গাজী, পচাব্দী
গাজী, পচাব্দী (১৯২৪-১৯৯৭) বিখ্যাত বাঘ শিকারী। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার শরা গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী শিকারী পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা মেহের গাজী, পিতামহ ইসমাইল গাজী এবং দুই পিতৃব্যও ছিলেন খ্যাতনামা শিকারী। ১৯৪১ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে খুলনা জেলার পাইকগাছা থানার ‘গোলখালির সন্ত্রাস’ নামে পরিচিত একটি বাঘ হত্যা করার মাধ্যমে পচাব্দী গাজীর শিকারী জীবন শুরু হয়। শিকারের জন্য উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি লাভ করেন পিতার ডাবল বেরেল মাজল-লোডিং বন্দুকটি।
সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় জন্মগ্রহণ করায় বন্যজীবন ছিল পচাব্দী গাজীর জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুধুমাত্র জীবন রক্ষার প্রয়োজনেই তিনি পুরনো আমলের একটি বন্দুক নিয়ে হিংস্র প্রাণীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতেন অসীম সাহস, ধৈর্য্য ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। প্রথম প্রথম তিনি বনবিভাগের রেঞ্জারের সহযোগী হিসেবে শিকার করতেন। পশুশিকারে তাঁর বুদ্ধিমত্তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে তৎকালীন বনকর্মকর্তার উদ্যোগে ১৯৫৫ সালে তিনি বনবিভাগের অধীনে বনপ্রহরীর কাজে যোগদান করেন। এ কাজে যোগদানের পরপরই শুরু হয় দুর্ধর্ষ বাঘের সঙ্গে তাঁর বিচিত্র লড়াইয়ের লোমহর্ষক জীবনের এক নতুন অধ্যায়। সুন্দরবনের বাওয়ালি, মউয়াল, মাঝি ও জেলেদের জীবনরক্ষায় পচাব্দী গাজী অবতীর্ণ হন মুক্তিদাতার ভূমিকায় এবং রক্ষা করেন অজস্র শ্রমিকের প্রাণ। তাঁর এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালে তাঁকে ‘সনদ-ই-খেদমত’ জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করে।
পচাব্দী গাজীর বাঘ শিকার করার কৌশল ছিল অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। বাঘকে বশীভূত করার উদ্দেশ্যে তিনি অলৌকিক পদ্ধতির পরিবর্তে আত্মোদ্ভাবিত বিভিন্ন কৌশল, গভীর ধীশক্তি ও প্রযুক্তির আশ্রয় নিতেন। তিনি পাগমার্ক দেখে বাঘের আকৃতি অনুধাবন করতে পারতেন। তাছাড়া পদচ্ছাপ দেখে পশুর শ্রেণি এবং তার গতিবিধি নির্ণয়েও তিনি দক্ষ ছিলেন। বাঘের গতিবিধি চিহ্নিতকরণে তিনি কখনও দিন-রাত পর্যবেক্ষণে থাকতেন। তিনি নিরস্ত্র অবস্থায়ও হিংস্র প্রাণীদের সঙ্গে লড়েছেন। বাঘিনীর ডাক, গাছ কাটার শব্দ কিংবা পাতা সংগ্রহের শব্দ নকল করে তিনি বাঘকে প্রলুব্ধ করতেন। জঙ্গলে কল পেতে কিংবা ১৫ হাত উঁচু মাচান তৈরি করেও তিনি শিকার করতেন। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্তের পূর্ণিমা-অমাবস্যা হচ্ছে বাঘের প্রজনন সময়। স্থানীয় ভাষায় একে বলে ‘স্যাঁড়াসাঁড়ির কোটাল’। এ সময় পচাব্দী গাজী বাঘিনীর ডাক নকল করে পাগলপ্রায় মিলনোন্মত্ত বাঘকে হত্যা করতেন।
পচাব্দী গাজীর বাঘ শিকারের আরও দুটি পদ্ধতি হলো ‘গাছাল’ ও ‘মাঠাল’। গাছাল হলো গাছে চড়ে শিকার, আর মাঠাল হলো জঙ্গলের ভিতর চলতে চলতে শিকার। মাঠাল পদ্ধতিতে শিকার করে তিনি একটি দো-নলা বন্দুক পুরস্কার পান। সাতক্ষীরা বা বুড়ি গোয়ালিনী ফরেস্ট রেঞ্জে ‘আঠারোবেকি’ এলাকায় ‘টোপ’ পদ্ধতিতে তিনি যে বাঘটি হত্যা করেন সেটি ছিল সুন্দরবনের শিকারের ইতিহাসে দীর্ঘতম বাঘ প্রায় ১২ ফুট দীর্ঘ। এরপর ‘তালপট্টির সন্ত্রাস’ নামে খ্যাত বাঘ শিকার ছিল পচাব্দী গাজীর জীবনের ৫৭তম ও শেষ শিকার। তাঁর পিতা মেহের গাজী ৫০টি বাঘ শিকার করার গৌরব অর্জন করেছিলেন। পুত্র তার চেয়ে সাতটি বেশি মেরে বাঘ শিকারের ইতিহাসে এক কিংবদন্তিতে পরিণত হন। [মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি]