শামসুল উলামা, আবু নসর ওহীদ
শামসুল উলামা, আবু নসর ওহীদ (১৮৭৮-১৯৫৩) শিক্ষাবিদ। ১৮৭৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সিলেট শহরে তাঁর জন্ম। পৈতৃক নিবাস ছাতকের হাসানাবাদে। তাঁর পিতা কারি জাভিদ বখ্ত ছিলেন মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরীর শিষ্য। পারিবারিক পরিমন্ডলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর ১৮৯২ সালে আবু নসর সিলেট সরকারি হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স, মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে এফএ (১৮৯৫), কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৯৭ সালে আরবিতে অনার্সসহ বিএ ও এমএ পাস করেন।
বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আবু নসর ওহীদই সর্বপ্রথম আরবিতে অনার্স ও এমএ পাস করার গৌরব অর্জন করেন। তিনি ঐতিহাসিক রিফর্ম মাদ্রাসা স্কিম বা নিউ স্কিম (১৯২৪) প্রবর্তন করে ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে স্মরণীয় হয়ে আছেন। কর্মজীবনে তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। বিএ পরীক্ষা দেওয়ার পর কিছুদিন তিনি সিলেট সরকারি স্কুল ও কলকাতা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ১৯০১ সালে তিনি গৌহাটিস্থ কটন কলেজে আরবি-ফারসির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। সেখান থেকে ১৯০৫ সালে ঢাকা মাদ্রাসার (স্থাপিত ১৮৭৪) সুপারিনটেন্ডেন্ট হন। ১৯১৯ সালে মাদ্রাসাটি নিউ স্কিমের আওতায় ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে উন্নীত হলে তিনি তার অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন এবং ১৯২৭ সালে অবসর গ্রহণের পূর্বপর্যন্ত ওই পদে বহাল ছিলেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং এ বিভাগকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন।
আবু নসর কর্মজীবনে মাদ্রাসা সংস্কার কমিটি (১৯০৬), আর্ল কনফারেন্স (১৯০৭), শার্ফ কমিটি (১৯০৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি (নাথান কমিটি ১৯১২) ইত্যাদি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটিতে সচিব বা সদস্য হিসেবে গুরু দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান-ইসলামী শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার মধ্যে ফলপ্রসূ সমন্বয়ের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়কে শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করা; নিউ স্কিমের মাধ্যমে ইসলামী ভাবধারাসম্পন্ন একদল বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও সরকারি চাকরিজীবী তৈরি করে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি গোঁড়া মুসলমান সমাজের বিদ্বেষ প্রশমন করা এবং আধুনিক পদ্ধতিতে আরবি চর্চার মজবুত ভিত রচনা করা। শেষজীবনে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে নয় মাসের জন্য আসামের শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন।
মাতৃভাষা ছাড়া তিনি আরবি, ইংরেজি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। বাংলায় দীনিয়াত শিক্ষাসহ আরবি সাহিত্যের ওপর তাঁর বেশ কয়েকটি আদর্শ সংকলন রয়েছে। পান্ডিত্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকার কর্তৃক তিনি আই.ই.এস (১৯২১) ক্যাডারভুক্ত হন ও ‘শামসুল উলামা’ (১৯০৯) উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৫৩ সালের ৩১ মে ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। [এ.কে.এম নূরুল আলম]
শামুক Mollusca পর্বের Gastropoda শ্রেণীর নরমদেহী প্রাণীর সাধারণ নাম। এদের এক জোড়া অথবা দুই জোড়া শুঙ্গ থাকে; মাথা স্পষ্ট, পা চওড়া। এদের শরীর একটি পেঁচানো খোলকে আবৃত। কদাচিৎ খোলক অনুপস্থিত। এই পর্বের হাজার হাজার প্রজাতি স্থলভাগ, সমুদ্র বা স্বাদুপানির বাসিন্দা। Pulmonate বর্গের অনেক শামুকের ম্যান্টল গহবরটি রক্ত বাহিকায় সমৃদ্ধ এবং ফুসফুসের মতো কাজ করে। স্থলে বাস করে এমন শামুকদের মাথায় দুই জোড়া কর্ষিকা থাকে, যা প্রয়োজনে গুটিয়ে রাখা যায়। পেছনের জোড়া কর্ষিকার আগায় থাকে চোখ (Stylommatophora)। জলজ পাটমোনেটদের মাথায় থাকে এক জোড়া কর্ষিকা যা গুটানো যায় না, চোখ থাকে কর্ষিকার গোড়ায় (Basommatophora)।
জীবাশ্ম তথ্য থেকে জানা যায়, গ্যাস্ট্রোপোডদের প্রথম উদ্ভব হয়েছিল ক্যাম্ব্রিয়ান যুগে, আজ থেকে প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে। কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলে গ্যাস্ট্রোপোডদের বিস্তৃতির সময়কাল জানা যায়নি। শামুকের খোলকের আকার-আকৃতির বৈচিত্র্য সীমাহীন; দৈর্ঘ্য হতে পারে ১ মিমি থেকে ৩৮০ মিমি। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত প্রায় ৫০,০০০ শামুক প্রজাতির মধ্যে ২২,০০০ স্থলচর, ২৩,০০০ সামুদ্রিক, ৫,০০০ স্বাদুপানির। বাংলাদেশে বিদ্যমান উপ-উষ্ণমন্ডলীয় মৌসুমি জলবায়ু এবং সমৃদ্ধ গাছপালা, প্রাকৃতিক নদী ও স্রোতস্বিনী, জলাভূমি, কৃত্রিম হ্রদ, বদ্ধ-জলাশয় ও দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৪৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র উপকূলসহ বিশাল সমুদ্রের গভীর জলরাশি স্থলচর শামুক, স্বাদুপানির শামুক ও সামুদ্রিক শামুকের জন্য উৎকৃষ্ট আবাসস্থল যোগায়। অবশ্য, বাংলাদেশে কত প্রজাতির শামুক আছে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ তালিকা নেই। এক হিসাব থেকে জানা যায় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৪০টি গোত্রের ২১২টি প্রজাতির সামুদ্রিক শামুক সম্পর্কে জানা গেছে।
বাংলাদেশে ২৪ প্রজাতির স্থলচর (Cyclophoridae ৩, বিদেশী Achatinadae ১, Enidae ১, Ariophantidae ২, Glessulidae ১, Zonitidae ১৬) এবং ৮০ প্রজাতির জলজ/স্বাদুপানির (Neritidae ৫, Viviparidae ৮, Pilidae ৩, Hydrobidae ৫, Bithynidae ১০, Stenothyridae ৫, Thiaridae ২২, Lymnaeidae ১০, Ancylidae ১, Planorbidae ১১) শামুক রেকর্ড করা হয়েছে। অনুমান করা হয় যে, বাংলাদেশে শামুক প্রজাতির সংখ্যা ৩০০টিরও বেশি। স্থলচর শামুক Cyclophorus auranticus ও C. aurora কেবল সিলেটের চিরসবুজ পার্বত্য বনাঞ্চলেই দেখা যায়। শামুক গাছের আধা-পচা পাতা খায় এবং বর্ষামৌসুমে বৃষ্টির পর দিনে ও রাতে সক্রিয় থাকে। শামুক জীববস্ত্তকে মাটির উপাদানে পরিণত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সব স্থলচর শামুক শুষ্ক মৌসুমে গ্রীষ্মনিদ্রায় যায়। স্থলচর শামুক Macrochlamys indica ও M. sequax সারা দেশে শাক-সবজির ব্যাপক ক্ষতি করে। সম্প্রতি স্থলচর শামুক বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তুঁতগাছের ভয়ানক ক্ষতি করছে। বিজ্ঞানী বেনসন ১৮৪৭ সালে মরিশাস থেকে স্থলচর বড় আকারের শামুক Achatina fulica এনে কলকাতার রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির বাগানে ছেড়েছিলেন। ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ ও মৌলভী বাজার জেলা ছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য প্রায় সব জেলায় এই শামুক বিস্তৃতি লাভ করেছে। শামুক শাকসবজি থেকে শুরু করে শস্য, দারুবৃক্ষ, বাহারি উদ্ভিদের মারাত্মক ক্ষতি করে। পাশ্চাত্যে A. fulica শামুক প্রোটিনসমৃদ্ধ একটি উপাদেয় খাদ্য। বাংলাদেশের উপজাতি সম্প্রদায়ের কেউ কেউ স্বাদুপানির Bellamya bengalensis ও Pila globosa শামুক খায়। B. bengalensis ও P. globosa শামুক বিদেশ থেকে আনা Clarias gariepinus নামের মাগুর মাছদের এবং গৃহপালিত হাঁসের পরিপূরক খাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। সম্প্রতি P. globosa শামুককে টুকরো টুকরো করে কেটে Macrobrachium rosenbergii ও Penaeus monodon নামের চিংড়িকেও খাওয়ানো হচ্ছে।
B. bengalensis, P. globosa, Lymnaea luteola, L. acuminata, L.stagnalis, Indoplanorbis exustus ও Gyrulus convexiusculus প্রজাতিগুলি মানুষ, গৃহপালিত পশু ও পাখির জন্য ক্ষতিকর পরজীবী trematod-এর লার্ভার পোষক। অধিকাংশ সামুদ্রিক শামুকের খোলস বিচিত্র বর্ণের এবং দেখতে অত্যন্ত চমৎকার বিধায় নানাভাবে ব্যবহার্য। ব্রেসলেট বা বাজুবন্ধ, গলার হার, হাতের বালা, চাবির রিং ও ছাইদানি, শিঙ্গা বা শাঁখ (Turbinella pyrum) হিসেবে, ক্যামিও খোদাইর জন্য, কিউরিও ও মুক্তা হিসেবে এদের ব্যবহার বেশ ব্যাপক। [মো. সরোয়ার জাহান]