উপন্যাস

উপন্যাস  উপনয় বা উপন্যস্ত শব্দ থেকে ‘উপন্যাস’ শব্দের উৎপত্তি, যা ইংরেজি Novel শব্দের পরিভাষারূপে গৃহীত। সাধারণ অর্থে উপন্যাস বলতে গদ্যে লিখিত দীর্ঘ উপস্থাপনাকে বোঝায়। ছোটগল্পের তুলনায় উপন্যাসের বিস্তৃতি বেশি। উপন্যাস রচনায় ব্যক্তিচেতনা ও সমাজচেতনা অপরিহার্য। একটি সার্থক উপন্যাসে কাহিনী, ঘটনা, চরিত্র, বর্ণনাভঙ্গি, রস, সংলাপ, ভাষা ইত্যাদির মাধ্যমে মূলত লেখকের জীবনদর্শন ও জীবনানুভূতিই প্রকাশ পায়। উপন্যাসের বিস্তৃত পটভূমিতে সমগ্র মানবজীবন ও সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে।

বাংলা উপন্যাসের প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায়  রামায়ণ ও  মহাভারত মহাকাব্যদ্বয়ে এবং বিভিন্ন  রূপকথা ও  পুরাণ সাহিত্যে। এ ছাড়া দশকুমারচরিত, বৃহৎকথা, কথাসরিৎসাগর, বেতালপঞ্চবিংশতি, কাদম্বরী ইত্যাদি সংস্কৃত গদ্যকাব্য এবং পালি ভাষায় রচিত জাতককাহিনীতেও উপন্যাসের কিছু কিছু উপাদান লক্ষ্য করা যায়। বাংলা ভাষায় রচিত বিভিন্ন  মঙ্গলকাব্য, যেমন মুকুন্দরামের  চন্ডীমঙ্গল কাব্যেও উপন্যাসের লক্ষণ প্রায় সর্বাংশে বর্তমান। মৈমনসিংহ-গীতিকার মধ্যেও কেউ কেউ উপন্যাসের আংশিক ধর্ম লক্ষ্য করেছেন।

বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের উদ্ভব মূলত উনিশ শতকের প্রথম দিকে এবং এর উদ্ভবের মূলে রয়েছে ইংরেজি তথা পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব।  ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭৮৭-১৮৪৮) নববাবুবিলাস (১৮২৫) নামে যে ব্যঙ্গাত্মক নকশা রচনা করেন তার মধ্যে প্রথম বাংলা উপন্যাসের লক্ষণ ফুটে ওঠে। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে হ্যানা ক্যাথারিনা ম্যালেন্স রচিত ফুলমণি ও করুণার বিবরণ গ্রন্থে প্রচারধর্মী জীবনচেতনার পরিচয় পাওয়া যায়, যদিও এটি তাঁর মৌলিক রচনা নয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে  ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৪-১৮৯৮) সফল স্বপ্ন ও অঙ্গুরীয় বিনিময় নামে যে-দুটি উপাখ্যান রচনা করেন তাতে ঐতিহাসিক উপন্যাসের যথেষ্ট উপাদান পরিলক্ষিত হয়। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে  প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩) টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে  আলালের ঘরের দুলাল নামক যে ব্যঙ্গাত্মক নকশাটি রচনা করেন তাতে উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য, চরিত্র ও সমাজচিত্র যথাযথভাবে অঙ্কিত হয়েছে, যদিও এখানে উপন্যাসের কলাকৌশলে কিছুটা ত্রুটি রয়েছে।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) আধুনিক বাংলা উপন্যাসের জনক বলে স্বীকৃত। তাঁর রচিত দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সার্থক উপন্যাস। তিনি ঐতিহাসিক, রোমান্সধর্মী, রোমান্টিক, সামাজিক, পারিবারিক, মনস্তাত্ত্বিক ইত্যাদি বিষয় অবলম্বনে উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা চৌদ্দটি। তন্মধ্যে ঐতিহাসিক ও রোমান্সধর্মী উপন্যাসগুলি হলো দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), কপালকুন্ডলা (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯), যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪), চন্দ্রশেখর (১৮৭৫), রাজসিংহ (১৮৮২) ও সীতারাম (১৮৮৭); সামাজিক ও গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাস হলো বিষবৃক্ষ (১৮৭৩), রজনী (১৮৭৭) ও কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮) এবং তাত্ত্বিক ও দেশাত্মবোধক উপন্যাসগুলি হলো ইন্দিরা (১৮৭৩), আনন্দমঠ (১৮৮৪), দেবীচৌধুরাণী (১৮৮৪) ও রাধারাণী (১৮৮৬)।

