ব্রাহ্মণ
ব্রাহ্মণ হিন্দুদের চতুর্বর্ণের প্রথম বর্ণ। ঋগ্বেদ-এর দশম মন্ডলে নববই সংখ্যক পুরুষসূক্তের বর্ণনা অনুসারে ব্রাহ্মণের জন্ম পুরুষের (স্রষ্টার) মুখ থেকে। মহাভারত-এর শান্তিপর্বে উল্লিখিত হয়েছে যে, ব্রহ্মা প্রথমে সমগ্র জগৎ ব্রাহ্মণময় করেছিলেন, পরে কর্মানুসারে সকলে নানা বর্ণত্ব প্রাপ্ত হয়; কেউ হয় ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ বৈশ্য এবং কেউ বা শূদ্র। মহাভারতে আরও বলা হয়েছে যে, যিনি সদাচারী ও সর্বভূতে মিত্রভাবাপন্ন, যিনি কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ ত্যাগ করেছেন, যিনি সন্তোষকারী, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয় ও শাস্ত্রজ্ঞ, তিনিই ব্রাহ্মণ; অর্থাৎ গুণ ও কর্মানুসারে ব্রাহ্মণাদি চতুর্বর্ণের সৃষ্টি, জন্মানুসারে নয়। পরবর্তীকালে অবশ্য জন্মসূত্রে বর্ণ নির্ধারণ-ব্যবস্থা প্রচলিত হয়।
ব্রাহ্মণদের মধ্যে নানা শ্রেণিভেদ আছে। কারও মতে এই শ্রেণির সংখ্যা দুহাজার। এক সারস্বত ব্রাহ্মণদের মধ্যেই ৪৬৯টি শাখা আছে। শ্রেণি অনুযায়ী ব্রাহ্মণদের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয়। বাংলায় আচার্য বা গণক এবং শাকদীপি ব্রাহ্মণেরা পতিত বলে গণ্য হয়। নিম্নবর্ণের পৌরোহিত্য করে বলে বর্ণ ব্রাহ্মণরাও পতিত। তেমনি অগ্রদানী, ভাট ও পীরালি ব্রাহ্মণরাও সমাজে হীন। বাংলার বাইরে মন্দিরের পূজারী হওয়ায় তামিল ও কর্ণাট ব্রাহ্মণরা সমাজে অপাঙক্তেয়। নাম্বুদ্রী ব্রাহ্মণরা সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।
নৃতাত্ত্বিক বিচারে বাংলার ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ব্রাহ্মণদের মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। তাদের খুব কম সংখ্যকই আর্য বংশোদ্ভূত। তারা চতুর্থ-ষষ্ঠ শতকে বাংলায় আগমন করে এবং ক্রমশ তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তবে পাল আমলে বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া এবং যাগ-যজ্ঞ ভুলে যাওয়ার ফলে তাদের পতিত ও শূদ্রে পরিণত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
সেনযুগে ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। কথিত হয় যে, কর্ণাট থেকে পঞ্চ ব্রাহ্মণ এনে সেন রাজারা যজ্ঞক্রিয়া সম্পন্ন করেন। লক্ষমণসেনের রাজসভায় ‘পঞ্চরত্ন’ নামে পরিচিত পঞ্চ ব্রাহ্মণ সংস্কৃত কবি ছিলেন। সেযুগের কবি-শাস্ত্রকারদের অধিকাংশই ছিলেন ব্রাহ্মণ; রাজপদোপজীবী ব্রাহ্মণ কর্মচারীর সংখ্যাও কম ছিল না। এ সময় সমাজে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়। স্মৃতিশাস্ত্রের বিধি অনুযায়ী ব্রাহ্মণরা সমাজের বিধান দিতে থাকে। বল্লালসেন রাজ্যে কৌলীন্য প্রথা প্রচলন করেন। ব্রাহ্মণদের মধ্যে বন্দ্য (বন্দ্যোপাধ্যায়), চট্ট (চট্টোপাধ্যায়), মুখটী (মুখোপাধ্যায়), ঘোষাল, পুততুন্ড, গাঙ্গুলী (গঙ্গোপাধ্যায়), কাঞ্জীলাল ও কুন্দলাল হচ্ছে মুখ্য কুলীন। আর রাঢ়ী, গুড়, মহিন্ত, কুলভী, চৌতখন্ডী, পিপ্পলাই, গড়গড়ি, ঘণ্টাশ্বরী, কেশরকোণা, দিমসাই, পরিহল, হাড়, পিতমুন্ডী ও দীর্ঘতি গৌণ কুলীন হিসেবে পরিগণিত। কিংবদন্তি অনুযায়ী বল্লালসেনের আমলে কুলীন বলে স্বীকৃত হয় লাহিড়ী, বাগচী, মৈত্র, সান্যাল ও ভাদুড়ী এই পাঁচটি গ্রোত্র।
মধ্যযুগীয় সমাজে ব্রাহ্মণরা সকল বর্ণ বা সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে জল গ্রহণ করত না। তিলি, তাঁতি, মালাকার প্রভৃতি মাত্র নয়টি সম্প্রদায়ের হাত থেকে জলগ্রহণের রীতি চালু ছিল। ধর্মশাস্ত্রে ব্রাহ্মণদের অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে: ১. ব্রাহ্মণ গুরু এবং সকলের কাছে শ্রদ্ধেয় ও প্রণম্য, ২. তারা অপর জাতির কর্তব্য নির্ধারণ করবে, ৩. রাজা সকলের প্রভু কিন্তু ব্রাহ্মণের প্রভু নয়, ৪. বেত্রাঘাত, বন্ধন, অর্থদন্ড, নির্বাসন, বাকদন্ড এবং পরিত্যাগ এই ছয় প্রকারের সাজা ব্রাহ্মণকে দেওয়া যাবে না, ৫. শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণরা করমুক্ত, ৬. তাদের ঘরে গুপ্তধন পাওয়া গেলেও রাজা তার সবটাই গ্রহণ করতে পারবে না, ৭. আগে যাওয়ার জন্য তাকে পথ ছেড়ে দিতে হবে, ৮. অন্য বর্ণের তুলনায় ব্রাহ্মণরা লঘুদন্ড পাবে, ৯. তাকে সাক্ষ্য দিতে ডাকা যাবে না, ১০. তারা মৃতাশৌচ পালন করবে দশদিন, ১১. তারা সুদ গ্রহণ করতে পারবে না, ১২. আপদকালে তারা বৈশ্যদের বৃত্তি গ্রহণ করতে পারবে, প্রভৃতি। পূজার্চনাসহ হিন্দুদের যে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করা ব্রাহ্মণদের একটি সাধারণ পেশা। তবে শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তারা অন্যদের চেয়ে অগ্রগণ্য। [হীরালাল বালা]
আরও দেখুন বর্ণপ্রথা ও অস্পৃশ্যতা।