তাজউদ্দিন, সৈয়দা জোহরা

তাজউদ্দীন, সৈয়দা জোহরা (১৯৩২-২০১৩) রাজনীতিক, নারী নেত্রী, সমাজকর্মী, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সহধর্মীনী। ডাক নাম লিলি। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ১৯৩২ সালের ২৪শে ডিসেম্বর ঢাকা শহরের মগবাজার বাসায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ সেরাজুল হক ঢাকা কলেজে আরবির অধ্যাপক ছিলেন এবং মাতার নাম সৈয়দা ফাতেমা খাতুন তিনি ছিলেন গৃহিনী।

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল থেকে সমাজবিজ্ঞানে বি.এ (অনার্স) ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি হোমিওপ্যাথির উপর ডিপ্লোমা করে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন। তিনি ভাল গিটার বাজাতে জানতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গঠিত সরকারের (যা ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে পরিচিত) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ১৯৫৯ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে জেনারেল আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির জাতীয় মুক্তিসনদ হিসেবে তাঁর ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচি পেশ করেন। ৬ দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদের কর্মসূচি হিসেবে আখ্যায়িত করে আইয়ুব সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে কারাবন্দি করা হয়। রাজবন্দিদের সাহায্যার্থে পরবর্তীতে গঠিত কমিটির তিনি যুগ্ন-আহবায়ক ছিলেন।

৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধকালে জীবনের ঝুকি নিয়ে সৈয়দা জোহরা তাজদ্দীন ছোট ছেলে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে মে মাসের শেয়ের দিকে সীমান্ত অতিক্রম করে প্রথমে ভারতের আগরতলা এবং সেখান থেকে কারগো বিমানে করে কলকাতায় গিয়ে স্বামী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে মিলিত হন। সেখানে অবস্থান করে তিনি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় তাজউদ্দীন আহমদকে সর্বাত্মক প্রেরণা যোগান। মুক্তিযুদ্ধোত্তর তিনি নারীদের পুণর্বাসন কর্মে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা এবং একই বছর ৩রা নভেম্বর মোশতাক-জিয়ার শাসনকালে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে কারাগারে নেতৃত্বদানকারী অন্য ৩ জাতীয় নেতার সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে তখন একদিকে যেমন দেখা দেয় নেতৃত্ব শুন্যতা, অপরদিকে দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নেমে আসে জেল-জুলুমসহ চরম নির্যাতন।

এমনই এক বিভীষিকাময় অবস্থায় আওয়ামী লীগকে পুর্ণগঠিত ও নেতা-কর্মীদের মনোবল ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৭৭ সালের ৩-৪ এপ্রিল ঢাকার ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধক ছিলেন। ঐ কাউন্সিলে ৪৪-সদস্য বিশিষ্ট সাংগঠনিক কমিটির তিনি আহবায়ক নির্বাচিত হন। অতঃপর আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করেন। ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং ১৯৮১ সালে প্রেসিডিয়ামের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শেষের পদে তিনি পুনঃপুন নির্বাচিত হন।

২০১৩ সালের ১৩ই ডিসেম্বর ৮১ বছর বয়সে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তাজউদ্দীন দম্পতির ৩ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তান রয়েছে। দ্বিতীয় কন্যা সিমিন হোসেন রিমি বর্তমানে সংসদ সদস্য এবং সংস্কৃতি বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি। পুত্র তানজিম আহমদ সোহেল সাবেক এম.পি ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। [হারুন-অর-রশিদ]

তথ্যসূত্র অধ্যাপক মমতাজ বেগম ও মফিদা বেগম, স্বাধীনতা যুদ্ধে নারী, (হাক্কানী পাবলিশার্স ২০১৮); শরিমিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা, (ঐতিহ্য ২০১৪) হারুন-অর-রশিদ, মূলধারার রাজনীতি : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬, (বাংলা একাডেমি ২০১৬)।