তাদেরকে নগদ অর্থে বেতন না দিয়ে প্রায় ক্ষেত্রেই তার পরিবর্তে জায়গির প্রদান করা হতো। জায়গির ছিল ভিন্ন ভিন্ন এলাকার তালুকবিশেষ যা থেকে অনুমিত হিসাব অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার জন্য বেতনের যে মঞ্জুরি রয়েছে তার সমপরিমাণ অর্থ আয় হিসেবে পাওয়া যেত। জায়গির সাধারণত বংশানুক্রমে উত্তরাধিকারমূলক ছিল না। জায়গির কি মেয়াদে বহাল থাকবে তাও নির্দিষ্ট বা নির্ধারিত ছিল না। তবে লক্ষ্য করা গেছে যে জায়গিরদারের গোটা জীবদ্দশার জন্যও জায়গির মঞ্জুর করা হয়েছে। ব্যক্তিবিশেষকে স্থায়ী ভোগদখলের জন্যও জায়গির মঞ্জুর করা হতো। জায়গিরদারগণ কার্যত মধ্যস্বত্বভোগী, এদের কেউ ছিল অস্থায়ী মেয়াদের, কেউবা স্থায়ী জায়গিরদার। রায়তদের কাছে জায়গিরদার ছিল জমিদারতুল্য। তারা জমিদারকে প্রদেয় খাজনার মতোই জায়গিরদারকে খাজনা বা রাজস্ব প্রদান করত। তবু জায়গিরদারের অধিকার কখনও রায়তের জন্য নির্ধারিত অধিকারগুলিকে প্রভাবিত বা পরিবর্তন করতে পারত না। এক্ষেত্রে রায়তের অধিকার রীতিপ্রথা ও আচার দ্বারা সংরক্ষিত থাকত। জায়গির ছাড়াও মুগল ভূমি ব্যবস্থায় লাখেরাজ বা নিষ্কর রাজস্ব মঞ্জুরিরও ব্যবস্থা ছিল। সাধারণত এ ব্যবস্থাটি মদদ-ই-মাশ (জীবনধারণ সাহায্যভাতা) নামে পরিচিত। বিদ্বান, জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ, ধর্মীয় সাধকপুরুষ এবং অভিজাত খানদানি বংশধারার যারা চাকরিতে নিয়োজিত হবেন না এমন ব্যক্তিদের মদদ-ই-মাশ মঞ্জুরি দেওয়া হতো। এরকম মঞ্জুরির বিনিময়ে সুবিধাভোগীর কাছ থেকে কোন সেবা আশা করা হতো না। মদদ-ই-মাশ হস্তান্তরযোগ্য ছিল না। এছাড়া আরও অন্যান্য ধরনের লাখেরাজ মঞ্জুরিও ছিল। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ইনাম-ই আত-তামঘা (রাজকর্মকর্তার পরিবারকে প্রদত্ত উত্তরাধিকারভিত্তিক মঞ্জুরি) এবং ওয়াক্ফ (ধর্মীয় পবিত্র স্থান, মাযার বা মাদ্রাসার মতো প্রতিষ্ঠানকে প্রদেয়)।

ব্রিটিশ আমল ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তনের আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভূমি মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থা নিয়ে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। দ্বৈত শাসনামলে (১৭৬৫-১৭৭২) রাজস্ব আদায়ের মুগল ব্যবস্থা মোটামুটি বহাল রাখা হয়। এই ব্যবস্থার আওতায় জমিদার, তালুকদার ও লাখেরাজদার প্রতিষ্ঠানকে তেমন কোন বড় রকমের পরিবর্তন ছাড়াই বহাল রাখা হয়। ১৭৯৩ সালে এই ঐতিহ্যবাহী ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন আনা হয়। এই পরিবর্তনের আওতায় জমির পুরানো মালিকদের পাশ কাটিয়ে খামার পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়। খামার পদ্ধতিতে জমির মালিকদেরকে তাদের জমির দখল থেকে সরিয়ে দিয়ে ঐ জমি বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য সর্বোচ্চ ডাকদাতাকে ইজারা দেওয়া হয়। তবে খামার পদ্ধতি সরকারের লক্ষ্য অর্জনে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়। ১৭৭৮ সালে জমিদারির অধিকারগুলি পুনরায় বলবৎ করা হয়। তবে এক্ষেত্রে বন্দোবস্ত দেওয়া হয় একটা সীমিত মেয়াদের জন্য মাত্র। এ মেয়াদ ছিল ন্যূনতম এক বছর থেকে সর্বাধিক তিন বছর। ১৭৮৪ সালের পিট-এর ভারত আইনের আওতায় কলকাতায় সরকারকে রাজস্ব প্রশাসন নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং জমিদার ও অন্যান্য সনাতন জমির মালিকদের সাথে রফা করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ঐ নির্দেশ অনুসারে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তন করা হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নিয়ামক প্রবিধানসমূহের আওতায় জমিদারগণ জমিতে তাদের স্বত্বাধিকার প্রাপ্ত হন। জমির মালিক হিসেবে এরপর থেকে জমিদার তার জমি অবাধে বিক্রয়, দান, ইজারা ইত্যাদি আকারে হস্তান্তর করার অধিকারী হন। জমিদারদের কাছে সরকারের রাজস্বের দাবি চিরস্থায়িভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়। জমিদারগণ তাদের জমিতে মালিকানার অধিকার পেলেও কোম্পানি সরকার জমিদারদের রায়তদের মর্যাদা কী হবে সে বিষয়ে নীরব থাকে। অথচ মুগল আমলে এই রায়তদের তাদের জমিতে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার ছিল এবং তাদের প্রদেয় খাজনার হার রীতিপ্রথা ও আচার অনুযায়ী নির্ধারিত ছিল। আর নীতিমাফিক নির্ধারিত হার জমিদার ও অন্যান্য খাজনা আদায়কারী প্রতিনিধিমূলক প্রতিষ্ঠান তাদের ইচ্ছামতো বদলাতে পারত না। অবশ্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে নিয়ামক প্রবিধানগুলিতে কৃষক সমাজের লোকজন এতদিন ঐতিহ্যগতভাবে যে অধিকার ভোগ করে আসছিল সেই একই অধিকার তাদের এখন রইল কি-না এতে সে বিষয়টির কোন সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। এর পরিণামে দেওয়ানি আদালতে বিচারকগণ রায়তদের রীতিপ্রথা অনুযায়ী অধিকারের বিষয়ে পরস্পরবিরোধী রায় দিতে থাকেন। কোন কোন আদালত এই মর্মে মত প্রকাশ করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিতে চাষির রীতিপ্রথাগত অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় নি। আবার কিছু আদালত ঠিক এর বিপরীত অভিমত প্রকাশ করেন। এইসব আদালতের মতে জমিতে জমিদারের মালিকানা-অধিকার প্রদত্ত হওয়ার কারণে রায়তদের রীতিপ্রথামাফিক অধিকারগুলির অবসান ঘটেছে। কেননা রায়তগণ অতঃপর জমিদারের ইচ্ছাধীন প্রজায় পরিণত হন।