পাশ্চাত্যের প্রভাবে বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম বাংলা উপন্যাসের কায়া নির্মাণ ও তাতে কান্তি যোজনা করেন। বিষবৃক্ষ ও কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাস দুটি বাংলা সাহিত্যে এক অনবদ্য সৃষ্টি। এখানে নারীর আকাঙ্ক্ষা ও প্রবৃত্তির সঙ্গে সংস্কারের দ্বন্দ্ব, পুরুষের নৈতিক অধঃপতন প্রভৃতি বিষয় মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনিই প্রথম বিধবাদের মুখে ভাষা দিয়েছেন। পরিণতিতে তিনিই আবার নীতিবাদী ও সমাজসচেতন শিল্পী হিসেবে কঠোর হয়েছেন। বঙ্কিমের পরে তাঁর আদর্শ নিয়ে যাঁরা উপন্যাস রচনায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তাঁদের মধ্যে তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের (১৮৪৩-১৮৯১) স্বর্ণলতা এবং রমেশচন্দ্র দত্তের (১৮৪৮-১৯০৯) বঙ্গবিজেতা (১৮৭৪), মাধবীকঙ্কণ (১৮৭৭) জীবনপ্রভাত (১৮৭৮), জীবনসন্ধ্যা, সংসার (১৮৮৬) ও সমাজ (১৮৯৩) উল্লেখযোগ্য।

বঙ্কিমের পরে মুসলিম ঔপন্যাসিক হিসেবে আবির্ভাব ঘটে মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯১২)। তাঁর প্রথম উপন্যাস রত্নাবতী প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে। কারবালার বিষাদময় কাহিনী নিয়ে তিন খন্ডে রচিত তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস হচ্ছে  বিষাদ-সিন্ধু (১৮৮৫-৯১)। এ ছাড়া উদাসীন পথিকের মনের কথা, ইসলামের জয়, রাজিয়া খাতুন ইত্যাদিও তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।

মহিলা ঔপন্যাসিক হিসেবে যাঁর স্থান প্রথমে তিনি হলেন  স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২)। তাঁর উপন্যাসে কল্পনা বিস্তারের চেয়ে সত্যানুসন্ধিৎসা অধিক বিদ্যমান। তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলির মধ্যে মিবার রাজ (১৮৭৭), ছিন্নমুকুল (১৮৭৯), মালতী (১৮৭৯), হুগলীর ইমামবাড়ী (১৮৮৭), বিদ্রোহ (১৮৯০), স্নেহলতা (১৮৯২), কাহাকে (১৮৯৮), বিচিত্র (১৯২০), স্বপ্নবাণী (১৯২১) ও মিলনরাতি (১৯২৫) উল্লেখযোগ্য।

এরপর বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে আবির্ভূত হন  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। তাঁর আবির্ভাব বাংলা উপন্যাসে একটি বিস্ময়কর বিবর্তন সূচনা করে। উপন্যাস রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ প্রথমদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের রোমান্সপ্রধান উপন্যাসের ধারা কিছুটা অনুসরণ করলেও পরের দিকে তিনি তথ্যসমৃদ্ধ এবং প্রাত্যহিক জীবনের দ্বন্দ্বসংঘাতপূর্ণ উপন্যাস রচনা করে স্বতন্ত্র প্রতিভার পরিচয় দেন। তিনি মোট বারোটি উপন্যাস রচনা করেন। ইতিহাসকে আশ্রয় করে রবীন্দ্রনাথ বৌঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩) এবং রাজর্ষি (১৮৮৭) উপন্যাস রচনা করেন। ইতিহাস আশ্রিত হলেও এতে অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটেছে। জীবনসমস্যাপ্রধান উপন্যাসের মধ্যে তাঁর চোখের বালি (১৯০৩) ও নৌকাডুবি (১৯০৬) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর চোখের বালিতেই মানব-মানবীর নিষিদ্ধ প্রেম প্রথম স্বীকৃতি পায়।

গোরা (১৯১০) উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ ও বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম উপন্যাসরূপে স্বীকৃত। এ উপন্যাসের বিষয়বস্ত্ত মহাকাব্যের আদর্শে পরিকল্পিত। এটি বুদ্ধিবৃত্তিপ্রধান ও বিশ্লেষণধর্মী উপন্যাসের পর্যায়ে পড়ে। ঘরে-বাইরে (১৯১৬) এবং চার অধ্যায় (১৯৩৪) স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত বিপ্লবাত্মক উপন্যাস। চতুরঙ্গ (১৯১৬) রবীন্দ্রনাথের মতাদর্শভিত্তিক উপন্যাস। শেষের কবিতা (১৯৩০), মালঞ্চ (১৯৩৪), দুইবোন (১৯৩৩) ইত্যাদি আধুনিক মনস্তত্ত্ব ও জীবনবোধের কাব্যধর্মী উপন্যাস। তাঁর যোগাযোগ উপন্যাসের উপভোগ্য বিষয় হলো এর কাব্যময় বিবৃতি এবং ভাবগম্ভীর চরিত্র ও ঘটনা বিশ্লেষণ।

