মুগিসউদ্দীন তুগরল
মুগিসউদ্দীন তুগরল দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন এর (১২৬৬-১২৮৭ খ্রি) রাজত্বকালে লখনৌতির সহকারী গভর্নর ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাংলার পৃথক অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। কোনরকম সম্ভ্রান্ত বংশ অথবা সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের দাবি তিনি কখনও করেননি, তবে তিনি ছিলেন বাংলার মামলুক শাসকদের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ।
প্রথম জীবনে তিনি একজন তুর্কি দাস ছিলেন। বার বার হাত বদল হতে হতে অবশেষে গিয়াসউদ্দীন বলবন তাঁকে ক্রয় করেন। তুর্কিসুলভ অদম্য ইচ্ছাশক্তি, অফুরন্ত সাহস, অসাধারণ উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও সীমাহীন আকাঙ্ক্ষার দ্বারা তিনি বলবনের মনোযোগ আকর্ষণ ও অনুগ্রহ লাভ করতে সমর্থ হন এবং ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি লাভ করে শেষ পর্যন্ত লখনৌতির গভর্নর আমিন খানের সহকারী নিযুক্ত হন। লখনৌতির বিভিন্ন ঘটনায় স্বীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করার মাধ্যমে খুব তাড়াতাড়ি কার্যত তিনিই সেখানকার শাসকে পরিণত হন।
তুগরল প্রথমেই পূর্ব বাংলার দিকে তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। সেন রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের ওপর কয়েকটি স্থানীয় রাজবংশ সেখানে গড়ে উঠেছিল। সে সময়ে ঢাকা থেকে কয়েক মাইল দক্ষিণে সোনারগাঁওকে রাজধানী করে দনুজ রায় ঢাকা ও বরিশাল জেলার সমন্বয়ে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তুগরল পূর্ব বাংলায় বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন, যদিও তাঁর অভিযানগুলির সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায় না। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে যে, তিনি ঢাকা ও ফরিদপুর অঞ্চল তাঁর কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। পূর্ব বাংলায় স্বীয় কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তুগরল ’কিলা-ই-তুগরল’ নামে একটি শক্তিশালী দুর্গ স্থাপন করেন। এটি সম্ভবত ঢাকা থেকে সোজা ৪০ কি.মি. দক্ষিণে লারিকল (নারকিলা)-এ অবস্থিত ছিল। ধারণা করা হয়, তুগরল তাঁর ব্যক্তিগত ধনরত্ন, পরিবারবর্গ এবং রাজবন্দিদেরকে এই দুর্গে রেখেছিলেন। তিনি পার্শ্ববতী ত্রিপুরা রাজ্যের পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীন শাসক রাজা ফা-এর পরিবর্তে তার ছোট ভাই রত্ন ফা-কে সিংহাসনে বসান এবং এভাবে তিনি সেখানে তাঁর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন। নতুন রাজা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তুগরলকে একটি মূল্যবান রত্ন ও ১০০টি হাতি উপহার দেন। তুগরল বিনিময়ে রত্ন ফাকে ‘মাণিক্য’ উপাধি দেন। তখন থেকে ত্রিপুরা রাজগণ এই উপাধি ধারণ করে আসছেন। এর পর তুগরল দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে নজর দেন এবং জাজনগরে একাধিক অভিযান পরিচালনা করেন। এই সময় আধুনিক পশ্চিম বাংলার বীরভূম, বাঁকুড়া ও হুগলির কিছু অংশ জাজনগরের অংশ ছিল। এর ফলে তাঁর কোষাগারে প্রচুর হাতি ও লুণ্ঠিত ধনরত্ন জমা হয়। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তুগরলের অর্জিত সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ দিল্লিতে পাঠানোর কথা। কিন্তু তিনি তা করেননি এবং এটিই ছিল তাঁর প্রথম বিদ্রোহাত্মক আচরণ।
