ঝাড়খন্ড

ঝাড়খন্ড  মানে বনভূমি, একটি প্রাচীন নাম যা ছোট নাগপুর মালভূমিস্থ উচ্চতর ভূমির বনাঞ্চলকে বলা হয়। এর সীমানা মধ্য প্রদেশ, ঊড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে বিস্তৃত হলেও ঝাড়খন্ডের এক বিশাল অংশ রয়েছে বিহারে। প্রকৃতপক্ষে এটি বরাকর, দামোদর, ব্রাহ্মণী, বৈতরণী, মহানদী, সুবর্ণরেখা প্রভৃতি নদ-নদী বিধৌত কয়েকটি মালভূমিময় পাহাড় ও উপত্যকা নিয়ে গঠিত। সমগ্র অঞ্চলের রয়েছে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক পরিচিতি এবং এটি মুন্ডা, সাঁওতাল, কোল, ভীল, ওরাওঁ, হো, মাহাতো, সূরী, তেলী, ধোপা, রাজাওয়ার ও অন্যান্যদের নিয়ে অধ্যুষিত। নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের অধিকাংশ অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এবং সাদনী মানবগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু চারটি রাজ্যের মধ্যে বনাঞ্চল বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় তাদের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ক্রমশ লোপ পেতে থাকে এবং এটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঔপনেবিশীকরণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

ঝাড়খন্ড হিন্দু ধর্মের প্রভাব থেকে চিরমুক্ত থাকলেও এটির রয়েছে নিজস্ব বিচিত্র ইতিহাস। মহাভারত-এর সময় থেকে ব্রিটিশ শাসনামল পর্যন্ত, এমন কি এর পরও ঝাড়খন্ড ও এর জনগোষ্ঠী ইতিহাসবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যখন মগধ অথবা পাটালীপুত্র প্রাচীনকালে ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল তখন ঝাড়খন্ডের নাম  মাঝে মাঝে উল্লিখিত হয়। ঝাড়খন্ড বনভূমির মাঝ দিয়ে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী দ্রুততার সাথে নদীয়া আক্রমণ করেন এবং লক্ষ্মণ সেনকে চমকে দেন। সুলতানি আমলে ঝাড়খন্ডের আলাদা পরিচিতি ছিল এবং আকবর এর সময়েই এটি ইসলামি প্রভাবাধীনে চলে আসে। ঘটনাবশত মুগলগণ ওই  স্থানকে কোকরা নামে আখ্যা দেয় এবং সমগ্র ঝাড়খন্ড মুগল আমলের পুরো সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ঝাড়খন্ড আঠারো শতকের শেষভাগের প্রথমার্ধে ব্রিটিশদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং ১৮৬৫ সালে এটি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ ভূখন্ডের সঙ্গে অধিকৃত হওয়ার পর ঝাড়খন্ডের অধিবাসীরা সরকার আরোপিত অস্বাভাবিক ভূমিকরের শিকার হয়। সে সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত অধিবাসীদের প্রতিবাদী মানসিকতার কারণে অঞ্চলটি ব্যাপক গোলযোগ ও উত্তেজনার কেন্দ্রে পরিণত হয়। সিংভূমের বনজ সম্পদ রক্ষার প্রশ্নে বা বহিরাগতদের দ্বারা শাল রোপনের মাধ্যমে যে বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয় তার বিরুদ্ধে স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতিবাদ ক্রমান্বয়ে জনযুদ্ধ রূপে প্রকাশ পায়।

ধানবাদ-গিরিডি অঞ্চলসমূহে বাধ্যতামূলক ধান চাষের মতো ঘটনা সাধারণভাবে এত বেশি ঘটছে যে আদিবাসীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে জমি  ছিনিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়তা প্রদর্শন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ফলে অধিবাসীরা এমনকি বিশাল বাঁধ যেমন কোয়েল-কারো, সুবর্ণরেখা নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বিদ্রোহী হয় এবং আলাদা রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের কণ্ঠ সোচ্চার হয়। এ ধরনের গোলযোগের পেছনে প্রধান ইস্যু ছিল অবশ্য স্থানীয় অধিবাসীদেরকে উন্নয়ন বা নগরায়ণের নামে স্থানচ্যুত বা সুশৃংখল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দখলচ্যুত করা। এখানে উল্লেখ্য যে, ২৫ এপ্রিল, ২০০০ তারিখে ঝাড়খন্ডকে বিহার বিধান সভা একটি আলাদা রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে।  [ইছামুদ্দীন সরকার]