রবীন্দ্রযুগের একজন বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক ছিলেন  প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২)। তাঁর উপন্যাসে চরিত্রচিত্রণ অপেক্ষা কাহিনীই অধিক প্রাধান্য পেয়েছে। রমাসুন্দরী (১৯০৮), নবীন সন্ন্যাসী (১৯১২), রত্নদ্বীপ (১৯১৫) ও সিন্দুর কৌটা (১৯১৯) তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। রবীন্দ্রযুগেই আবির্ভূত হন বাংলা সাহিত্যের অতিশয় জনপ্রিয় ও শক্তিমান কথাসাহিত্যিক  শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)। রবীন্দ্রনাথের সমকালীন হওয়া সত্ত্বেও উপন্যাস রচনায় তিনি স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন। তাঁর উপন্যাসে বাংলার সামাজিক ও পারিবারিক জীবনই প্রধানভাবে চিত্রিত হয়েছে। নারীর প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধ তাঁর উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি অনেক উপন্যাস রচনা করেছেন। সেসবের মধ্যে বড়দিদি (১৯১৩), বিন্দুর ছেলে (১৯১৪), রামের সুমতি (১৯১৪), পন্ডিতমশাই (১৯১৪), বিরাজ বৌ (১৯১৪), চরিত্রহীন (১৯১৪), চন্দ্রনাথ (১৯১৬), পল্লীসমাজ (১৯১৬), দেবদাস (১৯১৭), দত্তা (১৯১৮), গৃহদাহ (১৯২০), দেনা-পাওনা (১৯২৩), বৈকুণ্ঠের উইল (১৯৩৪) ইত্যাদি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। শরৎ-উপন্যাসের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে চার পর্বে রচিত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস শ্রীকান্ত (১৯১৭-৩৩)। এর ইন্দ্রনাথ চরিত্র শরৎচন্দ্রের তথা বাংলা উপন্যাসের এক অনবদ্য সৃষ্টি। এরকম চরিত্র বাংলা উপন্যাসে দ্বিতীয়টি নেই। তাঁর জনপ্রিয়তার আর একটি কারণ হলো রচনারীতির মাধুর্য ও ভাষার সারল্য।

বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২) প্রথম মুসলিম ঔপন্যাসিক যিনি প্রধানত মুসলমান নারীসমাজের কুসংস্কার ও জড়তা দূর করার উদ্দেশ্যে লেখনী ধারণ করেন। পদ্মরাগ (১৯২৭) তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। এ ছাড়া অবরোধবাসিনী (১৯৩১), সুলতানার স্বপ্ন প্রভৃতি উপন্যাসধর্মী গ্রন্থে তিনি নারীসমাজের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন।

কাজী ইমদাদুল হক (১৮৮২-১৯২৬) রচিত উপন্যাসে সমাজের বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। আবদুল্লাহ (১৯৩৩) উপন্যাস রচনা করেই তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। এটি তৎকালীন মুসলমান সমাজের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর সামাজিক কুসংস্কার যে মুসলমান সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে তারই করুণ চিত্র এতে ফুটে উঠেছে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) ছিলেন শরৎচন্দ্রের পরবর্তীকালীন ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক জনপ্রিয়। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখের কাহিনী তাঁর রচনার বিশেষত্ব। মানবজীবনকে প্রকৃতির সঙ্গে তিনি একসূত্রে গেঁথে দিয়েছেন। তাঁর সমগ্র উপন্যাসে মানব-প্রকৃতির প্রতিনিধি হচ্ছে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস পথের পাঁচালীর (১৯২৯) অপু। এরই পরিপূরক গ্রন্থ হচ্ছে অপরাজিত (১৯৩১)। এ উপন্যাস দুটি তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ও বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এ ধরনের উপন্যাসে প্রাকৃতিক বর্ণনার মধ্যে মানুষের গভীর জীবনদৃষ্টিও ফুটে উঠেছে। তাঁর আরণ্যক (১৯৩৮) উপন্যাসটি বিষয় পরিকল্পনার অভিনবত্বে বিস্ময়কর। এতে প্রকৃতির সূক্ষ্ম ও কবিত্বপূর্ণ অনুভূতিসমূহ প্রকাশ পেয়েছে। দেবযান (১৯৪৪) উপন্যাসে রোমান্টিক মনোবৃত্তিপ্রসূত পরলোকের কাহিনী প্রাধান্য পেয়েছে। এ ছাড়া তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে দৃষ্টিপ্রদীপ (১৯৩৫), আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০), ইছামতি (১৯৪৯) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) ছিলেন সমকালীন ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমাজসচেতন লেখক। তিনি তাঁর উপন্যাসে ব্যক্তির ওপরে সমাজকে স্থান দিয়েছেন। ফলে তাঁর উপন্যাসে সামন্ত সমাজের সঙ্গে ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্ব প্রায়শই প্রকট হয়েছে। তাঁর রচিত দুটি জনপ্রিয় উপন্যাস রাইকমল ও কবি-তে (১৯৪২) বৈষ্ণব ও কবিয়ালের বাস্তব জীবন চিত্রায়িত হয়েছে। হাসুলী বাঁকের উপকথায় (১৯৪৭) রাঢ়ের নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের জীবনের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। তাঁর প্রতিভার পূর্ণ পরিচয় রয়েছে গণদেবতা (১৯৪২), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৩), কালিন্দী (১৯৪০), আরোগ্য নিকেতন (১৯৫৩), ধাত্রী দেবতা (১৯৩৯), চৈতালী ঘূর্ণি (১৯৩১), জলসাঘর (১৯৪২) ইত্যাদি উপন্যাসে।

