মন্ত্রী মিশন
মন্ত্রী মিশন ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের লক্ষ্যে গঠিত তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি মিশন। যাঁরা হলেন ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সদস্য-ভারতসচিব পেথিক লরেন্স, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ও এ.ভি আলেকজান্ডার। মন্ত্রী মিশন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য ১৯৪৬ সালের ২৪ মার্চ ভারতে আসেন এবং দু-স্তরবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পনা বিবেচনার্থে উপস্থাপন করেন। পরিকল্পনায় যতটা সম্ভব অধিকতর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন মেনে নিয়ে জাতীয় ঐক্য রক্ষার প্রত্যাশা করা হয়। এতে প্রদেশ ও রাজ্যসমূহকে নিয়ে একটি ফেডারেশন গঠনের কথা বলা হয়, যেখানে কেন্দ্র শুধু প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বিষয়াবলি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে। আর প্রদেশগুলি আলাদাভাবে আঞ্চলিক সঙ্ঘসমূহ (regional unions) গঠন করবে যেগুলির (সঙ্ঘ) নিকট তারা (প্রদেশ) পারস্পরিক সম্মতি দ্বারা কিছু ক্ষমতা অর্পণ করবে। গণপরিষদ নির্বাচনের সময় বিদ্যমান প্রাদেশিক পরিষদসমূহকে তিনটি শাখায় দলবদ্ধ করতে হবে: হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহকে ‘ক’ শাখায়, উত্তরপশ্চিম ও উত্তরপূর্ব (আসামকে অন্তর্ভুক্ত করে) দিকে অবস্থিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদশেসমূহকে যথাক্রমে ‘খ’ ও ‘গ’ শাখায় ফেলতে হবে। এ শাখাসমূহের হাতে মাঝারি পর্যায়ের কার্যনির্বাহী ও আইন পরিষদ প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা থাকবে।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগ উভয়ই এ পরিকল্পনা মেনে নিতে সম্মত হয়। কিন্তু এ দুটি দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে সে বিষয়ে একমত হতে পারেনি। এই অন্তর্বর্তী সরকারই ফেডারেল ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য একটি গণপরিষদ সমবেত করতে আহবান জানাবে। এ দুটি রাজনৈতিক দল পূর্বে মেনে নেওয়া মন্ত্রী মিশনের কর্ম-পরিকল্পনার বিষয়ে ভিন্নরূপ ব্যাখ্যাও উপস্থাপন করে। লীগ চাচ্ছিল যে দলবদ্ধকরণ বাধ্যতামূলক হবে, যেখানে ‘খ’ ও ‘গ’ শাখাদ্বয় বলিষ্ঠ সত্তায় পরিণত হয়ে ভবিষ্যতে অপসৃত হয়ে পাকিস্তানের অংশ হবে। কংগ্রেস যুক্তি দেয় যে, বাধ্যতামূলক দলবদ্ধকরণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। দলবদ্ধকরণ প্রথমে বাধ্যতামূলক থাকবে, কিন্তু শাসনতন্ত্র গঠিত হওয়া এবং তদনুযায়ী নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর প্রদেশসমূহ ইচ্ছা করলে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। মিশনের এ বক্তব্যে কংগ্রেস সন্তষ্ট হয়নি।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে মওলানা আবুল কালাম আজাদ এর স্থলাভিষিক্ত পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ১০ জুলাই তারিখে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, তাঁর দল একমাত্র গণপরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ এবং ‘কোন রকমের দলবদ্ধকরণ থাকবে না।’ লীগ এর প্রত্যুত্তরে ২৯-৩০ জুলাই তারিখে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার ব্যাপারে পূর্বের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় এবং পাকিস্তান অর্জনের উদ্দেশ্যে ১৬ আগস্ট তারিখ থেকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে ‘মুসলমান জাতিকে’ আহবান জানায়। ইতোমধ্যে কেন্দ্রে একটি স্বল্প মেয়াদি কোয়ালিশন/ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে লর্ড ওয়াভেল এর প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। প্রস্তাবিত সরকারে জিন্নাহ্র দাবি ছিল এমন- কংগ্রেসের পাঁচজন হিন্দু, লীগের পাঁচজন মুসলমান, একজন শিখ ও নমঃশূদ্রদের তরফ থেকে একজনের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। কংগ্রেস তা প্রত্যাখান করে। পরিণতিস্বরূপ, ওয়াভেলকে ৪ জুলাই তারিখে শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের সমবায়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হয়। কিন্তু অল্প কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সম্ভাব্য ‘জনতার সংগ্রামের’ ভয়ে ভাইসরয় যে কোন ভাবেই হোক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কংগ্রেসকে নিয়ে আসার যথাসাধ্য চেষ্টা চালানো শুরু করেন; লীগ যদি এর বাইরে থাকে, তবুও। ১৯৪৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর তারিখে নেহরুর নেতৃত্বে, যিনি তখন পর্যন্তও বাধ্যতামূলক দলবদ্ধকরণের বিরোধিতা করছিলেন, কংগ্রেসের-প্রাধান্য বিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করে। কিছুটা দ্বিধার পর মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়, কিন্তু গণপরিষদ বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। অতএব মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় এবং ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলী ১৯৪৮ সালের জুন মাস নাগাদ ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগ করার অভিপ্রায়ের কথা ঘোষণা করেন, যার ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারত বিভক্ত হয়। [মোহাম্মদ শাহ]