বানিয়া

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:২৭, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

বানিয়া  আঠারো ও উনিশ শতকে ইউরোপীয় বণিকদের স্থানীয় দালাল ও প্রতিনিধি। সংস্কৃত ও বাংলা ‘বণিক’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ ইংরেজি ‘বানিয়ান’। ইঙ্গ-ভারতীয় সমাজ ও দেশীয়দের মধ্যে বানিয়া ছিল সেই ব্যক্তি যাকে কোন ইউরোপীয় বণিক তাঁর দালাল ও এজেন্ট হিসেবে কাজ করার জন্য নিয়োগ করতেন। এ বানিয়াদের প্রায় সকলেই ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু, বিশেষ করে ব্রাহ্মণ

ইউরোপীয় বণিকেরা সাধারণত স্থানীয় ভাষা, রীতিপ্রথা, ব্যবসা কেন্দ্র, স্থানীয় পর্যায়ে প্রচলিত পণ্যের মাপ ইত্যাদি জানত না এবং মফস্বলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বা বাজারের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকায় নির্দেশনা লাভের জন্য তাদের স্থানীয় এজেন্ট নিয়োগের প্রয়োজন হতো। এ বানিয়ারা ছিল তাদের জন্য দোভাষী, মধ্যস্থতাকারী, দরকষাকষির লোক, এমনকি তাদের তহবিল সংরক্ষণকারী। বানিয়াদের কাজ ও সেবার জন্য তাদেরকে কমিশন দেওয়া হতো। এ কমিশনের পরিমাণ ছিল সাধারণত লেনদেনকৃত পণ্যমূল্যের দুই শতাংশ। ইউরোপীয় মনিবগণ জাহাজে করে এদেশে পৌঁছানোর পর বানিয়ারা তাদের  অভ্যর্থনা জানাত, তাঁদের থাকা-খাওয়ার আয়োজন করত, তাঁরা যতদিন থাকতেন ততদিনের জন্য তাঁদের ভৃত্য নিয়োগ করত, জাহাজে পণ্য বোঝাই ও খালাস করত, বণিকদের নিয়ে আসা রূপা সিক্কা টাকায় রূপান্তরিত করত, তাঁদেরকে হাটবাজারে নিয়ে যেত, প্রয়োজনে মূলধন জোগাত ও পরিশেষে তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্য বিদায় সম্বর্ধনায় বাইজি নাচের আয়োজনও করত। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এদেরকে দোভাষ ও চীনে কমপ্রাদোর বলা হতো।

ফোর্ট উইলিয়মএর গভর্নর ও কাউন্সিল সদস্যদের প্রত্যেকেরই এক বা একাধিক বানিয়া ছিল যারা তাঁদের ব্যবসায়-বাণিজ্য দেখাশোনা করত। বানিয়ারা কেবল দালাল বা এজেন্ট নয়, পুঁজির জোগানদারও ছিল। বলা হয়ে থাকে, কোন কোন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীর মূলধনের প্রায় সবটাই স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হতো, আর এ ক্ষেত্রে মূলধনের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল এই বানিয়ারা।

পলাশীর ঘটনার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের লগ্নিমূল্য ও পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে যায়। একই কারণে বানিয়াদের গুরুত্বও বাড়ে। আগে যেমন উচ্চাভিলাষী ভারতীয়রা নওয়াবের দরবারে অনুগ্রহলাভের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতো, পরবর্তীকালে তেমনি তাদেরকে ইংরেজ গভর্নর ও কাউন্সিল সদস্যদের অনুগ্রহলাভের জন্য প্রতিযোগিতা করতে দেখা যায়। কোম্পানি কর্মকর্তাদের মধ্যে দলাদলি বা নানা উপগোষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকায় বানিয়ারা এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ধনী হওয়ার কৌশল দ্রুত রপ্ত করে নেয়।

এসব বানিয়াদের মধ্যে যাঁরা কিংবদন্তিসুলভ ধনের অধিকারী ও প্রভাবশালী হয়েন ওঠে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন: কান্তবাবু, রামদুলাল দে, নবকৃষ্ণ দেব, গোকুল ঘোষাল, জয়নারায়ণ ঘোষাল, নকু ধর, জয়কৃষ্ণ সিংহ, গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ, দর্পনারায়ণ ঠাকুর, কাশীনাথ বাবু ও এমন আরও অনেকে। উনিশ শতকের কলকাতা ও বাংলায় যেসব বৃহৎ ও বিখ্যাত পরিবারের উদ্ভব ঘটে, সেপরিবার সমূহের প্রতিষ্ঠাতাদের প্রায় সবাই ছিলেন বানিয়া। তাঁদের সম্পদ দিয়ে কলকাতায় যেমন বহু প্রাসাদতুল্য ইমারত গড়ে ওঠে, তেমনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এর পর তারা তাদের নিজ নিজ গ্রামে জমিদারি ও কোম্পানির বন্ড কেনেন। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেও তাঁদের সে অর্থ ব্যয় করা হতো।

১৭৮৫ সালের পর থেকে কলকাতায় স্থাপিত এজেন্সি হাউসগুলি রপ্তানি বাণিজ্যে বানিয়াদের জায়গা নিতে শুরু করে। তবে শ্রেণি হিসেবে এ বানিয়াদের রাতারাতি অবক্ষয় শুরু হয় নি কিংবা বিলুপ্তিও ঘটে নি। ১৭৮৫ সালের পর আমেরিকান বণিকেরা বাংলায় আসতে শুরু করে ও নেপোলিয়নের যুগের যুদ্ধ চলাকালে বাংলার রপ্তানিতে তাঁদের বিনিয়োগ দ্রুত বেড়ে যায়। অপেক্ষাকৃত অনেক সস্তায় বানিয়াদের সেবা পাওয়া যাবে এ বিবেচনায় আমেরিকান বণিকেরা এজেন্সি হাউস প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বানিয়া নিয়োগ করে। ১৮১৩ সালের সনদ আইন পাসের পর ভারত মুক্তবাণিজ্যের আওতায় এলে বহু বিদেশী বাংলার বৈদেশিক বাণিজ্যে অংশ নিতে আসে। এর অর্থ ছিল, বানিয়া শ্রেণির জন্য সুযোগের এক নতুন দরজা খুলে যাওয়া। অবশ্য এ সুযোগ খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ব্যাংকিং ও অন্যান্য সেবা সুবিধা গড়ে ওঠার পটভূমিকায় বানিয়ারা তাদের গুরুত্ব হারায়। ১৮৫০ সাল নাগাদ শ্রেণি হিসেবে বানিয়াদের বিলুপ্তি ঘটে।  [সিরাজুল ইসলাম]