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) মূলত কবি হিসেবে পরিচিত হলেও উপন্যাস রচনায় তাঁর কৃতিত্ব কম নয়। বাঁধনহারা (১৯২৭), মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০) ও কুহেলিকা (১৯৩১) তাঁর তিনটি বিখ্যাত উপন্যাস, যা বিপ্লবের পটভূমিকায় রচিত। বিশেষকরে মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে সাধারণ মানুষের চিত্র নিখুঁতভাবে অঙ্কিত হয়েছে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) কল্লোলগোষ্ঠীর লেখকদের পর বাংলা সাহিত্যে বস্ত্ততান্ত্রিকতা ও মনোবিশ্লষণের সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে আবির্ভূত হন। তাঁর বেশির ভাগ লেখায় ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝি-তে (১৯৩৬) যৌনাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে উদরপূর্তির সমস্যার এক বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬) উপন্যাসে শশীর প্রতি কুসুমের যে দুর্দমনীয় আকর্ষণ তা বিশ্লেষিত হয়েছে সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক উপায়ে। জীবনের সাংকেতিকতার ইঙ্গিত দান করেছে দিবা-রাত্রির কাব্য (১৯৩৫) উপন্যাস। নর-নারীর যৌনতত্ত্বের ওপর রচিত হয়েছে চতুষ্কোণ (১৯৪৮) উপন্যাসটি। এ ছাড়া তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে জননী (১৯৩৫), শহরতলী (১৯৪০), অহিংসা (১৯৪১), শহরবাসের ইতিকথা (১৯৪৬), চিহ্ন (১৯৪৭) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সতীনাথ ভাদুড়ী রচনা করেন গাজরী, ঢোঁড়াই চরিতমানস। এ ছাড়া বিভাগপূর্বকালেই উপন্যাস রচনায় খ্যাতি অর্জন করেন এমন আরও কয়েকজন হলেন: মোজাম্মেল হক, মোহাম্মদ নজিবুর রহমান, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, মনোজ বসু, সৈয়দ মুজতবা আলী, প্রবোধকুমার সান্যাল, বুদ্ধদেব বসু, সমরেশ বসু প্রমুখ। এ সময়ের কয়েকজন খ্যাতনামা মহিলা ঔপন্যাসিক হলেন: ইন্দিরা দেবী, অনুরূপা দেবী, নিরুপমা দেবী, সীতাদেবী, আশাপূর্ণা দেবী প্রমুখ।

বিষয়বস্ত্ত ও শিল্পচেতনা অনুযায়ী বাংলা উপন্যাসকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যেমন:

ঐতিহাসিক উপন্যাস  এ শ্রেণির উপন্যাস ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয় এবং রচনার সময় ঔপন্যাসিককে অতীত জীবনের ইতিহাস, রীতি-নীতি, সংস্কার, সামাজিক ও গার্হস্থ্যজীবনের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের রাজসিংহ, রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি ও বৌঠাকুরাণীর হাট, সত্যেন সেনের আলবেরুণী ইত্যাদি বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস।

সামাজিক উপন্যাস  এ ধরনের উপন্যাসে প্রধানত সমাজজীবন প্রতিফলিত হয়। সমাজের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি সামাজিক সমস্যাসমূহও এতে প্রধান হয়ে ওঠে। বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল; শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ, পল্লীসমাজ; রমেশচন্দ্রের সংসার, সমাজ; সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর (১৯২২-১৯৭১)  লালসালু (১৯৪৮); শওকত ওসমানের (১৯১৭-১৯৯৮) জননী (১৯৬১) ইত্যাদি এ শ্রেণিভুক্ত উপন্যাস।

আঞ্চলিক উপন্যাস  এ উপন্যাসে কাহিনী ও চরিত্রাবলি একটি বিশেষ অঞ্চলের পটভূমিতে নির্মিত হয়। কোনো কোনো আঞ্চলিক উপন্যাস অনেক সময় আঞ্চলিকতাকে অতিক্রম করে সর্বজনীন সাহিত্যকর্ম হয়ে ওঠে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৮-১৯৭১) হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮-১৯৫৬) পদ্মা নদীর মাঝি, অদ্বৈত মল্লবর্মণের (১৯১৪-১৯৫১) তিতাস একটি নদীর নাম ইত্যাদি এ ধরনের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।

আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস  এতে লেখকের ব্যক্তিজীবনের প্রতিফলন ঘটে। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত এ শ্রেণিভুক্ত একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