মধ্যবর্তী ভূমি স্বত্বাধিকারীর আবির্ভাব  মালিকানার অধিকার সম্বলিত জমিদারি ভূমিব্যবস্থার কারণে অচিরেই মধ্যবর্তী এক ভূমিস্বত্ব প্রথার আবির্ভাব ঘটে। জমিদার ও জমির প্রকৃত চাষির মধ্যে মধ্যবর্তী ভূমিস্বত্বাধিকারী অবস্থান নেওয়ায় জমিদার ও চাষিরা পৃথক হয়ে যায়। জমিদার ও চাষির মধ্যবর্তী স্বার্থধারীরা তাদের অধিকারগুলি একে অন্যের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে প্রায় ক্ষেত্রেই তারা নিজেরাও কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চাপের মুখে বহু জমিদারি প্রকাশ্য নিলামে বিক্রয় হয়ে যায়। সরকারি রাজস্ব যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থতার ফলে জমিদারি হারানোর আতঙ্কে বহু জমিদার নগদ সোলামি ও এক ধরনের ছাড়-খাজনার বিনিময়ে নিজ নিজ জমিদারিতে স্থায়ী নানা ভূমিস্বত্ব সৃষ্টি করেন। এই অভিনব ব্যবস্থা গ্রহণে পথিকৃৎ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বর্ধমানের রাজা। তিনি পত্তনি নামে এক ধরনের অভিনব মধ্যস্বত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। রাজা তার গোটা জমিদারিকে কয়েকটি ভাগ বা লটে বিভক্ত করেন। প্রতিটি লট একেক জন মধ্যস্বত্বধারীকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। তাতে শর্ত থাকে যে, তিনি চিরস্থায়িভাবে নির্ধারিত একটি খাজনা হারের সুবিধা ভোগ করবেন। তাকে এই যে আনুকূল্য বা সুবিধা দেওয়া হলো তার পরিবর্তে তাকে একটি অঙ্কের নগদ সোলামি প্রদান করতে হবে, আর এই শর্ত থাকবে যে, তিনি যদি যথাসময়ে খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হন তাহলে তার মধ্যস্বত্বাধিকার নিলামে বিক্রয় হবে। এই পত্তনি ব্যবস্থা বর্ধমানের রাজাকে সূর্যাস্ত আইনের কবল থেকে রক্ষা করে। আর তাতে তিনি যথেষ্ট অবস্থাপন্ন হতেও সক্ষম হন। তার এই সাফল্যে অন্যান্য জমির মালিকগণ প্রভাবিত হন ও তারাও রাজার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। এভাবে তারা পত্তনি ধরনের একাধিক মধ্যবর্তী ভূমিস্বত্বের সৃষ্টি করেন। পত্তনি ভূমিস্বত্বাধিকারীরা আবার তাদের নিজেদের দিক থেকেই একের পর এক দ্বিতীয় ও তৃতীয় এমনকি চতুর্থ স্তরের পত্তনিদার সৃষ্টি করেন। আর এভাবেই জমিদারি মধ্যস্বত্ব ও রায়তি অধিকারের মধ্যে স্থায়ী মধ্যবর্তী একাধিক অধিকারের সৃষ্টি হয়। আইনের দৃষ্টিতে পত্তনি মধ্যস্বত্বাধিকার ছিল সম্পত্তির অধীন সম্পত্তিবিশেষ। তাই বিভিন্ন মাত্রা বা স্তরের পত্তনিদারগণ তাদের ঊর্ধ্বতন স্বার্থাধিকারীকে নিয়মিতভাবে ছাড়-খাজনা প্রদানের শর্তে জমির মালিক হন।

আরও এক ধরনের মধ্যবর্তী মধ্যস্বত্ব ছিল হাওলাস্বত্ব। দক্ষিণ বাংলার জেলাগুলিতে বনজঙ্গল ও জলা থেকে উদ্ধারকৃত বা উদ্ধারযোগ্য জমির জন্য এই ধরনের মধ্যস্বত্ব প্রথার প্রচলন ঘটে। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে জমির ওপর চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে। জমির ওপর জনসংখ্যার এই চাপের কারণে আজকের সুন্দরবন অঞ্চলে এবং বৃহত্তর নোয়াখালী, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ, খুলনা ও যশোর জেলার জমি পুনরুদ্ধার করার তৎপরতা দেখা দেয়। আর এক্ষেত্রে মূল বনজঙ্গল পরিষ্কারের অঞ্চলগুলির মধ্যে কেন্দ্রীয় এলাকা ছিল বাকেরগঞ্জ। সুন্দরবন অঞ্চলে সীমান্তবর্তী জমিদারগণ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আর এই তৎপরতার আওতায় বনজঙ্গল পরিষ্কার করে উদ্ধারকৃত জমিকে হাওলা নামে অভিহিত করা হয়। এই হাওলার মালিক বা হাওলাদারগণ আশপাশের জেলাগুলি থেকে জমিহীন চাষিদেরকে ঐসব জমি উদ্ধার ও আবাদযোগ্য করার কাজে নিয়োজিত করার জন্য নিয়ে আসেন। এসব পথিকৃৎ ও উদ্যমী চাষিকে বনজঙ্গল সাফ, জলা থেকে জমি উদ্ধার ও আবাদযোগ্য করে তোলার কাজে প্রাণিত করার জন্য তাদেরকে উদ্ধারকৃত ঐ জমিতে স্থায়ী মধ্যস্বত্বাধিকার দেওয়া হয়। ওসাত হাওলাদার নামে দ্বিতীয় স্তরেরও এক শ্রেণির হাওলাদারের সৃষ্টি হয়। ওসাত হাওলাদারের পরের স্তরের হাওলাদারদের নিম-ওসাত হাওলাদার বা এরকম আরও কিছু নাম দেওয়া হয়। এভাবে উনিশ শতকে দক্ষিণ বাংলায় স্থায়ী মধ্যস্বত্বাধিকার লাভের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন স্তরের কিছু ভূ-সম্পত্তিগত স্বার্থধারী শ্রেণি বিকাশ লাভ করে। অনেকে এরকমভাবে জঙ্গল পরিষ্কার করে ভূমি পুনরুদ্ধার ও আবাদযোগ্য করার মাধ্যমে জমিতে মধ্যস্বত্ব ও উপ-মধ্যস্বত্বাধিকার সৃষ্টিকে উপসামন্তায়ন বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এ ধরনের নামকরণ সম্ভবত ঠিক নয়, কারণ উপসামন্তায়ন একটি সামন্ততান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কিন্তু হাওলা বলতে বোঝায় একটি পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থা। কেননা এ ধরনের মধ্যস্বত্বাধিকারী হাওলাদারগণ বনজঙ্গল ও জলাভূমি থেকে জমি উদ্ধার, পরিষ্কার ও আবাদযোগ্য করার কাজে তাদের পুঁজি ও শ্রম নিয়োজিত করেন।

