আতিয়া মসজিদ
আতিয়া মসজিদ টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে দেলদুয়ার উপজেলার অন্তর্গত আতিয়া গ্রামে লৌহজং নদীর পূর্ব পারে অবস্থিত। ছোট এ মসজিদের বহির্ভাগের পরিমাপ ১৮.২৯ মি x ১২.১৯ মি এবং এর দেয়াল ২.২৩ মি প্রশস্ত। এক গম্বুজবিশিষ্ট বর্গাকৃতির মসজিদটির পূর্বদিকে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র তিন গম্বুজবিশিষ্ট আয়তাকৃতির বারান্দা রয়েছে। পূর্বদিকে খিলানবিশিষ্ট তিনটি প্রবেশপথ, মাঝখানেরটি দুপার্শ্বের প্রবেশপথ থেকে সামান্য উঁচু।
আতিয়া মসজিদের খিলানগুলি চতুর্কেন্দ্রিক রীতির। বারান্দা থেকে তিনটি প্রবেশপথের মাধ্যমে প্রধান প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশ করা যায়। এ ছাড়া দক্ষিণ ও উত্তর দিকে দুটি করে প্রবেশপথ রয়েছে। কিবলা দেয়ালে তিনটি অলঙ্কৃত মিহরাব আছে; কেন্দ্রীয় মিহরাবের পেছনে বাইরের দেয়াল কিছুটা প্রক্ষেপিত। মসজিদের চার কোণে চারটি অষ্টভুজাকৃতির পার্শ্ব বুরুজ রয়েছে যা সমদূরত্বে মোল্ডিং নকশায় বিভক্ত। কয়েকটি স্তরে উদ্গত নকশা দ্বারা অলঙ্কৃত পার্শ্ব বুরুজগুলি ছাদের কার্নিশের উপর পর্যন্ত উঠে গেছে। সব শেষে বুরুজগুলি পলকাটা ছোট গম্বুজযুক্ত এবং কলস ফিনিয়ালে অলঙ্কৃত। প্রধান গম্বুজটি খিলানভিত্তিক স্কুইঞ্চ পদ্ধতিতে নির্মিত এবং বারান্দার উপর স্থাপিত অপেক্ষাকৃত ছোট তিনটি গম্বুজ পেন্ডেন্টেটিভ পদ্ধতিতে নির্মিত। এ তিনটি ছোট গম্বুজ আদিতে পলকাটা নকশাযুক্ত ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রধান গম্বুজটি ধ্বসে পড়েছিল এবং সম্প্রতি এটি পুনঃনির্মিত হয়েছে। যদিও সামনে অবস্থিত তিনটি গম্বুজ পলকাটা ছিল, বর্তমানে পলেস্তরার প্রলেপে এগুলির আদি বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দৃষ্টিনন্দন প্রধান গম্বুজ এ মসজিদের খুবই উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এবং তা অষ্টভুজাকৃতি ড্রামের উপর স্থাপিত। গম্বুজগুলিতে কলস ফিনিয়াল এবং ভিতের চারদিকে বদ্ধ মারলোন নকশা বেষ্টিত। আতিয়া মসজিদের ধনুকবক্রাকৃতির কার্নিশ একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এ মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের শীর্ষে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংবলিত প্রহরা দেয়াল (battlemented wall) লক্ষ্য করা যায়।
আতিয়া মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দেয়াল অলঙ্করণ নকশার জন্য বিশেষ উল্লেখের দাবিদার। এতে টেরাকোটা ও ইট খোদাই নকশাতে চমৎকার আঞ্চলিক মোটিফ দ্বারা অলঙ্করণ লক্ষণীয়। সম্পূর্ণ ফাসাদ সূক্ষ্ম, বিস্তৃত একই রকম প্যানেল নকশায় আচ্ছাদিত। এতে রয়েছে অসংখ্য ফুলের অলঙ্করণ, চক্রাকার ‘রোজেট’, জ্যামিতিক নকশা ইত্যাদি। পূর্ব ফাসাদ অসংখ্য ক্ষুদ্র আয়তাকৃতির টেরাকোটা প্যানেল নকশায় দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে। এ ধরনের অলঙ্করণ ষোলো শতকের প্রথম পাদে গৌড়ের মসজিদে পরিলক্ষিত হয়; উদাহরণস্বরূপ ঝনঝনিয়া মসজিদ (১৫৩৫ খ্রি.) ও কদম রসুল ইমারত (১৫৩০ খ্রি.)-এর নাম করা যায়। আতিয়া মসজিদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এর কুঁড়েঘরের কার্নিসের ন্যায় ধনুক বক্রাকার কার্নিশ যা সম্পূর্ণরূপে বাংলার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য রূপে পরিগণিত। এ ধরনের আচ্ছাদনের উৎপত্তিতে আদি অকৃত্রিম বাংলার ছনের কুটিরের বাঁকানো চালের প্রভাব পরিস্ফুট। বস্ত্তত বাঁশের চালাঘর থেকে ইটের নির্মাণে এ ধরনের উদ্ভাবন শিল্পমানে আকর্ষণীয় এবং নির্মাণ ক্ষেত্রে নবরূপ বলে বিবেচিত।
অলঙ্করণ বিশেষ করে টেরাকোটা নকশা ও খোদাই ইটের নকশায় বাংলার ওস্তাগর-শিল্পীরা সুস্পষ্ট অবদান রেখেছেন। বাংলার গ্রামের খড়ের তৈরী কুঁড়ে ঘরের বেড়ার খোপ নকশা আতিয়া মসজিদের ফাসাদ অলঙ্করণে স্থান করে নিয়েছে। মসজিদটিতে সুলতানি ও মুগল স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের একটি সুষম সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশে জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত শিলালিপিতে আতিয়া মসজিদটির নির্মাণকাল ১০১৯ হিজরি (১৬১০-১১ খ্রি.) উল্লেখ আছে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে বায়েজীদ খান পন্নীর পুত্র সাইদ খান পন্নী শাহ বাবা কাশ্মীরির সম্মানার্থে মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। নির্মাতা মসজিদের পশ্চিম দিকে একটি বড় জলাশয় খনন করেন।
শাহ বাবা কাশ্মীরির আগমনে আতিয়া প্রাধান্য লাভ করে। তিনি বাংলার এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। বর্তমানে আদি শিলালিপির অনুরূপ একটি লিপি কেন্দ্রীয় প্রবেশ পথের শীর্ষে প্রোথিত আছে। এ থেকে জানা যায় যে, ১০১৮ হিজরিতে (১৬০৯ সাল) মসজিদটি নির্মিত।
আতিয়া মসজিদটি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত ইমারত। ইতঃপূর্বে রওশন খাতুন চৌধুরানী কর্তৃক ১৮৩৭ সালে এবং আবু আহমেদ গজনবী কর্তৃক ১৯০৯ সালে মসজিদটি দুবার সংস্কার করা হয়েছে। [আয়শা বেগম]
আরও দেখুন মসজিদ স্থাপত্য।