কাব্যধর্মী উপন্যাস  এতে লেখকের জীবনদর্শন ও গীতিধর্মিতা প্রাধান্য পায়। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা এ জাতীয় একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

রহস্য উপন্যাস  অপরাধ ও গোয়েন্দা তৎপরতা নিয়ে এ ধরনের উপন্যাস রচিত হয়। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৫৫-১৯০৭) দারোগার দপ্তর, বনফুলের পঞ্চপর্ব, শরচ্চন্দ্র সরকারের গোয়েন্দাকাহিনী, অম্বিকাচারণ গুপ্তের গোয়েন্দা গল্প এবং ক্ষেত্রঘোষের আদরিণী এ শ্রেণির উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।

রোমান্সধর্মী উপন্যাস  এতে কল্পনাভিসারী মন ও অতীতপ্রীতির কথা বেশি ফুটে ওঠে। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলা, মৃণালিনী, চন্দ্রশেখর এ ধরনের উপন্যাস।

হাস্যরসাত্মক উপন্যাস  এ ধরনের উপন্যাসে লেখক মানবজীবনের যে-কোনো একটি অসঙ্গতিকে বিষয়বস্ত্ত করে হাস্যরসাত্মক চরিত্র সৃষ্টি করেন। ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কল্পতরু; ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৪৭-১৯১৯) কঙ্কাবতী, ফোকলা দিগম্বর; চন্দ্রনাথ বসুর পশুপতি সম্বাদ; কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোষ্ঠীর ফলাফল  ইত্যাদি এ শ্রেণির উপন্যাস।

পত্রোপন্যাস  এ ধরনের উপন্যাসের বক্তব্য পত্রের আকারে প্রকাশ করা হয় যেমন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের (১৯০১-১৯৭৬) ক্রৌঞ্চমিথুন, বুদ্ধদেব গুহর সবিনয় নিবেদন  ইত্যাদি।

পুরাণ কাহিনীমূলক উপন্যাস পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে এ ধরনের উপন্যাস রচিত হয়। কাহিনীই এ ধরনের উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। এ ক্ষেত্রে দীনেশ সেনের শ্যামল ও কজ্জল, জড়ভরত ও বেহুলা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বীরত্বব্যঞ্জক উপন্যাস  বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী অবলম্বনে এ ধরনের উপন্যাস রচিত হয়। মণীন্দ্রলাল বসুর অজয়কুমার এ শ্রেণিভুক্ত উপন্যাস।

মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস  এ ধরনের উপন্যাসে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়সমূহ প্রাধান্য পায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

চৈতন্যমূলক উপন্যাস  এ ধরনের উপন্যাসে লেখক মানুষের ব্যক্তিচৈতন্যের গভীরে নিমজ্জিত নানা বিষয়ের আংশিক আভাস দিয়ে থাকেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসে এরূপ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া রূপক-প্রতীকী উপন্যাস এবং অস্তিত্ববাদী উপন্যাস আধুনিক উপন্যাস সাহিত্যের নতুন সংযোজন।  [মোঃ মাসুদ পারভেজ]

১৯৪৭ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত অর্ধশতককালের উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর সমকালীন জীবন-নির্ভরতা। এ সময় ঔপন্যাসিকদের শিল্পভাবনার বিশিষ্টতায় সমাজবাস্তবতার রূপায়ণ ঘটেছে বহু মাত্রায়। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যের প্রাথমিক পর্বে ঔপন্যাসিকরা তাঁদের রচনা শুরু করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর,  পাকিস্তান আন্দোলন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশভাগের প্রেক্ষাপটে। ক্রমশ গ্রামীণ ও শহুরে পটভূমি এবং ব্যক্তিজীবনের বহুবিধ জটিলতা এর উপজীব্যরূপে স্থান পেতে থাকে। তবে শুরু থেকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত প্রধান ঔপন্যাসিকদের প্রায় সকলেই ছিলেন গ্রামকেন্দ্রিক। পূর্ববাংলার কৃষিজীবী মানুষের জীবনসত্য অমর রূপ পরিগ্রহ করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু (১৯৪৮) উপন্যাসে। গ্রামীণ জীবনে ক্ষুধা, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, শোষণের বাস্তবতা প্রভৃতি এতে সত্যনিষ্ঠভাবে চিত্রিত হয়েছে। এরূপ গ্রামনির্ভর উপন্যাস তখন আরও অনেকেই রচনা করেছেন। আবুল ফজলের (১৯০৩-১৯৮৩) জীবন পথের যাত্রী (১৯৪৮), আবু ইসহাকের (জ. ১৯২৬) সূর্য-দীঘল বাড়ী (১৯৫৫), শামসুদ্দীন আবুল কালামের (১৯২৬-১৯৯৭) কাশবনের কন্যা (১৯৫৭), আবুল মনসুর আহমদের (১৮৯৮-১৯৭৯) জীবন-ক্ষুধা (১৯৫৭), শওকত ওসমানের (১৯১৭-১৯৯৮) জননী (১৯৫৮) প্রভৃতি এ সময়কার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। এগুলির মধ্যে শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, শামসুদ্দীন আবুল কালাম ও আবুল মনসুর আহমদের উপন্যাস বিষয়ভাবনা, জীবনদৃষ্টি ও চরিত্রচিত্রণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামীণ জীবনের অভাব-বঞ্চনা-শোষণ ছিল তাঁদের উপন্যাসের বিষয়বস্ত্ত।