জমিদার ও রায়তদের মধ্যবর্তী স্থলে যেসব মধ্যবর্তী ভূমিস্বত্বাধিকার সৃষ্টি হয় সেগুলির কোন আইনসঙ্গত বুনিয়াদ ছিল না। সরকার ১৮১৯ সালের ৮নং নিয়ামক প্রবিধানের আওতায় পত্তনিধারার মধ্যবর্তী ভূমি মধ্যস্বত্বাধিকারীদের স্বীকৃতি দেন। হাওলাদার শ্রেণির ভূমি মধ্যস্বত্বাধিকারীরাও বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ১৮৮৫-এ স্বীকৃতি লাভ করে। তবে এই মধ্যবর্তী ভূমি মধ্যস্বত্বাধিকারী শ্রেণীর আবির্ভাবের ফলে রায়তি রীতিপ্রথাগত অধিকার গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর আগে জমিদারগণ রায়তদের রীতিপ্রথাগত অধিকার মেনে নিতে চান নি। এখন তাদের সাথে যোগ দেন এই মধ্যবর্তী ভূমিস্বত্বাধিকারীরা যারা রায়তদের অধিকারের বিরুদ্ধে অধিকতর সংগঠিত ও বিন্যস্ত ছিল। এই পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার কারণে ১৮৭০-এর দশকে ধারাবাহিকভাবে একাধিক কৃষক অসন্তোষ, আন্দোলন ও গোলযোগের সৃষ্টি হতে থাকে। ১৯৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে প্রধানত এসব কৃষক আন্দোলনের প্রতিবিধায়ক ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছিল। রায়তদের অধিকারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এই আইন তাদেরকে দুটি বড় রকমের শ্রেণিতে বিভক্ত করেছে। একটি হলো দখলদার রায়ত ও আর একটি অদখলদার রায়ত। কোন রায়ত নিরবচ্ছিন্নভাবে একনাগাড়ে বারো বছর কোন জোতের ভোগদখল করে থাকলে তাকে এই আইনে দখলদার রায়ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দখলদার রায়তকে তার জমি থেকে উচ্ছেদ করা যেত না এবং মূল্যবৃদ্ধি, জমিদারি বিনিয়োগে জমির উন্নয়ন, জমির পরিমাণ বৃদ্ধি ইত্যাদি বৈধ ও সিদ্ধ কারণ ছাড়া তাদের প্রদেয় খাজনাও বৃদ্ধি করা যেত না। দখলদার রায়তের অধিকারকে কেবল বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারীই ঘোষণা করা হয়নি বরং জমিদারের সম্মতি ও তাকে হস্তান্তর বাবদ সেলামি পরিশোধ সাপেক্ষে এই মধ্যস্বত্ব হস্তান্তরযোগ্য বলেও ঘোষণা করা হয়। আর অদখলদার রায়ত ছিল তারা যারা বারো বছরের কম মেয়াদে জমির দখলে ছিল। এই শ্রেণির রায়তদের খাজনা কোনরকম কারণ না দেখিয়েই বাড়ানো যেতো। তবে তারা নিয়মিত খাজনা পরিশোধ করে থাকলে তাদেরকে উচ্ছেদ করা যেত না। অদখলদার রায়তের নিম্নস্তরে ছিল কোর্ফা রায়ত বা ঊন-রায়ত জমিতে যাদের অধিকারের বিষয় সংজ্ঞায়িত নয়। এই শ্রেণির রায়ত জমির মালিকপক্ষের ইচ্ছাধীন হয়েই ঐ জমি ভোগ করত।

এ কারণে বলা যায় যে, ১৯৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন এভাবেই চিরস্থায়ী ভূমি বন্দোবস্ত ব্যবস্থার মূল গঠনতন্ত্রে এক বড়রকমের পরিবর্তন সাধন করে। তবে জমিতে রায়তদের অধিকার জোরদার করার প্রক্রিয়ার এটি ছিল শুধু সূচনামাত্র। ১৯২৮ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব সংশোধনী আইনের আওতায় রায়তের জমিতে অধিকার হস্তান্তরের বিষয়টি সাধারণ অধিকারভুক্ত করা হয়, যা পূর্বে ছিল একান্তই শর্তসাপেক্ষ। এখন থেকে রায়ত জমিদারের কাছ থেকে অনুমতি ছাড়াই তার জোত হস্তান্তর করার অধিকারী হন। তবে এই হস্তান্তর বাবদ জমিদারকে সেলামি পরিশোধ করার প্রথা তখনও বহাল থাকে। ১৯৩৯ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব (সংশোধনী) আইনের আওতায় জমিদারদের এ সেলামি বাবদ অর্থপ্রাপ্তির অধিকার বিলুপ্ত করা হয়। এখন থেকে রায়তরা জমির কার্যত মালিক হয়ে ওঠেন এবং জমি ইচ্ছামতো যে কোনভাবে ব্যবহার বা হস্তান্তরযোগ্য হয়ে ওঠে। এরপর জমিদারের জন্য বাকি থাকে কেবল খাজনাপ্রাপ্তির অধিকারটুকু।

১৯৪০-এর দশক ও তার পরবর্তীকালে জমির মধ্যস্বত্বের প্রশ্নটি এক নতুন মাত্রা লাভ করে। একে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হতে থাকে। সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক শ্রেণী জমিদারি ও মধ্যবর্তী মধ্যস্বত্বাধিকার সরাসরি লোপের পক্ষে এবং রায়ত স্বার্থকে অন্তত তাত্ত্বিকভাবে হলেও জমির নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির অভিব্যক্তি বা বহিঃপ্রকাশ ঘটে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ আইনে। ১৯৫০ সালের এই আইনে সকল জমিদারি ও মধ্যবর্তী ভূমি মধ্যস্বত্বাধিকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয় এবং রায়ত বা প্রজাদেরকে মালিক বা জমির অধিকারী বলে ঘোষণা করা হয়। সার্বভৌম স্বত্বাধিকারে রাষ্ট্র হয়ে ওঠে খাজনা সংগ্রাহক কর্তৃপক্ষ। সরকার খাজনার পরিবর্তে এখন রাজস্ব আদায় করতে থাকে। মালিকও আর প্রজা রইলেন না। তাই তিনি খাজনা নয়, ভূমিরাজস্ব প্রদান করতে থাকেন। এরপরও প্রজাস্বত্বের প্রশ্নে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ আইনের আওতায় অনেক বিষয় থেকে যায় অমীমাংসিত।

