দিল্লির দরবার

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২১:৪২, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

দিল্লির দরবার  দিল্লি অভিষেক দরবার। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর এ দরবার অনুষ্ঠিত হয়। এ দরবারে ব্রিটিশ ভারত ও দেশিয় রাজ্যের প্রায় আশি হাজার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হন। বাহ্যত এ দরবারের উদ্দেশ্য দেখানো হয়েছিল রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পর রাজা পঞ্চম জর্জের গ্রেট ব্রিটেনের সিংহাসনে আরোহণের অভিষেক অনুষ্ঠান। কিন্তু বৃটেনের রাজা ও রানীর উপস্থিতিতে এ দরবার অনুষ্ঠানের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল বহুবিধ দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে বাংলার যে বিক্ষোভকারীরা দিনে দিনে সংগ্রাম-মুখর হয়ে উঠছিল তাদের প্রশমিত করা। তাঁদের দাবিসমূহ ছিল বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) রদকরণ, বাংলার জন্য গভর্নর-ইন-কাউন্সিল ব্যবস্থা প্রবর্তন, রাজবন্দিদের মুক্তি, স্থানীয় সরকার ও শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে নিয়োগ ও পদোন্নতি পদ্ধতি উদারকরণ ইত্যাদি। বাংলার জাতীয়তাবাদীদের এবং তাদের সঙ্গে সম্মিলিত অন্যান্য রাজ্যের সংগ্রামীদের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ সামলাতে ব্যর্থ হয়ে ইন্ডিয়া কাউন্সিল এবং গভর্নর জেনারেল-ইন-কাউন্সিল ও ভাইসরয় জাতীয়তাবাদীদের অনেকগুলি দাবি মেনে নেওয়ার গোপন সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তারা আশঙ্কা করছিলেন যে, প্রতিরোধের মুখে এধরনের ছাড় প্রদান একদিকে যেমন বিক্ষোভে আরও উৎসাহ যোগাতে পারে এবং অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলমানদের পক্ষ থেকে নতুন বিরোধী গোষ্ঠীর উদ্ভব হতে পারে। এ সংকটের মুখে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নতুন রাজার অভিষেকের আয়োজন করে কিছু সুবিধা নেওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রিসভার সদস্যদের রাজি করান। একই সঙ্গে রাজার উপস্থিতিতে প্রাচ্যদেশীয় সব জাঁকজমক ও প্রাচুর্যের মধ্য দিয়ে ভারতে একটি ভাবগম্ভীর ও সশ্রদ্ধ ভীতি উদ্দীপক রাজকীয় দরবার অনুষ্ঠান এবং সেখানে রাজকীয় অনুগ্রহ হিসেবে প্রদত্ত সুবিধাদির ঘোষণা দেওয়ার ব্যাপারেও তাদেরকে রাজি করান।

ওয়েস্টমিনিস্টার এবেতে ১৯১১ সালের ২২ জুন অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রিসভার পরামর্শে রাজা পঞ্চম জর্জ ঐ বছরের শেষের দিকে প্রস্তাবিত দরবারে সভাপতিত্ব করার জন্য রাণীসহ ভারত ভ্রমণের একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এ দরবার আবারও রাজনৈতিক কারণে ভারতের রাজধানী কলকাতায় অনুষ্ঠিত না হয়ে দিল্লিতে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মুগল শাহী দরবারের সব ধরনের শানশওকতের অনুকরণে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে দিল্লির মহাদরবার অনুষ্ঠিত হয়। এ দরবারে রাজা পঞ্চম জর্জকে মুগল বাদশাহর ভূমিকায় অবতীর্ণ দেখাবার চেষ্টা করা হয়। এ লক্ষ্যে প্রতিটি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর চাহিদা মোতাবেক তাঁদের প্রত্যাশা পুরণের মাধ্যমে তিনি এ ভূমিকা ভালোভাবেই পালন করেন। রাজা জনসাধারণের জন্য কিছু রাজকীয় সাহায্য ও সুবিধা দানের ঘোষণা দেন। এগুলির মধ্যে ছিল ভূমিদান, সৈনিক ও নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের এক মাসের অতিরিক্ত বেতন প্রদান, ঢাকায় একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং এজন্য ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ, ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ লাভে ভারতীয়দের যোগ্য ঘোষণা ইত্যাদি। এসব দান ঘোষণার পর ভারতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্যার, রাজা, মহারাজা, নওয়াব, রায় বাহাদুর ও খানবাহাদুর প্রভৃতি সম্মানসূচক উচ্চ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

