শিখধর্ম
শিখধর্ম গুরু নানক (১৪৬৯-১৫৩৮/৯) প্রবর্তিত ধর্ম। এ ধর্মের মূলকথা নিরাকার এক ঈশ্বরের উপাসনা করা। তিনি নিরাকার। দুঃখময় এই পৃথিবীতে মানুষকে ভালবাসাই ধর্ম এবং এরফলে শান্তিতে বসবাস করা যায়, আর ধর্মজীবন পালনের মাধ্যম হল গুরু। প্রত্যেক ধর্মগুরুকে ভালোবাসা, কোনো কিছুর গর্ব না করা এবং ধর্মের সারাংশকে বিনয় ও সমবেদনা বলে জানা এ ধর্মে অবশ্য পালনীয় কর্ম। দীর্ঘপ্রার্থনা, মন্ত্রোচ্চারণ, কৃচ্ছ্রসাধনা, যোগপদ্ধতি প্রভৃতির দ্বারা পূজা হয় না, বরং লোভের জগতে পবিত্র জীবনযাপন করতে পারলেই পূজা সার্থক হয়। যিনি সকলকে সমান বলে মনে করেন তিনিই প্রকৃত ধার্মিক। শিখধর্মে কোনো জাতিভেদ নেই, সকল মানুষ সমান। কোনোরূপ সামাজিক কুসংস্কার বা ধর্মীয় গোঁড়ামিও নেই এ ধর্মে। শিখদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের নাম ‘গুরু দুয়ারা’। এখানে কারও প্রবেশে বাধা নেই। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই গুরু দুয়ারায় প্রবেশ করে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। শিখরা বস্ত্তবাদ এবং প্রগতিশীল সমাজ-ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
শিখদের প্রধান মন্দির পাঞ্জাবের অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির। সেখানকার ‘অকাল তখত সাহেব’ মন্দিরটি সর্বাধিক গুরুতপূর্ণ। ওখান থেকে শিখ সম্প্রদায়ের জন্য ধর্মীয় ও দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্পর্কিত নির্দেশাবলি জারি করা হয়। এই নির্দেশগুলিকে বলা হয় ‘হুকুমনামা’। এই হুকুমনামা শিখদের ব্যক্তিগত আইনস্বরূপ, যা পালন করা অবশ্য কর্তব্য। প্রত্যেক গুরু দুয়ারায় হলুদ রঙের পতাকা টাঙানো থাকে। একে বলে ‘নিশান সাহেব’। এর দুদিকে তলোয়ারের ছবি অাঁকা থাকে, যা ‘খান্ডা’ নামে পরিচিত। শিখ-জীবনের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক মিশ্রণের প্রতীক এই নিশান। বাংলাদেশে শিখ সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উপাসনালয় গুরুদুয়ারা নানক শাহী। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে অবস্থিত।
শিখধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক পাকিস্তানের লাহোরের তালওয়ান্দি গ্রামে ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নামানুসারে ওই গ্রামের নাম হয়েছে নানকানা সাহেব। গুরু নানক প্রথম জীবন থেকেই সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদির বিরোধী ছিলেন। তাঁর সহযোগী অপর নয়জন গুরুও ছিলেন অনুরূপ। তাঁরা শুদ্ধ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁদের প্রথম পাঁচজনকে বলা হয় ‘পঞ্জ-পিয়ারে’। তাঁরা হলেন নানক (১৪৬৯-১৫৩৮/৯), অমরদাস (১৪৭৯-১৫৭৪), অঙ্গদ (১৫০৪-১৫৫২/৩), রামদাস (১৫৩৪-১৫৮১) এবং অর্জুন সিং। এঁরা সবাই এক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং একই ব্রত অনুসরণ করতেন। এঁদের মতবাদ এবং অন্যান্য ধর্মীয় মতবাদ একত্রিত করে শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেব রচিত হয়।
সৃষ্টিকর্তার একত্ব এবং মানুষের ভ্রাতৃত্ব গুরু নানকের শিক্ষার মূলনীতি। তিনি পুরোহিততন্ত্র, মূর্তিপূজা ও বর্ণাশ্রম প্রথার বিরোধী ছিলেন। তিনি হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের সারতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আপন ধর্মমত প্রচার করেন। তিনি সহনশীলতার বাণী প্রচার এবং হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক মিলনের চেষ্টা করেন। নানকের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের নৈতিক জীবনের সংস্কার করা। তাই হিন্দু-মুসলমানসহ অন্যান্য সকল ধর্মের লোকই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে।
