লিন্ডসে, রবার্ট
লিন্ডসে, রবার্ট (১৭৫৪-১৮৩৬) উপনিবেশিক শাসনের প্রথমদিকে সিলেটে নিয়োজিত একজন ইংরেজ কর্মকর্তা, যিনি সেখানে ১৭৭৮ থেকে ১৭৮৭ পর্যন্ত ‘সুপ্রাভাইজর’ (supravisor) এবং ১৭৮৭ থেকে ১৭৯০ পর্যন্ত কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। স্কটল্যান্ডের অধিবাসী বরার্ট লিন্ডসে সিলেটে আসার আগে সেখানে ব্রিটিশ শাসকদের প্রতিনিধি ছিলেন উইলিয়ম ম্যাকপিস থ্যাক্রে। এ সময় দেশে প্রচলিত মুগল আমলের পরগণা ব্যবস্থার বদলে উপনিবেশিক সরকার একটি নতুন ধরনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজ করছিল। ১৭৭৮ সালে সিলেট ছিল ঢাকা প্রদেশের অধীন এবং সেখানকার প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন একজন দীউয়ান। সীমান্ত এলাকার জেলা সিলেটে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে এবং জেলাটিকে পাহাড়িদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে লিন্ডসেকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ কারণে তাঁর উপর বেশ কিছু সামরিক ও বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল, যা স্থানীয় দীউয়ানের কর্তৃত্বকে খর্ব করে তাকে একেবারেই ক্ষমতাহীন করে ফেলেছিল। সরকারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লিন্ডসে সিলেট অঞ্চলে নিজের ব্যক্তিগত কারবারও পরিচালনা করেন। বস্ত্তত ১৭৯৩ পর্যন্ত জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাগণের জন্য নিজেদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে নিয়োজিত রাখতে কোন আইনগত বাধাও ছিল না।
রবার্ট লিন্ডসে মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষ করে চুনাপাথরের ব্যবসার জন্য সিলেটে নিয়োগ পেতে আগ্রহী ছিলেন। সেখানে গিয়ে পরবর্তীতে তিনি হাতি, বেত ও সুপারির কারবারেও জড়িত হয়ে পড়েন। আর শাসক হয়ে ব্যবসাতেও জড়িত থাকায় নিজ স্বার্থেই তিনি জনগণের প্রতি অত্যাচারী হয়ে ওঠেন। তবে ১৮৪০ সালে আত্মজীবনী প্রকাশ করে লিন্ডসে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেন। বইটি থেকে সে সময়ের সিলেট অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার একটি চিত্র পাওয়া যায় এবং কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে সিলেট শহরে ১৭৮২ সালে যে জনবিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল সে সম্পর্কে জানা যায়। এই জনবিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জনৈক পীরজাদা এবং স্থানীয়ভাবে হাদা মিয়া ও মাদা মিয়া নামে পরিচিত সৈয়দ হাদী ও সৈয়দ মাহদী। লিন্ডসে এই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হন এবং পীরজাদাসহ চারজন বিদ্রোহীর মৃত্যু ঘটে।
লিন্ডসের আত্মজীবনীতে সিলেট অঞ্চলের কৃষি ও শিল্প সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। বর্ণনা অনুযায়ী, উপনিবেশিক সরকারের জন্য প্রধান আকর্ষণ ছিল সেখানকার চুনাপাথর, বেত, হাতি, মাছ, কাঠ, সুপারি ও বাঁশ। দূর দূরান্তরের নানা জেলা থেকে মাছ, কাঠ, সুপারি ও বাঁশ সংগ্রহের জন্য সিলেটে ব্যবসায়ীদের সমাগম ঘটত। লিন্ডসের বর্ণনায় সিলেটের বনাঞ্চল ও সেখানে হাতি, গন্ডার, চিতাবাঘ, হরিণ ও বনমোরগের বিচরণের তথ্য পাওয়া যায়। লিন্ডসে হযরত শাহজাজাল (র.)-এর মাযার এবং এর সন্নিহিত এলাকার সামাজিক পরিবেশেরও বর্ণনা দিয়েছেন।
সিলেট থেকে রবার্ট লিন্ডসে প্রভূত পরিমাণ বিত্ত অর্জন করেন এবং তিনি তা স্কটল্যান্ডে ব্যাপক ভূসম্পত্তি ক্রয়ে ব্যবহার করেন। ১৮৩৬ সালে রবার্ট লিন্ডসের মৃত্যু হয়। [দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী]