মহাদেবপুর জমিদারি
মহাদেবপুর জমিদারি মহাদেবপুর নওগাঁ জেলার একটি উপজেলা শহর। স্থানটি নওগাঁ জেলা শহর হতে প্রায় চবিবশ কিলোমিটার পশ্চিমে আত্রাই নদীর তীরে অবস্থিত। মুগল আমলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭) মহাদেবপুর জমিদারির উদ্ভব হয়। নয়নচন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন এ জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর আদি নিবাস ছিল বর্ধমানে।
বলা হয় যে, মুগলদের বাংলা বিজয়ে সহযোগিতা করার জন্য তিনি অথবা তাঁর উত্তরাধিকারী বীরেশ্বর রায় চৌধুরী সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে পুরস্কার স্বরূপ পরগণা জাহাঙ্গীরাবাদের জায়গির লাভ করেন। এ জায়গিরই পরবর্তী সময়ে বিশাল মহাদেবপুর জমিদারিতে পরিণত হয় এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারেই মহাদেবপুরের আরেক নামকরণ হয় জাহাঙ্গীরপুর। নয়নচন্দ্র রায় চৌধুরীর উত্তরাধিকারী বীরেশ্বর রায় চৌধুরী জমিদারি পরিচালনায় বিশেষ প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। জনকল্যাণার্থে তিনি তাঁর জমিদারি এলাকায় বহু মন্দির নির্মাণ ও পুকুর খনন করেন। বীরেশ্বর রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর এ জমিদারি তাঁর চার পুত্র ও পিতৃব্য পুত্র (cousin) লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরীর মধ্যে ভাগাভাগি হয়।
লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ব্রজনাথ রায় চৌধুরী জমিদারির উত্তরাধিকারী হন। ব্রজনাথ রায় চৌধুরী তাঁর জীবদ্দশায় দু’পুত্র দুর্গানাথ রায় চৌধুরী ও গোবিন্দনাথ রায় চৌধুরীর মধ্যে এস্টেট সমানভাগে ভাগ করে দেন। গোবিন্দনাথ একজন প্রভাবশালী, দয়ালু ও শিক্ষিত জমিদার ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র শ্যামনাথ রায় চৌধুরী পরবর্তী জমিদার নিযুক্ত হন। শ্যামনাথ রায় চৌধুরীও একজন প্রজাবৎসল জমিদার ছিলেন। তিনি মহাদেবপুরে একটি বিদ্যালয় ও একটি চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। এ দুটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তিনি প্রতি মাসে নিয়মিত আর্থিক অনুদান প্রদান করতেন। এ ছাড়া তিনি দিনাজপুরে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মোটা অংকের অর্থ এবং ১৮৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে ১৫,০০০ হাজারেরও বেশি টাকা বাংলার বিভিন্ন রিলিফ কমিটিতে দান করেছিলেন। তাছাড়া রাস্তা নির্মাণে জমি প্রদান, বাংলার বিভিন্ন স্কুলে আর্থিক সাহায্য প্রদান (৭,০০০ টাকা), দরিদ্র ব্রাহ্মণদের পুত্র-কন্যাদের বিয়েতে আর্থিক সাহায্য দান ইত্যাদি প্রজাকল্যাণমূলক কাজে তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। ২৪ বছর বয়সে ১৮৭৮ সালে তিনি মারা যান। মহাদেবপুর জমিদার বংশের শেষ জমিদার ছিলেন বড়তরফের ক্ষিতিশচন্দ্র রায় চৌধুরী এবং ছোটতরফের রায়বাহাদুর নারায়ণচন্দ্র রায় চৌধুরী। নারায়ণচন্দ্র রায় চৌধুরী একজন প্রজাবৎসল ও বিদ্যোৎসাহী জমিদার হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯২১ সালে তিনি মহাদেবপুরে মাতা সর্বমঙ্গলাদেবীর নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় (হাইস্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫০ সালে পূর্ব বাংলা জমিদারি উচ্ছেদ আইনে এ জমিদারির বিলুপ্তি ঘটে। ১৯৬৭ সালে মহাদেবপুর রাজবাড়িতে জাহাঙ্গীরপুর কলেজ স্থাপিত হয় যা বর্তমানে সরকারি কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে। [কাজী মোস্তাফিজুর রহমান]