শ্যামাসঙ্গীত
শ্যামাসঙ্গীত হিন্দুদেবী শ্যামা বা শক্তির উদ্দেশে রচিত এক প্রকার ভক্তিগীতি। এর অপর নাম শাক্তগীতি। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের পাশাপাশি শাক্তধর্মের উদ্ভব ঘটে এবং তাকে কেন্দ্র করেই শাক্তগীতি চর্চার একটি ক্ষীণ ধারা প্রচলিত হয়। আঠারো শতকের মধ্যভাগে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন এতে প্রাণ সঞ্চার করে বাংলা গানের জগতে শাক্তপদাবলি বা শ্যামাসঙ্গীত নামে একটি বিশেষ সঙ্গীতধারা প্রতিষ্ঠিত করেন।
রামপ্রসাদের চেষ্টা ছিল শক্তিসাধনাকে নীরস শাস্ত্রাচার ও তান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করে একটি সহজ আবেদনপূর্ণ সাঙ্গীতিক অভিব্যক্তি দান করা। শ্যামা বা কালীমূর্তিকে ঘিরে বীভৎস, কদর্য ও বিকৃত শক্তিসাধনার যে অশোভন সংস্কার সমাজে প্রচলিত ছিল, তা পরিহার করে রামপ্রসাদ মা ও সন্তানের মধ্যে বাৎসল্য ও ভক্তির যে শাশ্বত সম্পর্ক, তারই সাঙ্গীতিক রূপ দেন। বাণী, সুর ও গায়নভঙ্গিতে তিনি শ্যামাসঙ্গীতে এমন একটি ধারার সৃষ্টি করেন যা এক স্বতন্ত্র পরিচিতি লাভ করে এবং তাঁর গানগুলি রামপ্রসাদী গান হিসেবে খ্যাত হয়। ‘এমন মানব জমিন রইল পতিত/ আবাদ করলে ফলত সোনা।’ ইত্যাদি গান আজও বাঙালির মনকে ভক্তিরসার্দ্র করে তোলে।
শ্যামাসঙ্গীতকে তত্ত্বগত দিক থেকে দুটি ধারায় বিভক্ত করা যায়: ভক্তিরসাত্মক বা তত্ত্বমূলক এবং উমাসঙ্গীত, আগমনী বা বিজয়ার গান। প্রথম শ্রেণীর গানগুলি আধ্যাত্মিক ভাবধারায় রচিত এবং গীত হয়। এগুলি বিশেষভাবে শ্যামাসঙ্গীত নামেও পরিচিত। আর গার্হস্থ্য বা সমাজচিত্র অবলম্বনে রচিত পদাবলি উমাসঙ্গীত, আগমনী বা বিজয়ার গান নামে পরিচিত। শ্যামাসঙ্গীতের মৌলিক আবেদন মা ও সন্তানের মধ্যে মান-অভিমান, স্নেহ-বাৎসল্য, প্রেম-ভক্তি ও রূপগত বৈশিষ্ট্যে পরিপুষ্ট। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই শ্যামাসঙ্গীত যুগোত্তীর্ণ হতে পেরেছে। শিল্পকলা হিসেবে শ্যামাসঙ্গীত কাব্যে, রসে ও ভাবের বৈভবে এক রুচিশীল ও মানবিক অনুভূতিপূর্ণ সাঙ্গীতিক অভিব্যক্তি।
আঠারো শতকে বাংলায় রামপ্রসাদ সেন কর্তৃক শ্যামাসঙ্গীত রচনার সময়টা ছিল যুগ পরিবর্তনের এক সন্ধিক্ষণ। তখন দেশের সমাজ ও সংস্কৃতি, বিশেষত সঙ্গীতজগৎ ভোগবিলাসিতার পঙ্কিলতায় নিমগ্ন ছিল। এমতাবস্থায় মাতৃনাম সম্মোধনে আধ্যাত্মিক চেতনাসমৃদ্ধ শ্যামাসঙ্গীত রচনা ছিল বাংলা গানের ধারায় এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তাই নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এ গানের আবেদন ছিল সুবিস্তৃত।
শ্যামাসঙ্গীতে বাৎসল্য ও ভক্তিভাবে মাতৃপূজার যে ধারার সৃষ্টি হয়েছে, পরে তা গণজীবনে স্বদেশভূমির মাতৃবন্দনায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সঙ্গীতে ‘মা’ সম্বোধনের এমন আকুল আবেদন বাংলা গানের আর কোনো ধারাতে পরিলক্ষিত হয় না। তাই শ্যামাসঙ্গীতের অনুকরণে দেশাত্মবোধক গানে মাতৃনামের আহবান জাতীয় চেতনা বিকাশে এক সার্থক প্রয়াস।
শ্যামাসঙ্গীতের সুর রচনায় লোকগীতি ও কীর্তনের প্রভাব রয়েছে। সহজ-সরল বাণী ও সুরের সমন্বয়ে মাতৃ-আরাধনা শ্যামাসঙ্গীতের বিশেষত্ব, যা ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে পরের সময়ের গীতিকবিদের এ গান রচনায় উদ্বুদ্ধ করে। রামপ্রসাদের পরে শ্যামাসঙ্গীত রচনায় খ্যাতি অর্জন করেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। সাধক কবি কমলাকান্ত রামপ্রসাদ সেনের মতো শ্যামাসাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁর রচিত ‘মজিল মন ভ্রমরা, কালীপদ নীল কমলে/ যত বিষয় মধু তুচ্ছ হইল/ কামাদি কুসুম সকলে।’ একটি বিখ্যাত গান। শ্যামাসঙ্গীতের ভাব ও রূপগত শৈলী পরেবর্তীকালে দাশরথী রায়ের পাঁচালি ও রামমোহন রায়ের ব্রহ্মসঙ্গীতের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলে এসে আধুনিক ধারায় স্থিত হয়।
ভক্তিবাদী বাঙালির মানসপটে ভক্তিভাবসম্পন্ন গীতিধারা হিসেবে কীর্তনের পাশাপাশি শ্যামাসঙ্গীতও একটি জনপ্রিয় গীতিধারা। শ্যামাসঙ্গীতের ভক্তিরসপূর্ণ নান্দনিক প্রভাব পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মরমী ও ভক্তিগীতি এবং দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে আজও প্রবহমান। [খান মোঃ সাঈদ]