দরবারের শেষ পর্যায়ে আসে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ঘোষণা। এগুলি ছিল ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ, যুক্ত বাংলার জন্য গভর্নর-ইন-কাউন্সিল সৃষ্টি, বিহার, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুরকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এদের সমন্বয়ে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি এবং আসামের মর্যাদা পুনরায় হ্রাস করে একজন চীফ-কমিশনারের অধীন করা হয়। এরপর রাজা ঘোষণা করেন যে, তখন থেকে ভাইসরয় ক্রমান্বয়ে শুধু রাজকীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখাশোনা করবেন এবং প্রাদেশিক শাসনকার্য গভর্নর-ইন-কাউন্সিল ও নির্বাচিত সংস্থা কর্তৃক স্বশাসিতভাবে পরিচালিত হবে।

এ সকল নাটকীয় পরিবর্তন ছিল নিতান্তই সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক এবং নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিক্ষোভকারীরা বস্তত এটা আশাই করেনি যে, রাজা আদৌ সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলি উত্থাপন করবেন, কেননা, এগুলি পার্লামেন্টের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়। দরবার অনুষ্ঠানের পর পঞ্চম জর্জ কলকাতা সফর করেন। সেখানে তাঁকে বীরোচিত সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। তবে, ব্রিটেনে সমসাময়িক জনমত রাজকীয় এসব ঘোষণাকে অনেকটা সন্দেহ ও নিন্দার চোখে দেখে। পত্রপত্রিকাগুলি যুক্তি দেখায় যে, রাজা যদি নিজে থেকে এসব সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ছাড় দিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি ন্যক্কারজনক ও মারাত্মকভাবে পার্লামেন্টের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছেন, অন্যদিকে রাজনীতিবিদগণ যদি পার্লামেন্টকে আস্থায় না এনে নিজেদের গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য রাজার ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে থাকেন তাহলে সেটাও অসাংবিধানিক।

দিল্লির দরবার অনুষ্ঠানের আসল উদ্দেশ্য প্রায় পুরোপুরিই সফল হয়েছিল মনে করা যায়। দিল্লির দরবারের ঘোষণা অচিরেই বিধিবদ্ধ আইনে পরিণত হয় এবং তা উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের সাংবিধানিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে নেয়। মুসলিম নেতারা এতে বিক্ষুব্ধ ও হতাশ হলেও এবং শাসকগোষ্ঠীর বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও ব্রিটিশ রাজের প্রতি মোটামুটি অনুগত থাকেন। রাজধানী স্থানান্তরে বাংলার জাতীয়তাবাদীদের তেমন কোনো পরিতাপ ছিল না; কারণ এতে যে ক্ষতি হয় তা বাংলাকে গভর্নর প্রদেশের মর্যাদা দানের মাধ্যমে পুষিয়ে যায়। এ মর্যাদার অভাবে এযাবৎকাল এ প্রদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই বোম্বে ও মাদ্রাজ গভর্নর-ইন-কাউন্সিলের সাংবিধানিক মর্যাদা ভোগ করে আসছিল, কিন্তু বঙ্গদেশ এ মর্যাদা পেল এতকাল পর এ দরবারের মাধ্যমে।  [সিরাজুল ইসলাম]

আরও দেখুন দরবার।