গুরু নানক তাঁর এই শিক্ষা ও আদর্শ প্রচারের লক্ষ্যে ১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেন। পরে চীন, ভুটান, মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশ ঘুরে পশ্চিমবঙ্গের মালদহে আসেন। সেখান থেকে কৃষ্ণনগর এবং বাংলাদেশের সিলেট হয়ে ঢাকায় পদার্পণ করেন। ঢাকার রায়েরবাজারে কুমার সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনি প্রথম ধর্ম প্রচার করেন। সেখানে পানীয় জলের জন্য তিনি একটি কূপ খনন করেন এবং জাফরাবাদে একটি শিখ ধর্মশালাও নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। তবে সে সবের কোনো চিহ্ন এখন আর নেই।
নবম শিখ গুরু তেগ বাহাদুর সিং ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৬৬৫ সালে পাঞ্জাব থেকে বিহারের পাটনা হয়ে ঢাকা আসেন। ঢাকার বাংলাবাজারে তিনি একটি শিখ ধর্মশালা (সঙ্গত্তোলা মন্দির) স্থাপন করেন এবং সেখানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তেগ বাহাদুর পায়ে হেঁটে বা নৌকায় করে ভক্তদের নিকট চলে যেতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দশম এবং শেষ গুরু গোবিন্দ সিং ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন এবং এখানে কিছুকাল অবস্থান করেন।
শিখ গুরুদের জন্মদিন পালন, নবজাতকের নামকরণ, বিবাহ এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শিখদের প্রধান উৎসব। তবে উল্লেখযোগ্য উৎসব হলো অমৃতপান ও ধর্মীয় খালসার জন্মতিথি পালন। এদুটি উৎসবের মধ্যে ১ বৈশাখ (১৩ এপ্রিল) বৈশাখী দিবস পালন করা হয়। ধর্মযোদ্ধাদের মৃত্যু দিবসও সাড়ম্বরে পালিত হয়। এছাড়া শিখ সম্প্রদায়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও তারা জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করে। শিখদের মরদেহ দাহ করা হয় এবং চিতাভস্ম নিকটস্থ নদী বা খালে বিসর্জন দেওয়া হয়। শিখ পুরুষদের মাথায় থাকে লম্বা চুল, হাতে কড়া বা বালা এবং কৃপাণ। এছাড়া তারা মাথায় বড় পাগড়ি পরে এবং দাড়ি-গোঁফ কাটে না।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অতি মুষ্টিমেয় সংখ্যক হচ্ছে শিখসম্প্রদায়। তারা বিদেশ থেকে এসে সাময়িকভাবে এখানে বসবাস করে। এ কারণে তাদের উপাসনালয়ের ধর্মীয় কর্মকান্ডও অনেকটা নীরবে সম্পন্ন হয়। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে শিখ গুরুরাও বাংলাদেশের মাটিতে স্থায়িভাবে বসবাস করেননি। মুগল ও ব্রিটিশ আমলে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালনের জন্য শিখরা এ এলাকায় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আসত এবং দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে যেত। তাদের স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল তুলনামূলকভাবে প্রখর। তাই এতদঞ্চলের মানুষের সঙ্গে তাদের কোনোরূপ সম্পর্ক বা সখ্য গড়ে ওঠেনি। তাদের ধর্ম, ভাষা ও জীবনধারা এদেশের পরিবেশের অনুরূপ না হওয়ায় তাদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের সম্পর্ক তেমন গভীর হয়নি। [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]
গ্রন্থপঞ্জি জোসেফ ডেভিড কনিংহাম, শিখ-ইতিহাস, দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পা., নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৮৭।