নীল প্রতিরোধ আন্দোলন
নীল প্রতিরোধ আন্দোলন (১৮৫৯-১৮৬২) শোষক নীল উৎপাদকদের বিরুদ্ধে শোষিত নীল চাষীদের প্রতিরোধ আন্দোলন। বিশ্ব বাজারের জন্য নীল উৎপাদন করতে উৎপাদকরা রায়তদের (নীল চাষী) ওপর চাপ প্রয়োগ করত। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে নীল উৎপাদন ও রপ্তানির ব্যবসা ছিল রমরমা। কিন্তু উনিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে এ বাজার মন্দা হয়ে আসে। এর ফলে নীল চাষীদের নিকট নীলচাষ অলাভজনক বিবেচিত হয়। এ কারণে চাষীরা নীলচাষে অনাগ্রহ প্রকাশ করতে থাকে। কিন্তু ইতোমধ্যে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রচুর পুঁজি লগ্নি করায় এবং তা দ্রুত প্রত্যাহার করা সম্ভব না হওয়ায় উৎপাদকরা নীল চাষের জন্য রায়তদের ওপর বল প্রয়োগ করতে থাকে। ফলত নীল উৎপাদক ও চাষীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নীল চাষের বিরুদ্ধে রায়তদের প্রকাশ্য প্রতিরোধ আন্দোলনের রূপ নেয়। ১৮৫৯ সালে যশোর ও নদীয়ায় এ আন্দোলনের সূচনা হয়। দ্রুত এ আন্দোলন নীল চাষের আওতাভুক্ত অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৮৬২ সালে রায়তদের অনুকূলে সরকারি হস্তক্ষেপের পূর্ব পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে।
রং করার উপকরণ হিসেবে প্রাচীনকালেও বাংলায় নীল চাষের প্রচলন ছিল। তখন বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে নয়, নীল উৎপাদন করা হতো পারিবারিক ও ধর্মীয় প্রয়োজন মেটাতে। আঠারো শতক থেকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নীল চাষ শুরু হয় বলে মনে করা হয়। ঊনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে প্রচুর নগদ অর্থ প্রাপ্তির কারণে নীল চাষের প্রতি রায়তদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। রায়তদের নগদ অর্থে ভূমিকর পরিশোধ করতে হতো। ফলে প্রচলিত ফসলের সঙ্গে নীল চাষের সংযোজনকে তারা স্বাগত জানায়। নীল ছিল একটি রপ্তানি পণ্য এবং ইউরোপীয় উৎপাদকরাই প্রধানত এ রপ্তানি কার্যক্রম গড়ে তুলেছিল। তবে শুধু রাজনৈতিক কারণেই ১৮৩৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত নীলকরেরা জমির মালিকানা লাভ করতে পারেনি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে ১৮৩৭ সালের Act IV-এর মাধ্যমে ইউরোপীয় উৎপাদকদের জমি ক্রয় ও দখলের অধিকার প্রদান করা হয়। এ আইন প্রণয়নের পূর্বে রায়তি প্রথার মাধ্যমে নীল চাষ করা হতো। এ ব্যবস্থায় জমিতে প্রজাস্বত্ব অধিকারসহ উৎপাদনের সকল উপকরণের অধিকারী ছিল রায়তগণ। পরবর্তীসময়ে উৎপাদকদের বন্দোবস্তপ্রাপ্ত নীল চাষের জমিতে রায়তগণ এক ধরনের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকে পরিণত হয়।
রায়ত ও নীল উৎপাদকদের মধ্যে মুনাফা ও সম্প্রীতির সম্পর্কের দিক থেকে ঊনিশ শতকের প্রথম তিন দশককে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বর্ণযুগ রূপে চিহ্নিত করা যায়। এর পরেই ক্রমাগত মন্দা ভাব দেখা দেয়। নীল উৎপাদকদের সবচেয়ে বেশি পুঁজি লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন এজেন্সি হাউস ও ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অব ক্যালকাটা ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেউলিয়া ঘোষিত হয়। এ কারণে এবং আমেরিকায় নতুন স্বর্ণখনি আবিষ্কার ও ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ক্রিমিয়া যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতিতে নীল উৎপাদকদের মুনাফা হ্রাস পায়। এতে কৃষকদের লাভের পরিমাণও কমতে থাকে। উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, খাদ্যশস্য, তেলবীজ ও পাট উৎপাদন নীলের চেয়ে অনেক লাভজনক হয়ে দাঁড়ায়। নীল উৎপাদনকারী জেলাগুলির ওপর দিয়ে রেললাইন তৈরি হতে থাকায় অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। এতে করে স্থানীয়ভাবে শ্রমিকের মজুরি হঠাৎ বেড়ে যায়। নীল চাষের জন্য উৎপাদকরা শ্রমিকদের যে মজুরি দিত তার সঙ্গে এই বর্ধিত মজুরি ছিল বেশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। নীল চাষ রায়তদের জন্য লাভজনক না হলেও নীল উৎপাদকরা তাদের নীল চাষে বাধ্য করত। এ অবস্থায় নীল উৎপাদকদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য রায়তরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। প্রধান নীল উৎপাদক জেলা নদীয়া ও যশোরের রায়তগণ আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে এসে দাঁড়ায়।
বিভিন্ন জেলায় নীল চাষ প্রতিরোধের কর্মকান্ড ভিন্নতর ছিল। কর্ম-অস্বীকৃতি ও অসহযোগিতা থেকে শুরু করে প্রতিরোধ আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহের পর্যায়ে পৌঁছে। কখনও কখনও রায়তরা ইউরোপীয় উৎপাদক ও তাদের স্থানীয় এজেন্টদের সামাজিকভাবে বয়কট করে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে এবং ষাটের দশকের প্রথম দিকে নীল বিদ্রোহ সহিংস রূপ লাভ করে এবং তা প্রায় সকল নীল উৎপাদনকারী জেলাগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহী রায়তরা খ্রিস্টান মিশনারিদের সহানুভূতিশীল সমর্থন লাভ করে। মিশনারিরা মানবিক কারণে এবং ধর্মান্তরীকরণের উদ্দেশ্যে নীল উৎপাদকদের অত্যাচার ও শোষণের চিত্র তুলে ধরে। মিশনারিদের উৎসাহে স্থানীয় সংবাদপত্র নীল চাষের নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। চার্চ মিশনারি সোসাইটির রেভারেন্ড জেমস লঙ ছিলেন নীল উৎপাদকদের সবচেয়ে সোচ্চার সমালোচক। যশোর জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল লতিফ নীল উৎপাদকদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি রায় প্রদান করেন। দীনবন্ধু মিত্র রচিত নাটক নীল দর্পণ এবং কিশোরীচাঁদ মিত্র ও হরিশচন্দ্র মুখার্জীর পত্রিকায় প্রকাশিত মন্তব্য বিদ্রোহী রায়তদের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করে। অবশেষে এদিকে সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং ১৮৬০ সালে সরকার একটি কমিশন নিয়োগ করে। এ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর বলপূর্বক নীল চাষে বাধ্য করার কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি আইন পাস হয়। সরকারের এ পদক্ষেপের ফলে নীল প্রতিরোধ আন্দোলনের অবসান ঘটে। [নূরুল হোসেন চৌধুরী]