আবেদ, স্যার ফজলে হাসান কেসিএমজি

আবেদ, স্যার ফজলে হাসান কেসিএমজি (১৯৩৬-২০১৯) বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক-এর প্রতিষ্ঠাতা। ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭শে এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। পিতা সিদ্দিক হাসান এবং মাতা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন-এর আট সন্তানের একজন ফজলে হাসান আবেদ।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ

১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আবেদ ১৮ বছর বয়সে ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগো-তে নৌ স্থাপত্যের ওপর অধ্যয়ন শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তানে নৌ-স্থাপত্যের ওপর পেশাগত উন্নয়নের সম্ভাবনা না দেখে তিনি লন্ডন-এর চাটার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট একাউনটেন্টস-এ যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে তিনি তাঁর পেশাগত অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন।

পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ফিরে তিনি শেল তেল কোম্পানিতে যোগদান করেন এবং দ্রুত এর আর্থিক বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। শেল-এ অবস্থানকালে ১৯৭০ সালের সাইক্লোন এবং জলোচ্ছ্বাস দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের জনপদের ওপর আঘাত হানে। ফলে, কমপক্ষে পাঁচ লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করে। সাইক্লোন আবেদের মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। আবেদ ও তার বন্ধুরা মিলে ‘হেল্প’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং তার মাধ্যমে মনপুরা দ্বীপে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে নিয়োজিত হন। এই জনপদের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষই এই সাইক্লোনে মারা যায়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্য অবস্থানকালে অন্যান্যদের সাথে তিনি এ্যাকশন কমিটিতে যুক্ত হন এবং ইউরোপের বিভিন্ন সরকারকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণের জন্য জোর তৎপরতা চালান। লন্ডনে অবস্থানকালে আবেদ তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে যে অর্থ পান, তা দিয়ে তিনি গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে দীর্ঘমেয়াদে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। দেশে ফিরে তিনি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত সুদূর সালনায় দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ শুরু করেন। এই প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে ১৯৭২ সালে গড়ে ওঠে বেসরকারি সংগঠন, যা ব্র্যাক নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় ব্র্যাকের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। এর বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ক্ষুদ্রঋণ, দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি, মানবাধিকার, কৃষি এবং উদ্যোক্তা বিকাশে অবদান রাখা। ২০০২ সালে আফগানিস্তানে এর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে ব্র্যাক আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিচয় মেলে ধরে। এই সময় থেকে ব্র্যাক আফ্রিকার ১০টি দেশে এর কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ঘটায়। এই দেশগুলোতে ভিন্ন-ভিন্ন ভৌগোলিক এবং আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্র্যাক একীভুত উন্নয়ন মডেলের সফল বাস্তবায়ন করে। চাকুরিরত কর্মচারি এবং সেবাগ্রহীতার সংখ্যার বিচারে ব্র্যাক বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি অলাভজনক সংগঠনে পরিণত হয়েছে।

২০১০ সালে ফজলে হাসান আবেদকে জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেল 'Group of Eminent Persons'-এর একজন সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন। এই গ্রুপের সদস্যদের দায়িত্ব হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সহায়তা প্রদানের বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবকে পরামর্শ প্রদান। ২০১৪ এবং ২০১৭ সালে ‘ফরচুন’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিশ্বের ৫০ জন সেরা নেতার তালিকায় তাঁর নাম স্থান পায়।

ব্যক্তি হিসেবে আবেদ বিনয়ী, নম্র এবং দয়ালু ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্র্যাকের কর্মকাণ্ডই এর পরিচয় তুলে ধরবে। সংগঠনের অভ্যন্তরে তিনি সকলের কাছে ‘আবেদ ভাই’ হিসিবে পরিচিত ছিলেন। আবেদ যে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত করেন তা ১ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান করে এবং বিশ্বের প্রায় ১১টি দেশের (বাংলাদেশসহ) ১০০ মিলিয়ন মানুষের কাছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ক্ষুদ্রঋণ এবং অন্যান্য সেবা পৌঁছে দেয়। দরিদ্র কেন দরিদ্র- এ বিষয়ে আবেদ-এর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল গরীবেরা ক্ষমতাহীন তাই তারা দরিদ্র।

ব্র্যাকের প্রথম দিকের কর্মকাণ্ড এবং প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল নারী এবং শিশুদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো। ব্র্যাকের রিহাইড্রেসন প্রকল্পটি সফল হয়। এর আওতায় ১৪ মিলিয়ন মায়েদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যারা চিনি, লবন এবং পানি মিশিয়ে এই প্রতিষেধকটি তৈরি করে। রক্ষা পায় বহু শিশুর জীবন। অতঃপর ব্র্যাক শিক্ষাক্ষেত্রে কার্যক্রম পরিচালনা করে। ১৯৯৯ সালের মধ্যে ব্র্যাক ৩৪,০০০ এরও অধিক স্কুল পরিচালনা করে।

ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রথমদিককার প্রবক্তাদের একজন হচ্ছেন ফজলে হাসান আবেদ। তিনি বিশ্বাস করতেন, অধিকাংশ দরিদ্র মানুষের কাছে পুঁজির সমস্যা হচ্ছে একটি বড় সমস্যা। ব্র্যাক প্রতিবছর ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়। পরবর্তীতে তিনি ‘ক্রমোন্নতি পদ্ধতি’ গ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে তিনি মানুষকে স্থায়ীভাবে দরিদ্রাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

ব্র্যাকের পাশাপাশি আবেদ বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৮১-৮২ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্ভার্ড ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-এর ভিজিটিং স্কলার ছিলেন। তিনি ঢাকায় অবস্থিত বেঙ্গল ইনস্টিটিউট ফর আর্কিটেকচার, লেন্ডস্কেপস এবং সেটেলমেন্টস-এর পরামর্শক বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। তিনি বহু সম্মানসূচক আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৮০ সালে তিনি ‘রেমন ম্যাগসাসাই কমিউনিটি লিডারশীপ’ পুরস্কার প্রাপ্ত হন। তিনি ২০০৪ সালে ‘ইউএনডিপি মাহবুবুল হক পুরস্কার’ লাভ করেন। ২০১০ সালে তিনি ‘নাইট কমান্ডার অব দি ওয়ার্ডার অব সেইন্ট মাইকেল’ এবং ‘সেইন্ট জর্জ’ (কেসিএমজি) পুরস্কারে ভূষিত হন।

তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান এবং কানাডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় এক ডজন সম্মানসূচক পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন।

ব্র্যাকের একটি বিশিষ্ট অভ্যন্তরীণ কর্মপরিবেশ রয়েছে। এই কর্মপরিবেশে উন্নয়ন কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ব্র্যাকের সদস্যদের নিজ পরিশ্রম ও উদ্যোগে নির্মিত পণ্যাদি বাজারজাতকরণের জন্য একটি বিক্রয় বিপণনী কেন্দ্র রয়েছে, যা ‘আড়ং’ নামে পরিচিত। ব্যাংকসহ একাধিক সামাজিক ব্যবসাও ব্র্যাক-এর অন্তর্ভুক্ত। ২০১৯ সালে আবেদ ‘ডাচ নাইটহুড’ উপাধিতে ভূষিত হন।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ ২০১৯ সালের ২০শে ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক কন্যা, এক পুত্র সন্তান রেখে যান। [সাব্বীর আহমেদ]