ষাটের দশক থেকে গ্রাম ও শহর উভয়ই বাংলা উপন্যাসে প্রাধান্য পেতে থাকে। তখন নবসৃষ্ট রাজধানী শহর ঢাকা এবং বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি হয়ে ওঠে উপন্যাসের প্রধান বিষয়। শহরমুখী বিত্তহীন ও নিম্নবিত্তের মানুষও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। নগরবিকাশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জীবনজটিলতা, নর-নারীর সম্পর্কের টানাপোড়েন প্রভৃতি অবলম্বনেও রচিত হয় বহু উপন্যাস। এ সময়ের নগর-জীবনাশ্রিত প্রথম সার্থক উপন্যাস আবু রুশদের (জ. ১৯১৯) সামনে নোতুন দিন (১৯৫১)। এ ছাড়া আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো: রাজিয়া খানের (জ. ১৯৩৬) বটতলার উপন্যাস (১৯৫৯), সৈয়দ শামসুল হকের (জ. ১৯৩৫) দেয়ালের দেশ (১৯৫৯), রশীদ করীমের (জ. ১৯২৫) উত্তম পুরুষ (১৯৬১), আলাউদ্দিন আল আজাদের (জ. ১৯৩২) তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬০), আবু রুশদের নোঙর (১৯৬৩), জহির রায়হানের (১৯৩৩-১৯৭২) বরফ গলা নদী (১৯৬৯), রাবেয়া খাতুনের (জ. ১৯৩৫) রাজাবাগ শালিমারবাগ (১৯৬৭) ইত্যাদি। এঁদের মধ্যে আবু রুশদ, রশীদ করীম ও রাবেয়া খাতুন শহুরে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত অঙ্কনে এবং রাজিয়া খান, সৈয়দ শামসুল হক ও আলাউদ্দিন আল আজাদ ব্যক্তির অন্তর্জগৎ উন্মোচনে কৃতিত্বের দাবিদার। এ সময়ের আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক হচ্ছেন বুলবুল চৌধুরী, আহসান হাবীব, নীলিমা ইব্রাহিম, আমজাদ হোসেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী, মালিহা খাতুন, সরদার জয়েনউদ্দীন প্রভৃতি। এঁদের উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে পরিবর্তনের গতিবেগে চঞ্চল গ্রামীণ ও নগরজীবনের সুবিস্তৃত পটভূমি।

রাজধানী ঢাকার নাগরিক জীবন ও জটিলতা বাংলাদেশের নগরজীবনাশ্রিত উপন্যাসমূহের প্রধান উপজীব্য। কিন্তু একথাও সত্য যে, ঢাকাকে বাদ দিলে পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ (শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ) মানুষ তখনও ছিল গ্রামবাসী এবং পূর্ববঙ্গের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। তাই ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত গ্রামজীবনভিত্তিক উপন্যাসেরই প্রাধান্য দেখা যায়। আলাউদ্দিন আল আজাদের কর্ণফুলী (১৯৬২), শহীদুল্লা কায়সারের সারেং বৌ (১৯৬২) ও সংশপ্তক (১৯৬৫), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮), জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে (১৯৬৪), শামসুদ্দীন আবুল কালামের কাঞ্চনমালা (১৯৬৫), ইন্দু সাহার কিষান বউ (১৯৬৮), আবুল মনসুর আহমদের আবে হায়াত (১৯৬৮) প্রভৃতি উপন্যাস প্রসঙ্গত স্মর্তব্য। শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাসে বিবর্তমান গ্রামসমাজ এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসে পাশ্চাত্যের আধুনিক আঙ্গিকের সফল ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।