সে সময়ে বলবন উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে মোঙ্গল আক্রমণের কারণে ব্যস্ত ছিলেন। ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে বলবন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং লখনৌতিতে এই গুজব রটে যে, সুলতানের মৃত্যু হয়েছে। এই সংবাদে ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে তুগরল ’সুলতান মুগিসউদ্দীন তুগরল’ উপাধি গ্রহণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন (মুদ্রা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মনে হয় তাঁর উপাধি ছিল মুইজুদ্দীন তুগরল)। তিনি রাজছত্র ধারণ করেন এবং নিজ নামে মুদ্রাঙ্কণ ও খুৎবা পাঠ করান। রাষ্ট্রের সম্ভ্রান্ত অমাত্য ও নাগরিকবর্গের মাঝে অগাধ ধনরত্ন বিতরণের মাধ্যমে তিনি নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করেন। এরপর তিনি আমিন খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে বন্দি করেন এবং সম্ভবত তাকে হত্যা করেন।
আরোগ্য লাভ করে বলবন শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও সমঝোতার দ্বারা তুগরলকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে সুলতান ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যার গভর্নর আমিন খান আইতগিন এবং ১২৭৮ খ্রিস্টাব্দে মালিক তুরমতির নেতৃত্বে তুগরলের বিরুদ্ধে পরপর দুটি অভিযান প্রেরণ করেন, কিন্তু দুটি অভিযানই ব্যর্থ হয়। রাজকীয় বাহিনীর এই পরাজয় তুগরলকে সাহসী করে তোলে এবং তাঁর ক্ষমতা ও সুখ্যাতি বেড়ে যায়। তুগরল এতই ক্ষমতাবান হন যে, ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যার আমীর সাহাবুদ্দীন বাহাদুরের নেতৃত্বে তৃতীয় অভিযানটিও প্রতিহত করতে সক্ষম হন।
এই অবস্থায় বলবন স্বয়ং অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র বুগরা খানকে সঙ্গে করে দুইলাখ সৈন্য ও নদীবহুল বাংলায় যুদ্ধ চালানোর জন্য একটি শক্তিশালী নৌ-বহর সহকারে পূর্ব দিকে অগ্রসর হন।
বলবনের এই পদক্ষেপে তুগরল তার সঙ্গে যুদ্ধ করা সমীচীন মনে করেননি। তিনি রাজধানীর নিরাপত্তার জন্যও কোন পদক্ষেপ নেননি। বরং তিনি তাঁর সেনাবাহিনী ও ধনসম্পদ সহকারে লখনৌতি ত্যাগ এবং সম্ভ্রান্ত বেসামরিক জনগণকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন। সুলতান বিনা বাধায় লখনৌতি দখল এবং হিসামউদ্দীনকে লখনৌতির দায়িত্বে রেখে পূর্ব বাংলার দিকে তাঁর যাত্রা অব্যহত রাখেন। দক্ষিণ দিকে নদী পথে তুগরলের পলায়ন রোধ করার জন্য তিনি সোনারগাঁয়ের দনুজ রায়ের সাথে একটি চুক্তি করেন।
তুগরল দ্রুত নারকিলা দুর্গ ত্যাগ করে জাজনগর অভিমুখে যাত্রা করেন। তুগরলের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য সুলতান ছোট ছোট দল প্রেরণের নির্দেশ দিয়ে মালিক বেকতাউরস-এর নেতৃত্বে একটি স্বতন্ত্র অশ্বারোহী বাহিনী পাঠান। তুগরলের অবস্থান খুঁজে বের করার জন্য এই বাহিনীকে চতুর্দিকে ছোট ছোট বাহিনী পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। মালিক শের আন্দাজের নেতৃত্বাধীন এরকম একটি ছোটদল একদল ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তুগরলের গোপন আস্তানার সন্ধান পান। এই ব্যবসায়িগণ অল্প সময় পূর্বে তুগরলের সঙ্গে তাদের লেনদেন সমাপ্ত করে ফিরছিল। মালিক শের আন্দাজ তুগরলের শিবিরে আক্রমণ করেন, ফলে তিনি ও তাঁর (তুগরলের) সৈন্যরা হতবাক হয়ে পড়ে। সৈন্যগণ ইতস্তত চতুর্দিকে পলায়ন করতে থাকে। তুগরল নিজেও পলায়ন কালে নিহত হন (১২৮১ খ্রি)। তুগরলকে হত্যাকারী সৈনিকটি তখন থেকে তুগরল-কুশ (তুঘরলের হত্যাকারী) নামে পরিচিত হয়। সুলতানের আদেশে তুগরলের পরিবারের সদস্য ও সঙ্গী-সাথীদের প্রাণদন্ড দেওয়া হয়।
তুগরল ছিলেন একজন সক্ষম ও জনপ্রিয় শাসক। তিনি একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও নৌবহর প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পূর্ববাংলায় সেন শাসনের অবসান ঘটান এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে মুসলিম সাম্রাজ্য অনেকখানি প্রসারিত করেন। তাঁর শাসিত রাজনৈতিক এলাকাটি ’আরসাহ-ই-বাঙ্গালাহ’ নামে পরিচিত ছিল। [এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমদ]