বিকেন্দ্রীকরণ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:২৮, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

বিকেন্দ্রীকরণ  কেন্দ্রীয় সরকার থেকে প্রশাসনের নিম্ন পর্যায়ে অথবা স্থানীয় পর্যায়ের কর্তৃপক্ষের নিকট  প্রশাসনিক, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব হস্তান্তর। কেন্দ্র থেকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিকেন্দ্রীকরণ উপমহাদেশে ব্রিটিশের আগমনের বহু পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল।

প্রাচীনকাল থেকেই স্থানীয় প্রশাসনের কিছু বৈশিষ্ট্য এবং স্থানীয় প্রশাসনিক পদের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। এসব পদের মধ্যে ছিল বংশানুক্রমে অনুসৃত গ্রাম-প্রধানের পদ যেমন, গ্রামীণ, গ্রামিকা বা গ্রামপাল। গুপ্ত আমলে  গ্রামের প্রশাসন পরিচালনা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার উদ্দেশ্যে গ্রাম পরিষদ গঠন করা হতো। প্রকৃতপক্ষে, গুপ্ত সাম্রাজ্যে লোক প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারের সংগঠিত কাঠামোর অস্তিত্ব ছিল। গ্রাম পরিষদের ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক ইউনিট ছিল ‘বিষয়’ (আধুনিক জেলার অনুরূপ) ও ‘ভুক্তি’ (বিভাগ)। ভুক্তির শাসক ‘উপরিক মহারাজা’ সম্রাট কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন এবং তিনি তাঁর অধীনস্থ জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ‘বিষয়পতি’ নিয়োগ করতেন। এ সকল বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক ইউনিটের দায়িত্ব ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য রাজস্ব সংগ্রহ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন। পাল ও সেন আমলে গুপ্তযুগের স্থানীয় সরকারের ধরন কিছুটা অনুসরণ করা হয়। এছাড়াও এসময় স্থানীয় ইউনিটগুলোর কার্যক্রম প্রসারিত করে নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। তারা লোক প্রশাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং রাজস্ব, পুলিশ, গণপূর্ত, প্রতিরক্ষা, বিচার ও গবাদি পশুপালন প্রভৃতি পৃথক ও বিশেষ বিভাগ সৃষ্টি করে প্রশাসনকে সম্প্রসারিত করেন।

সুলতানি ও মুগল শাসনে মধ্যযুগীয় বাংলায় বিকেন্দ্রীকৃত স্থানীয় শাসনের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। মধ্যযুগীয় মুসলিম শাসকরা দুটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে প্রশাসনিক পদ্ধতির উন্নয়ন সাধন করেন;  প্রথমত রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটানো এবং বিদ্রোহ দমন করে বিজিত এলাকায় নিজেদের শাসন সংহত করা, দ্বিতীয়ত রাজকোষে যত বেশি সম্ভব রাজস্ব সংগ্রহ করা।

১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা ঘটে। বাংলার শাসনব্যবস্থা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ব্রিটিশ উপনিবেশিক স্বার্থ বিকেন্দ্রীকরণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলিম শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। ইংল্যান্ডে সংঘটিত শিল্প বিপ্লবে সহায়তা করার জন্য ব্রিটিশ প্রশাসকগণ বর্ধিত রাজস্ব সংগ্রহে বাংলায় নিজেদের অবস্থান সংহত করেন। এভাবে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ একটি অনুগত জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি করে। নতুন জমিদারি ব্যবস্থার অধীনে বাংলার স্থানীয় গ্রামীণ সংগঠনে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য শক্তিশালী  রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং রাজনৈতিক সমর্থনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্যে উপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষার জন্য বেশকিছু প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি ও আইন প্রবর্তন করা হয়। সেগুলোর মধ্যে ১৮৭০ সালের  চৌকিদারি পঞ্চায়েত অ্যাক্ট, লোকাল সেলফ গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট ১৮৮৫ এবং বেঙ্গল ভিলেজ সেল্ফ গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট ১৯১৯ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল  আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারির পূর্বপর্যন্ত বিকেন্দ্রীকৃত স্থানীয় সরকার কাঠামোতে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায় নি। আইয়ুব সরকার তাঁর শাসনকে বৈধতা দানের অভিপ্রায়ে একটি বেসামরিক ক্ষমতার ভিত্তি তৈরির চেষ্টা করে। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন সংস্কার করা হয়। ১৯৫৯ সালে  মৌলিক গণতন্ত্র নামে একটি চার স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। এ সরকার ব্যবস্থায় চারটি স্তর ছিল  ইউনিয়ন, থানা, জেলা এবং বিভাগীয় কাউন্সিল। বস্ত্তত এটা ছিল পরোক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন। ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও চেয়ারম্যানদের ভোটে দেশের জেলা পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদ, জাতীয় পরিষদ এবং সবশেষে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন। এসকল ভোটার বা মৌলিক গণতন্ত্রী সরকার কর্তৃক ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং এর ফলে এরা নির্ভরযোগ্য ‘ভোট ব্যাংক’-এ পরিণত হয়। অনেক স্থানীয় কাউন্সিলর বা ভোটারদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হয়। এ নীতি আইয়ুব শাসনকে একটি প্রেসিডেন্ট এবং দুটি সংসদীয় নির্বাচন উত্তরণে সহায়তা করে।

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শাসনামলে (১৯৭২-১৯৭৫) স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন ঘটে নি; শুধু ইউনিয়ন পরিষদের নাম ‘পঞ্চায়েত’ এবং থানা পরিষদকে পরিবর্তন করে থানা উন্নয়ন কমিটি করা হয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বহুদলীয় সংসদীয় পদ্ধতির বদলে একদলীয় প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন চালু করা হয় এবং স্থানীয় প্রশাসনের জন্য একটি নতুন রূপরেখা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রতিটি মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত একজন জেলা গভর্নরের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। এ ব্যবস্থাটি বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্যের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।

জেনারেল  জিয়াউর রহমান (১৯৭৬-৮১) তাঁর শাসনের গোড়া থেকেই বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে জিয়ার স্থানীয় সরকার অর্ডিন্যান্স তিন স্তর-বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার পদ্ধতি সৃষ্টি করে। এ স্তরগুলো ছিল ইউনিয়ন, থানা এবং জেলা পরিষদ। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের সঙ্গে এ ব্যবস্থার অনেকটা সাদৃশ্য ছিল। এছাড়া ‘স্ব-নির্ভর গ্রাম সরকার’ নামে একটি নতুন পদ্ধতি ১৯৮০ সালে চালু করা হয়। বাস্তবে এর উদ্দেশ্য ছিল  কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত এ ব্যবস্থার মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের জন্য মূলত একটি রাজনৈতিক সমর্থনের ভিত্তি তৈরি করা।

জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের (১৯৮২-৯১) আমল বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় প্রশাসনের বিবর্তনের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে এরশাদ  প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য ছিল একটি যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করা। এ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সরকার ৪৬০টি থানাকে উপজেলায় উন্নীত করে এবং উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় উন্নয়নের জন্য ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।

বেগম  খালেদা জিয়া (১৯৯১-৯৬) ক্ষমতায় এসে ১৯৯১ সালের নভেম্বর মাসে উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করেন। খালেদা সরকার স্থানীয় সরকার কাঠামো পর্যালোচনা কমিশন গঠন করে এবং এ কমিশন দুই স্তর-বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার অর্থাৎ জেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ গঠনের সুপারিশ করে। এছাড়া থানা উন্নয়ন এবং সমন্বয় কমিটি কর্তৃক থানা পর্যায়ে উন্নয়ন কার্যক্রম সমন্বয় করার পরামর্শ প্রদান করে। এ পরিবর্তনসমূহ অতীতের বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় প্রশাসনিক নীতির তেমন পরিবর্তন ঘটায় নি।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর  শেখ হাসিনা সরকার একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করে। এ কমিশন চার স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার পদ্ধতির সুপারিশ করে। এ স্তরগুলো হলো জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পরিষদ। এছাড়া শহর এলাকায় ১৮২টি পৌরসভা এবং নগরে ৪টি সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার কথাও সুপারিশে বলা হয়। এছাড়াও রয়েছে ‘বিশেষ এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাসমূহের জন্য আলাদা স্থানীয় সরকার কাঠামো। এ অঞ্চলে আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সরকারের স্বাক্ষরিত চুক্তির অধীনে এ আঞ্চলিক পরিষদ বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীকরণের এক বিরল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীকরণের বিবর্তন এবং স্থানীয় সরকার প্রশাসনের ক্ষেত্রে গৃহীত ব্যবস্থার কয়েকটি লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হলো: (ক) কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক এর নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারের উপর নির্ভরশীলতা; (খ) গণপ্রতিনিধিত্বহীন বৈশিষ্ট্য; (গ) স্থানীয় সম্পদের অপর্যাপ্ত ব্যবহার; (ঘ) বিকেন্দ্রীকৃত সংগঠনে গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের সীমিত অংশগ্রহণ; (ঙ) বিকেন্দ্রীকরণের বাস্তবায়নে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর ভাসাভাসা প্রতিশ্রুতি।

বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীকরণ নীতি শুধুমাত্র বিভিন্ন সরকারের রাজনৈতিক সমর্থনের ভিত্তি হিসেবেই ব্যবহূত হয়ে আসছে। বিকেন্দ্রিকরণের উদ্যোগের মধ্যে শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির যথার্থ প্রতিফলন ঘটে নি। ফলে বিভিন্ন বিকেন্দ্রীকরণ পরিকল্পনা ও আদর্শ কাঠামো প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয় সংস্থার সাফল্যের পথে কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায় নি।  [তোফায়েল আহমদ এবং নিয়াজ আহমদ খান]