১৯৫০-পরবর্তী সময়ে ভূমিস্বত্ব ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রাদেশিক আইন পরিষদে পাশকৃত পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০, ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন সংক্রান্ত ইতিহাসে ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই আইনে সরকার ও জমি চাষকারী কৃষকের মধ্যবর্তী খাজনা গ্রহণকারী সকল প্রকার স্বত্ব অধিগ্রহণপূর্বক জমিদারি প্রথার বিলোপ সাধন করা হয়। প্রজাদের সরাসরি সরকারের অধীনে আনয়ন করা হয়। নতুন আইনের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সরকার ও রায়তের মধ্যে পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যের পরিবর্তন।

জমিদারি প্রথার বিলোপ এই অঞ্চলে রায়তওয়ারি পদ্ধতি প্রবর্তনের পথ সৃষ্টি করে। সরকার ঊর্ধ্বতন ভূম্যধিকারীর মর্যাদায় থেকে যায় এবং প্রজা বা রায়তগণ সরকারের অধীনে ভূমির মালিকানা বা দখলিস্বত্ব লাভ করেন। রায়তগণ সরকারকে সরাসরি রাজস্ব প্রদান করে থাকেন, এবং বন্দোবস্ত প্রদানের উপযোগী জমি সরকারের প্রতিনিধি জেলা কালেক্টরদের মাধ্যমে সরাসরি প্রজাদের নিকট বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়ে থাকে। কবুলিয়ত নামে পরিচিত বন্দোবস্ত দলিলের শর্তানুযায়ী প্রজাদের অধিকার ও দায়িত্বাবলি নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে এবং আদালতের মাধ্যমে এই কবুলিয়ত কার্যকর করা হয়।

ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে সূচিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিল প্রতি পরিবার বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় জমির সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ। কোন পরিবার অথবা প্রতিষ্ঠান ১০০ বিঘার (৩৩.৩৩ একর) অতিরিক্ত জমি অর্জন করতে বা দখলে রাখতে পারেন না। অতিরিক্ত জমি ক্ষতিপূরণ প্রদান সাপেক্ষে সরকারের নিকট ন্যস্ত হবে। জমি অর্জনের এই সর্বোচ্চ সীমা ১৯৬১ সালে ৩৭৫ বিঘায় উন্নীত করা হয় এবং ১৯৭২ সালে আবার ১০০ বিঘায় কমিয়ে আনা হয়। প্রাপ্ত উদ্বৃত্ত জমি সরকারের বিধিবিধান ও নিয়মনীতি অনুসরণ করে ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়ে থাকে।

কয়েক শ্রেণির জমি সরকারের খাসদখল ও ব্যবস্থাপনায় রাখার বিধানও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ সকল শ্রেণির জমি কোন প্রজা বা প্রাক্তন খাজনা গ্রহণকারীর দখলে রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। হাট বা বাজার, বনভূমি, জল মহাল ও ফেরিঘাট এই শ্রেণির জমির অন্তর্গত।

১৯৫০ সালের আইন কার্যকর হওয়ার পূর্বপর্যন্ত ভূমিস্বত্ব-বিষয়ক প্রচলিত আইন ছিল বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৮৫। এই আইনের বিলুপ্ত বিধানাবলিতে অধিকার ও আইনগত বাধ্যবাধকতার তারতম্যের ভিত্তিতে রায়ত বা প্রজাদের বহু শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছিল। নতুন আইনে শ্রেণিপার্থক্য বিলুপ্ত করা হয় এবং সকল শ্রেণির প্রজাদের মালিক নামে একটি মাত্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নতুন আইনের বিধানাবলি দ্বারা তাদের অধিকার ও আইনগত বাধ্যবাধকতা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। তাদেরকে আইনের বিধান অনুসারে জমি হস্তান্তর ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্তির অধিকারসহ জমির ব্যবহার ও জমিতে উৎপাদিত ফসল ভোগের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এই আইনানুগ নিশ্চয়তা প্রজাদের প্রাক্-ব্রিটিশ যুগে ভোগকৃত মালিক-দখলকারের মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে।

কৃষিভূমি ইজারা প্রদান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করাও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর উদ্দেশ্য ছিল কৃষি উন্নয়নে বাস্তব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী মধ্যবর্তী রাজস্ব-গ্রহণকারী স্বার্থের পুনরাবির্ভাব বন্ধ করা। হস্তান্তর অথবা উত্তরাধিকারের সুবাদে দখলযোগ্য জমিতে ভূমি আইল দিয়ে খন্ডীকরণ ও উপবিভাজন জমির ক্ষতি সাধন করে থাকে। এর ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডে বিভক্ত জমিতে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। মালিকের দরখাস্তের ভিত্তিতে অথবা সরকারি উদ্যোগে কোন মৌজার (রাজস্ব গ্রাম) দখলীকৃত জোতসমূহ একত্রীকরণ ও সংহতকরণের জন্য এই আইনে বিধান করা হয়েছিল। দিনাজপুর জেলায় দুটি থানায় পরীক্ষামূলকভাবে জোত সংহতকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতার অভাবে তা ব্যর্থ হয়ে যায়।

কৃষিজমি অকৃষি কাজে ব্যবহার বন্ধ করার জন্য প্রকৃত চাষি ব্যতীত কৃষিজমি অন্য কারও নিকট হস্তান্তর নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এই বিধানটি অকার্যকর প্রমাণিত হয়। কারণ যিনি বর্গাদার বা ভাড়াটে শ্রমিক দ্বারা জমি চাষাবাদ করেন তাকেও এই আইনের সংজ্ঞায় প্রকৃত চাষি বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়।