১৯৭১-পূর্ববর্তীকালে কিছু ভিন্নধর্মী উপন্যাসও রচিত হয়েছে। সেগুলিতে গ্রাম কিংবা নগরের পরিবর্তে বিষয়বস্ত্ত হিসেবে এসেছে ইতিহাস, পুরাণ ও ঐতিহ্য। রাজনৈতিক সচেতনতাও বহু উপন্যাসের মূল বিষয় হতে দেখা যায়। শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২), সৈয়দ শামসুল হকের সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪), জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন (১৯৬৪), খালেকদাদ চৌধুরীর রক্তাক্ত অধ্যায় (১৯৬৬), সত্যেন সেনের অভিশপ্ত নগরী (১৯৬৭), আনোয়ার পাশার নিষুতি রাতের গাথা, অজয় রায়ের পদধ্বনি (১৯৬৯) প্রভৃতি উপন্যাসে ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিবর্তে ঔপন্যাসিকদের রাজনৈতিক দর্শনই প্রধান হয়ে উঠেছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ কালপর্বের পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় শোষণের পরিপ্রেক্ষিতে উপন্যাসগুলির প্রকৃত তাৎপর্য গুরুত্ববহ। শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি-তে মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যের প্রেক্ষাপট থাকলেও তা সমকালের শোষণপিষ্ট জীবনের প্রতীকী রূপ। সৈয়দ শামসুল হকের সীমানা ছাড়িয়ে নগরজীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস হলেও এতে লেখকের রাজনৈতিক সচেতনতা লক্ষণীয়। জহির রায়হানের উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে বাঙালির আত্মদান ও রাজনৈতিক উত্থান তথা ভাষা আন্দোলনের কাহিনী। আনোয়ার পাশার উপন্যাসের চরিত্রসমূহের বিকাশ ঘটেছে সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাধারার সমান্তরালে।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মৌল পরিবর্তন আনে। সমালোচকদের মতে, স্বাধীনতার প্রত্যয় বাঙালির মন ও মননে যে নতুন চেতনার উদ্ভব ঘটায়, উপন্যাসেও তার প্রত্যাশিত প্রতিফলন লক্ষিত হয়। বস্ত্তত স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের উপন্যাস বিষয়বস্ত্ত ও আঙ্গিকগত দিক দিয়ে ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটও হয়ে ওঠে উপন্যাসের জন্য এক অতি প্রাসঙ্গিক বিষয়। ১৯৭১-এর পূর্বে উপন্যাস রচনা করেছেন এমন ঔপন্যাসিকেরও রচনার ধারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে (১৯৭২) ও শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩), আবদুল মান্নান সৈয়দের পরিপ্রেক্ষিতের দাসদাসী (১৯৭৪), আহমদ ছফার ওঙ্কার (১৯৭৫),  মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন (১৯৭৬), সেলিনা হোসেনের হাঙ্গর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬), বশীর আল হেলালের কালো ইলিশ (১৯৭৯), শওকত ওসমানের দুই সৈনিক প্রভৃতি স্বাধীনতাপরবর্তী এক দশকের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। এ সময়ের উপন্যাসগুলিতে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা লাভ, ব্যক্তির অস্তিত্বগত সমস্যা ও অন্তশ্চৈতন্যের জটিলতা, সমষ্টিবদ্ধ মানুষের জীবনচেতনা ও বিস্তারিত সমাজ-পটভূমি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী দশকের আরও কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিক হচ্ছেন রাজিয়া খান, রশীদ করীম, রিজিয়া রহমান, আবু রুশদ, শওকত আলী, হাসনাত আবদুল হাই, দিলারা হাশেম, মাহমুদুল হক, রশীদ হায়দার, রাবেয়া খাতুন প্রমুখ। সংখ্যাগত বিচারে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের উপন্যাস স্বাধীনতা-পূর্বকালের চেয়ে অনেক বেশি।

আশির দশকে প্রচুর উপন্যাস রচিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে ভালো উপন্যাসের সংখ্যাও অনেক। যুদ্ধ-পরবর্তীকালের ব্যক্তি ও সমাজ, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস, সমকালীন গ্রাম্যজীবন ও শহুরে জীবন, নরনারীর সম্পর্ক-বৈচিত্র্য, মনোবৈকল্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদি এ সময়কার উপন্যাসগুলির বিষয়বস্ত্ত। এ পর্বের কয়েকটি বিশিষ্ট উপন্যাস হলো: শওকত ওসমানের পতঙ্গ পিঞ্জর, রাহাত খানের অমল ধবল চাকরি, সেলিনা হোসেনের নীল ময়ূরের যৌবন, সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান, আবদুল মান্নান সৈয়দের কলকাতা, ইমদাদুল হক মিলনের ভূমিপুত্র, হাসনাত আবদুল হাইয়ের তিমি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই প্রভৃতি। চিলেকোঠার সেপাই বাংলাদেশের প্রথম উপন্যাস যার গদ্যভঙ্গি, বিষয় ও চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। উপন্যাসের খিজির নামক চরিত্র, গণ-আন্দোলনের পটভূমি ইত্যাদি বাংলাদেশে মহৎ উপন্যাস সৃষ্টির সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করে। ১৯৭১-এর পূর্বেকার গণ-আন্দোলনের পটভূমিকে এত সার্থকভাবে আর কোনো ঔপন্যাসিক তুলে ধরতে পারেননি। রশীদ হায়দার, মুর্তজা বশীর, রশীদ করীম, মঞ্জু সরকার, মাহবুব তালুকদার, রাজিয়া খান, রাবেয়া খাতুন, দিলারা হাশেম, বশীর আল হেলাল, আমজাদ হোসেন, আবু ইসহাক, আরেফিন বাদল, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুশ শাকুর, আনোয়ারা সৈয়দ হক, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন, শওকত আলী, শহীদ আখন্দ, সুচরিত চৌধুরী, শামসুর রাহমান, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, আবুবকর সিদ্দিক, হরিপদ দত্ত প্রমুখ এ সময়ের প্রতিষ্ঠিত ঔপন্যাসিক।