কৃষকদের ভূমিস্বত্বাধিকার উন্নয়নের জন্য যে সকল বিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল সে সবের প্রকৃত বাস্তবায়ন সম্ভব হয় নি। আইনের ত্রুটিবিচ্যুতি নয়, বরং তা বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর প্রশাসনিক অবকাঠামো এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবই ছিল এর মূল কারণ। খাজনা গ্রহণকারী স্বত্ব অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া ছিল খুবই মন্থর। এই আইনটি ১৯৫১ সালে কার্যকর করা হয়। কিন্তু ১৯৫৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত মাত্র ৪৪৩টি এস্টেট অধিগ্রহণ করা হয়। এই প্রক্রিয়া সমাপ্ত করতে আট বছরেরও অধিক সময় লেগেছে। এমনকি এখন পর্যন্তও ওয়াকফ্ ও দেবোত্তর এস্টেটের মতো কতিপয় খাজনা গ্রহণকারী স্বত্ব অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয় নি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সরকারের ভূমি বন্দোবস্ত নীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। স্বাধীনতার পূর্বে ভূমিরাজস্ব ছিল প্রাদেশিক সরকারের একক সর্ববৃহৎ আয়ের উৎস। ফলে ন্যায়পরায়ণতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের স্থলে রাজস্ব-আয় বিবেচনা দ্বারাই ভূমি বন্দোবস্ত নীতি পরিচালিত হতো। কমবেশি বাজারদরের সমান সেলামি প্রদান সাপেক্ষে উদ্বৃত্ত বা খাসজমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হতো। স্বাভাবিকভাবেই এই মূল্য পরিশোধে সক্ষম ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ নিজেদের নামে অথবা তাদের হুকুমবরদারদের নামে খাসজমি বন্দোবস্ত গ্রহণ করতেন। ভূমিহীন বা প্রান্তিক চাষিগণ এই ব্যবস্থার কোন সুযোগ গ্রহণ করতে পারতেন না। বর্তমানে খাসজমি বন্দোবস্তের নীতিমালায় বর্ণিত বিধান অনুসরণে বিনা সেলামিতে ভূমিহীন ব্যক্তিদের মধ্যে খাসজমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়।

১৯৭২ সাল থেকে আরম্ভ করে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন করেছেন। তাৎক্ষণিক পরিবর্তনের মধ্যে ছিল পরিবার বা প্রতিষ্ঠান-প্রতি কৃষি ও অকৃষি জমির মালিকানার সর্বোচ্চ পরিমাণ ৩৭৫ বিঘা থেকে কমিয়ে ১০০ বিঘা করা। কৃষিজমির সর্বোচ্চ সীমাসংক্রান্ত বিষয়ে আরও এক দফা পরিবর্তন ছিল যাতে সারাদেশে দখলাধীন জমির সর্বোচ্চ পরিমাণ ১০০ বিঘা ঠিক রেখে পরিবার বা প্রতিষ্ঠান-পিছু কৃষিভূমির সর্বোচ্চ পরিমাণ ৬০ বিঘায় নির্ধারণ করা হয়। কৃষিজমির সর্বোচ্চ সীমা কমানোর উদ্দেশ্য ছিল প্রাপ্ত উদ্বৃত্ত ভূমি পুনর্বণ্টন করে ভূমিহীনদের জীবিকানির্বাহের ব্যবস্থা করা ও জোতের মালিকদের অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রশস্তকরণ। কিন্তু দ্রুত বর্ধনশীল শহর এলাকায় জমির মূল্য ও জমি থেকে আয় সবসময়ই ছিল ঊর্ধ্বমুখী এবং অকৃষি ভূমির ব্যাপারে কোন সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা ছিল না। ফলে ন্যায়পরায়ণতা ও ন্যায়বিচার এক্ষেত্রে কোন ভূমিকাই রাখতে পারে নি। প্রতি একক পরিবারের মালিকানাধীন ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির খাজনা বা কর মওকুফ ছিল আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ১৯৭২ সালে প্রবর্তিত এই বিধানটি ১৯৭৬ সালে ভূমি উন্নয়ন কর অধ্যাদেশ কার্যকর হলে বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তীকালে তা পুনঃপ্রবর্তিত হয়।

স্বাধীনতার পূর্বে দেশের সর্বত্র একরূপ খাজনা বা করকাঠামো ছিল না। জেলা জরিপ ও সেটেলমেন্ট অপারেশন চলাকালে উৎপাদিত ফসলের মূল্যের ভিত্তিতে ধার্যকৃত কর বিভিন্ন গ্রামের জন্য বিভিন্নরকম হতো। রাজস্ব কাঠামো যুক্তিসম্মতকরণ এবং উন্নয়ন কাজের জন্য অধিক মাত্রায় স্থানীয় সম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ১৯৭৬ সালে ভূমি উন্নয়ন কর অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ভূমির ওপর আরোপযোগ্য সকল প্রকার কর ও সেস অবলুপ্ত করা হয় এবং তৎপরিবর্তে ভূমির ব্যবহার, অবস্থান ও পরিবারপ্রতি মোট জমির পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে সকল শ্রেণির জমির জন্য কয়েকটি স্তরে ভূমি উন্নয়ন কর ধার্য করা হয়। সমগ্র দেশে অথবা একটি থানায় কোন পরিবারের মোট জমির পরিমাণ নির্ধারণ করার মতো কোন পদ্ধতি না থাকায় ভূমি উন্নয়ন কর নিরূপণ ও আদায় বড়ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ফলে ভূমি উন্নয়ন কর থেকে যে রকম আয় আশা করা গিয়েছিল তা পাওয়া যায়নি। কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগও থেকে যায়। দখলাধীন জমি শিকস্তি হলে এবং একইস্থানে পরবর্তীকালে পয়স্তি হলে তার উপর প্রজাদের যুগ যুগ ধরে ভোগকৃত অধিকার সংক্রান্ত বিষয়েও পরিবর্তন আনা হয়।

পূর্বে কৃষিজমি বন্ধক দেওয়া হলে বন্ধকগ্রহীতা ১৫ বছর জমির ফসল ভোগ করলে আসল ও সুদসহ সমস্ত দেনা পরিশোধিত বিবেচনায় মূল মালিক জমি ফেরত পেতেন। বর্তমানে এই সময়সীমা ১৫ বছরের স্থলে ৭ বছর করা হয়েছে। ৭ বছর পরে কিম্বা তার আগে আনুপাতিক হারে টাকা ফেরত দিলে বন্ধকী জমি বন্ধকদাতার নিকট আর কোন দাবি ছাড়াই প্রত্যর্পিত হবে। এখন অন্য একটি সংশোধনীর মাধ্যমে বিধান করা হয়েছে যে, যদি কোন কৃষিজমির জন্য বিক্রয় দলিল সম্পাদিত হয় এবং নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে মূল্য ফেরত দিতে পারলে জমি ফেরত দেওয়া হবে বলে আর একটি চুক্তিনামা সম্পাদন করা হয়, তাহলে উভয় দলিল একত্রে খাইখালাসি বন্ধক বলে পরিগণিত হবে এবং ৭ বছর অতিক্রান্ত হলে আর কোন টাকা প্রদান ছাড়াই বিক্রিত জমি মালিকের নিকট প্রত্যর্পিত হবে।

১৯৮৪ সালে ভূমিসংস্কার অধ্যাদেশ জারি করে ভূমিতে প্রজাদের অধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনয়ন করা হয়। সর্বাধিক ৬০ বিঘা কৃষিজমি অর্জন ও দখলে রাখার বিধান ছাড়াও, এই আইনে জমির বেনামি হস্তান্তর বাতিল ঘোষণা করা হয়। নিজের নামে ক্রয় না করে অন্যের নামে জমি খরিদ করে নিজে প্রকৃত উপকারভোগী হিসেবে ফসল ভোগ করা ছিল স্বীকৃত রীতি। এ ধরনের লেনদেন বেনামি লেনদেন নামে পরিচিত ছিল। আপাত মালিক অথবা যার নামে জমি খরিদ করা হবে, তিনিই জমির প্রকৃত ক্রেতা বলে পরিগণিত হবেন এবং এই অনুমান মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য আদালত সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রদানের অনুমতি দান করবেন না।

কৃষিপ্রজাদের বাস্ত্তভিটা থেকে উচ্ছেদ করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এই আইনের ভূমিস্বত্বের নিরাপত্তাসংক্রান্ত সর্বাপেক্ষা অভিনন্দনযোগ্য বিধান। পূর্বে যে কোন ব্যক্তি আদালতের নিলামের মাধ্যমে খরিদকৃত কোন প্রজার বসতবাড়ি উচ্ছেদের মাধ্যমে দখল গ্রহণ করতে পারতেন। বর্তমান আইনে পল্লী এলাকায় যে কোন প্রজার বাস্ত্তভিটা আদালতের পরওয়ানা বহির্ভূত ঘোষণা করা হয়েছে এবং বাস্ত্তভিটার দখলদার এখন সকল প্রকার আদালতের প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত। ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশের সবচেয়ে অধিক প্রচারিত বিধান হচ্ছে বর্গাদার বা ভাগচাষিদের অধিকার সংক্রান্ত। অন্যের জমি চাষ করে ভাগচাষি উৎপাদিত ফসলের অর্ধাংশ পেতেন এবং বাকি অর্ধেক পেতেন জমির মালিক, যদিও তিনি সেচ ও সারের মূল্যের কোন অংশই বহন করতেন না।

নতুন আইনে বিধান করা হয়েছে যে, ভূমির মালিক ও বর্গাদারের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হবে। এই চুক্তি ৫ বছরের জন্য বলবৎ থাকবে এবং সক্ষম উত্তরাধিকারী থাকলে তিনিও উত্তরাধিকারসূত্রে বর্গাদার হবেন। বাজারদরে জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে বর্গাদার অগ্রাধিকার লাভ করবেন। বর্গাজমিতে উৎপাদিত ফসল তিন ভাগে বিভক্ত হবে। এক-তৃতীয়াংশ ভূমির মালিক পাবেন, এক-তৃতীয়াংশ পাবেন বর্গাদার এবং যে পক্ষ বীজ, সার ও সেচের খরচ বহন করবেন সেই পক্ষ অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ পাবেন। আর এভাবেই অর্ধ শতাব্দীকালের পুরাতন তেভাগা দাবি বাস্তবায়িত হয়।

বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়-এর মতো সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে অনেক প্রজাই তাদের ক্ষুদ্র জোত বিক্রয় করতে বাধ্য হতেন। এসব দরিদ্র প্রজাদের কষ্ট লাঘবের জন্য ১৯৮৯ সালে ঋণ সালিসি আইন নামে একটি আইন পাস করা হয়। সরকার এবং ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের প্রতিনিধি সমন্বয়ে প্রতি থানায় একটি করে ঋণ সালিসি বোর্ড গঠন করার জন্য এই আইনে বিধান করা হয়। কয়েক প্রকারের জমি বিক্রয় অবৈধ ঘোষণা করা ও বোর্ডকে অন্য কয়েক প্রকারের বন্ধক ৭ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর মালিক বরাবর প্রত্যর্পণ করার আদেশ প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফসলের অগ্রিম ক্রয় এবং সাদা কাগজে স্বাক্ষর অথবা টিপসহি নিয়ে তা সংরক্ষণ করার বিষয়টি বাতিল ঘোষণা করা হয়।

আদিবাসীদের ভূমিস্বত্ব  ব্রিটিশ শাসনামলে নিজ নিজ দখলি ভূমির উপর আদিবাসীদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত ছিল। অবশ্য দখলি জমির মালিকানা দলিল নিয়ে তাদের তেমন ভাবনা ছিল না। জমির অর্থনৈতিক মূল্য সম্বন্ধে তাদের সচেতনতাও ছিল সামান্য। ১৯০৮ সালের ছোট নাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন ছিল তাদের জমাজমির রক্ষাকবচ। এই আইনে আদিবাসীদের জমি জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া বিক্রয় বা হস্তান্তর ছিল অবৈধ। ১৯৭৭ সালে দেশের উত্তরাঞ্চলে ‘উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি’ নামে একটি সংস্থা গঠিত হয়। আদিবাসীদের জমিজমা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে এই সংস্থার অনুমতি লাভের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাস্তবে এই বিধান প্রায়ই উপেক্ষা করে উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা দুরবস্থার সময় তাদের জমিজমা বিক্রয় করে ফেলে। আদিবাসী গারো দের মাতৃসূত্রীয় পরিবারে মহিলারাই হচ্ছেন জমিজমার মালিক। আর এ জন্য অনেক অ-উপজাতি ব্যক্তি সম্পত্তির লোভে গারো মহিলাদের বিয়ে করে থাকেন।

টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর বনাঞ্চলের অধিকাংশ আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ভুক্ত। এদের অনেকেই তাদের বাস্ত্তভিটা এবং চাষযোগ্য উঁচু জমির জন্য কখনও কোন দলিল গ্রহণ করা প্রয়োজন মনে করে নি। ধান আবাদযোগ্য জমির অধিকাংশই তারা দলিলের মাধ্যমে লাভ করত এবং কর প্রদান করে ভোগদখল করত। ১৯২৭ সালের বন আইনের (Forest Act, 1927-Act-XVI of 1927) অধীনে তারা দখলিস্বত্ব লাভ করে এবং ষাট বছর পর্যন্ত উঁচু জমির দখলে বহাল থাকার অধিকার লাভ করে। তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাস ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কেউ ছিল না। নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি ও কৃষি কাজ নিয়ে তারা অরণ্যসন্তান হিসেবে বসবাস করত। মধুপুরের আদিবাসীরা নাটোরের রাজার (জমিদার) নিয়ন্ত্রণে এলে তাদের কর ও শ্রমের বিনিময়ে বনভূমিতে বসবাস করার অনুমতি দেওয়া হয়। বনের উৎকর্ষ সংরক্ষণ সাপেক্ষে তাদের জুম (জঙ্গল কেটে তা পুড়িয়ে ও পরিষ্কার করে চাষাবাদ (slash-and-burn cultivation) চাষেরও অনুমতি প্রদান করা হয়। গারোদের তাদের দখলি জমির জন্য জমিদার কর্তৃক পাট্টা প্রদান করা হতো। পাট্টা পদ্ধতিতে তারা কর প্রদানপূর্বক জমি চাষাবাদ করতে পারত এবং উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তর করতে পারত; কিন্তু জমি বিক্রি করার অধিকার লাভ করত না। অবশ্য সাধারণের ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জমি ক্ষতিপূরণ প্রদান না করেই জমিদার পাট্টাকৃত জমির আংশিক বা সম্পূর্ণ ফিরিয়ে নিতে পারতেন। দীর্ঘদিন ধরে জমিতে ধান চাষ করে এবং নিয়মিত কর পরিশোধ করে গারোগণ জমিতে অধিকতর স্থায়ী অধিকার হিসেবে পত্তন লাভ করে। পত্তন পদ্ধতিতে তারা জমি বিক্রয় করতে পারত এবং জমিদার কর্তৃক জমি ফেরত নেওয়া হলে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারত। পত্তন অবশ্য জুমচাষের ক্ষেত্রে কার্যকর ছিল না।

১৯৫০ সালের জমিদারি উচ্ছেদ ও প্রজাস্বত্ব আইন অনুসরণে ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করা হয় এবং সরকার সমস্ত জমির মালিকানা গ্রহণ করে। মধুপুর বনাঞ্চলসহ সকল বনাঞ্চলের ব্যবস্থাপনা বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মধুপুর বনাঞ্চলের আদিবাসীরা জমিদার থেকে পত্তনমূলে প্রাপ্ত জমিতে তাদের মালিকানাস্বত্ব ভোগ করতে থাকে। ১৯৫৫ সালে মধুপুর বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়। ১৯৬০ সালের প্রথম দিকে এই বনাঞ্চলের অংশবিশেষ নিয়ে জাতীয় উদ্যান গঠিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সম্প্রদায়ের ভূমিমালিকানা বহু শতাব্দীর প্রথা ও ঐতিহ্যভিত্তিক। সার্কেল চিফ বা রাজাগণ ছিলেন সমগ্র ভূমির অধিকারী বা মালিক। রাজাদের কর প্রদান সাপেক্ষে তাদের প্রজা হিসেবে জুমিয়াগণ জমিতে ফসল ফলাতে পারত। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী তাদের শাসনামলের প্রথম দিকে চিফ বা তাদের নিয়োজিত কর্মকর্তাদের কর্মকান্ডে কোনপ্রকার হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে। ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি চিফ বা রাজাদের অভ্যন্তরীণ কাজ হিসেবে তাদের এখতিয়ারভুক্ত রাখা হয়। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন (১৯০০ সালের ১নং রেগুলেশন) অনুসরণে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি জেলায় গঠন করা হয় এবং ডেপুটি কমিশনার পদবিধারী একজন কর্মকর্তাকে এ জেলার দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়।

ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী স্থায়ী চাষপদ্ধতি, যেমন লাঙল চাষে চাষিদের উৎসাহ প্রদান করে। প্রজাদের নিকট আবাদযোগ্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। আমলনামা নামে পরিচিত এই বন্দোবস্ত সূত্রে প্রজাগণ জমিতে চিরস্থায়ী ও উত্তরাধিকার স্বত্ব লাভ করে। বন্দোবস্ত প্রদানের পর প্রথম তিন বছরের জন্য প্রজাদের কোন কর বা খাজনা প্রদান করতে হতো না। কর্ষণযোগ্য জমি তিন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির জমির জন্য একরপ্রতি যথাক্রমে ৩ টাকা, ২ টাকা ও ১ টাকা কর ধার্য করা হতো। পার্বত্য অধিবাসীদের কর্ষণ চাষে আকৃষ্ট করার জন্যই কর্ষণ জমির কর অতি নিম্নপর্যায়ে ধার্য করা হতো।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিস্বত্ব বা ভূমি অধিকারকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ব্যক্তিগত অধিকার ও সাধারণ অধিকারে বিভক্ত করা যেতে পারে। সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত এক খন্ড জমির উপর ব্যক্তিবিশেষের অধিকার হচ্ছে ব্যক্তিগত অধিকার। এই অধিকার চিরস্থায়িভাবে অথবা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্দোবস্তের মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমির ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস করা যেতে পারে। শহর এলাকা এবং হাট-বাজার কেন্দ্রের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহূত জমি হচ্ছে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান। বাজার ফান্ড বিধিমালার অধীনে জেলা প্রশাসক এই শ্রেণির জমির প্রশাসন, নিয়ন্ত্রণ ও বিলি-বণ্টন করে থাকেন। প্রতিটি বাজারের জন্য জেলা প্রশাসক একজন বাজার চৌধুরী নিয়োগ করেন। এই বাজার চৌধুরীর সুপারিশের ভিত্তিতে বাজার এলাকায় উপজাতীয় এবং অ-উপজাতীয়দের জমি বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। বাজার ফান্ডের জমির পর অধিক মূল্যবান জমি হচ্ছে নদনদীসমূহের অববাহিকায় অবস্থিত সমতল ভূমি। এই শ্রেণির জমির অধিকাংশই লাঙল ব্যবহারের মাধ্যমে চাষাবাদ করে এক বা একাধিক ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। এই শ্রেণির জমিকে কর্ষণ জমি বা plough land বলা হয়ে থাকে। এর পরের উৎকৃষ্ট শ্রেণির জমি হচ্ছে ফ্রিঞ্জ ল্যান্ড বা জলে-ভাসা জমি। শীতকালে এই শ্রেণির জমি কাপ্তাই লেকের অগভীর তলা থেকে ভেসে ওঠে। শীতকালীন ধান প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন করার জন্য এই শ্রেণির জমি খুবই উপযুক্ত। আনুষ্ঠানিকভাবে এই শ্রেণির জমি বন্দোবস্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। মৌজা হেডম্যান প্রথাগতভাবে এ শ্রেণির জমি এক-সনা ভিত্তিতে বন্দোবস্ত দিয়ে থাকেন। কর্ষণ ভূমি ও জলে-ভাসা জমি ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে বৃক্ষ ও ফলের বাগান রয়েছে। বৃক্ষ ও ফলের বাগানের জন্য ব্যবহূত জমিকে গ্রোভ ল্যান্ড (grove land) বলা হয়ে থাকে।

ব্যক্তিগত অধিকার ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণ ভূমিতে কতিপয় সাধারণ অধিকার ভোগ করে থাকেন। এই অধিকার তারা প্রচলিত রীতিনীতি ও প্রথাগতভাবে ভোগ করেন। এই সাধারণ অধিকারের মধ্যে রয়েছে জুম চাষের অধিকার, পারিবারিক কাজে বনসম্পদ আহরণ ও ব্যবহার, সাধারণ চারণভূমিতে গবাদিপশু চরানোর অধিকার, শহর এলাকার বাইরের জমি বাস্ত্তভিটা নির্মাণের জন্য দখল গ্রহণ ইত্যাদি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমতল ভূমি বা ফ্লাট ল্যান্ড এবং জুম ভূমির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। ১৯০০ সালের ১ নং রেগুলেশনের মাধ্যমে এই অঞ্চলে ভূমিস্বত্ব প্রবর্তিত হয়। যেসব কৃষক নদী-উপত্যকায় নদীর তলদেশ থেকে জেগে ওঠা পললভূমি অথবা নদীসংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জমি চাষাবাদ করতেন, তাদের ভূমিস্বত্ব প্রদান করা হয়। এসব কৃষক এই জমিতে বসবাস করতে থাকেন এবং নিবিড় চাষাবাদ আরম্ভ করেন। ভূমিস্বত্ব অধিকারীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা বলে স্বীকৃত যে কোন ব্যক্তির নিকট তাদের জমি হস্তান্তর করার পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন।

সমতল ভূমিসম্পদ হিসেবে স্বীকৃত হলেও জুমভূমিতে কারও ব্যক্তিগত অধিকার জন্মায় না। জুম সকলের সাধারণ সম্পদ। শুধু আদিবাসীরাই জুমভূমি চাষাবাদ করতে পারেন। সমতল এলাকার জমির ন্যায় একই অর্থে জুমভূমি সম্পদ নয়। এ জমির জন্য কারও কোন দলিলভিত্তিক বা বৈধ অধিকার নেই। কাটা লাঠি বা কঞ্চি দ্বারা জুমভূমির সীমানা নির্দিষ্ট করা থাকে। অন্যান্য প্রতিবেশীরা এই সীমানা পরিবর্তনের সামান্যতম চেষ্টাও করে না। ফসল নিয়ে বিবাদ-বিসম্বাদ হতে পারে, ফসল চুরি হতে পারে; কিন্তু একজন গ্রামবাসীর চাষকৃত বা চাষের জন্য নির্ধারিত জুমভূমি অন্য একজন গ্রামবাসী অনুমতি ব্যতিরেকে দখল করার কোন প্রকার চেষ্টাই করে না। পার্বত্য জেলাসমূহের জেলা প্রশাসকগণ জুমচাষ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। উপযুক্ত কারণ লিপিবদ্ধ করে তারা যে কোন এলাকায় জুমচাষ বন্ধ ঘোষণা করতে পারেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০-এর (১৯০০ সালের ১নং রেগুলেশন) ১৮ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশাসন বিধিমালার ৩৪ নং বিধির সংশোধন করা হয়। এই সংশোধনীতে জমিজমা বন্দোবস্ত ও হস্তান্তর নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জেলা প্রশাসকের ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। সংশোধনীর প্রধান বিধানসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

ক. পাহাড়ি বা অ-পাহাড়ি অধিবাসী কোন পরিবারকে দখলি জমিসহ চাষকৃত ও চাষযোগ্য সমতল জমি (ফ্লাট ল্যান্ড) সর্বোচ্চ পাঁচ একর পর্যন্ত বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে। কর্ষণযোগ্য সমতল ভূমি ছাড়া বন সৃষ্টি ও ফলের বাগান করার জন্য এরূপ পরিবারপ্রতি সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) একর গ্রোভ ল্যান্ড বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে। তবে বরাদ্দকৃত জমির ব্যবহার জেলা প্রশাসকের কাছে সন্তোষজনক প্রতীয়মান হলে আরও ৫ (পাঁচ) একর পর্যন্ত গ্রোভ ল্যান্ড বরাদ্দ দেওয়া যাবে। কর্ষণ চাষ ও গ্রোভ বাগানের জন্য বরাদ্দকৃত জমির জন্য সালামি প্রদান করতে হবে না।

খ. বন ও ফসলের বাগান করার জন্য বরাদ্দকৃত জমি প্রথম তিন বছর করমুক্ত থাকবে, দ্বিতীয় তিন বছর তৃতীয় শ্রেণির জমি হিসেবে কর ধার্য হবে এবং পরবর্তীকালে জেলা প্রশাসক জমির উৎপাদনের ভিত্তিতে কর ধার্য করবেন।

গ. বাসস্থান নির্মাণের জন্য জেলা প্রশাসক উপযুক্ত ব্যক্তিগণের নিকট দীর্ঘমেয়াদে জমি বন্দোবস্ত দিতে পারেন। শহর এলাকায় পাহাড়ি অথবা অ-পাহাড়ি বাসিন্দাদের নিকট থেকে বন্দোবস্তকৃত জমির বাজার মূল্যের শতকরা ৫০ ভাগ হারে সালামি ধার্য করে বন্দোবস্ত প্রদানের সময় তা আদায় করা হয়ে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিনটি পার্বত্য জেলার সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নকল্পে তিনটি স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৮৯ সালে প্রণীত পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনে ভূমি হস্তান্তর ও ভূমি উন্নয়ন কর সম্পর্কে কতিপয় নতুন বিধি সংযোজন করা হয় এবং প্রচলিত আইনে বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীদের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিজরিপ কাজ শুরু এবং যথাযথ যাচাইয়ের মাধ্যমে জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করে আদিবাসী জনগণের ভূমি-মালিকানা চূড়ান্ত এবং তাদের ভূমি রেকর্ডভুক্ত ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করবে। সরকার ভূমিহীন বা দুই একরের কম ভূমি-মালিক উপজাতীয় পরিবারের ভূমির মালিকানা নিশ্চিত করতে পরিবারপ্রতি দুই একর জমি স্থানীয় এলাকায় জমির লভ্যতা সাপেক্ষে বন্দোবস্ত দেওয়া নিশ্চিত করবে। যদি প্রয়োজন অনুযায়ী জমি পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে টিলা জমির (গ্রোভ ল্যান্ড) ব্যবস্থা করা হবে।  [শামসুদ-দীন আহমদ এবং সিরাজুল ইসলাম]