১৯৪৭ থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রায় অর্ধ শতকের উপন্যাস সমগ্র বাংলা সাহিত্যের নিরিখেই উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে সাম্প্রতিক কালে প্রবীণদের পাশাপাশি নবীনদের পদচারণাও লক্ষ্য করার মতো। বেশকিছু উপন্যাসের নাম করা যায় যেগুলি এ শতকের শেষ দশকে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে সংযোজিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে মঈনুল আহসান সাবের (কবেজ লেঠেল, প্রেম ও প্রতিশোধ, স্বজন) ও ভাস্কর চৌধুরীর (লাল মাটি কালো মানুষ, স্বপ্নপুরুষ, মীমাংসাপর্ব) মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলি উল্লেখযোগ্য। হাসনাত আবদুল হাই (সুলতান, নভেরা, ইন্টারভিউ) ও সেলিনা হোসেন (খুন ও ভালোবাসা, কালকেতু ও ফুল্লরা, ভালোবাসা প্রীতিলতা, যুদ্ধ) জীবনীভিত্তিক উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে স্মরণীয়। এক ধরনের অ্যান্টি-উপন্যাস রচনা করেন হুমায়ুন আজাদ (ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল ও রাজনীতিবিদগণ)। ইমতিয়ার শামীম (ডানাকাটা হিমের ভিতর) ও শহীদুল জহিরের (সে রাতে পূর্ণিমা ছিল) উপন্যাসে লক্ষ্য করা যায় বাস্তব ও পরাবাস্তবের কুহক। তবে যে উপন্যাস অর্ধশতককালের বাংলা উপন্যাসকে যথার্থ পরিণতির দিকে নিয়ে যায় তা হলো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা। এতকাল উপন্যাসে অবহেলিত ব্রিটিশ-উপনিবেশবিরোধী ফকির-বিদ্রোহের গৌরবময় অধ্যায়, সামাজিক পটভূমির বিশালতা, সর্বোপরি বাঙালির অহংদৃপ্ত জীবনচেতনা এ উপন্যাসটিতে চিত্রিত হয়েছে এক অননুকরণীয় ভাষা ও ভঙ্গিতে।

এ পর্বের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো: অরুণ চৌধুরীর ছায়াবন্দী, ইমদাদুল হক মিলনের রাজাকারতন্ত্র, হুমায়ুন আহমেদের এইসব দিনরাত্রি ও আগুনের পরশমণি, সৈয়দ শামসুল হকের বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ, আবদুল মান্নান সৈয়দের ক্ষুধা প্রেম আগুন, আলাউদ্দিন আল আজাদের অনূদিত অন্ধকার, হরিপদ দত্তের অজগর ও জন্ম জন্মান্তর, তসলিমা নাসরিনের অপর পক্ষ ও লজ্জা, মঞ্জু সরকারের প্রতিমা উপাখ্যান প্রভৃতি। আল মাহমুদ, ইসহাক খান, জুলফিকার মতিন, দিলারা হাশেম, ওয়াহিদ রেজা,  আনিসুল হক, আফসান চৌধুরী, নাসরীন জাহান, নিশাত চৌধুরী, হাসনাত আবদুল হাই, বুলবুল চৌধুরী, সামস্ রাশীদ, রেজানুর রহমান, রেজোয়ান সিদ্দিকী, রাজিয়া মজিদ, রফিকুর রশীদ, মহসিন শস্ত্রপাণি, মাফরুহা চৌধুরী, মালিহা খাতুন প্রমুখ এ সময়ের কয়েকজন খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর হাতে বাংলাদেশের উপন্যাসের যে শৈল্পিক সূচনা হয়েছিল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসে এসে তা পূর্ণতা লাভ করে। তবে বাংলাদেশের উপন্যাসের এ গতিপ্রবাহ থেমে নেই। একবিংশ শতকে সম্পূর্ণ নতুন ধারার উপন্যাসের সূত্রপাত যে ঘটবে তার পূর্বাভাস লক্ষিত হচ্ছে।  [মহীবুল আজিজ]

গ্রন্থপঞ্জি  শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, কলিকাতা, মডার্ণ বুক এজেন্সী, ১৯৪৫; অশোককুমার দে, বাংলা উপন্যাসের উৎস সন্ধানে, কলিকাতা, জিজ্ঞাসা, ১৯৭৪; সৈয়দ আকরম হোসেন, বাংলাদেশের সাহিত্য ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫; মুহম্মদ ইদরিস আলী, আমাদের উপন্যাসে বিষয়-চেতনা: বিভাগোত্তর কাল, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৮; বিশ্বজিৎ ঘোষ, বাংলাদেশের সাহিত্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯১; হাসান আজিজুল হক, কথাসাহিত্যের কথকতা, সাহিত্যপ্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৪।