কান্দা

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৯:৩১, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

কান্দা (Levee)  নদীর পাড় বিশেষ, যা নদীর জলপ্রবাহ ও তার প্রণালীকে নির্দিষ্ট খাতে আবদ্ধ রাখে এবং  বন্যা প্রতিরোধ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নদীর তীরে অবক্ষেপনের ফলে সৃষ্ট উঁচু রৈখিক ভূ-প্রকৃতিগুলি কান্দা হিসেবে পরিচিত। এগুলি নদী উপত্যকার সবচাইতে উঁচু অংশ হওয়ায় আপাত বন্যা প্রভাবমুক্ত স্থানসমুহ বসতি,  কৃষি এবং উন্নয়ন কর্মকান্ড (যেমন: বন্দর, রাস্তাঘাট ইত্যাদি)-এর জন্য উপযোগী। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদীর অধিকাংশগুলির পাড়ে নগর ও গ্রামীণ বসতি গড়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঢাকা মহানগরী বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে, নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে, খুলনা শহর ভৈরব নদীর পাড়ে, সিলেট শহর সুরমা নদীর পাড়ে, ময়মনসিংহ শহর পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে, রাজশাহী শহর পদ্মা নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে।

প্রতি বছর স্থানীয় সাধারণ বর্ষায় নদীর নব সৃষ্ট কান্দাগুলি সহজেই প্লাবিত হয়। এগুলি মূলত দেশের বৃহত্তর প্লাবনভূমির অংশবিশেষ যা কৃষিকাজের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে নদীর এ কান্দাসমূহের পৃষ্ঠভাগে মোটা বালির প্রাধান্য থাকে এবং জৈবপদার্থের পরিমাণ খুব কম থাকায় কয়েক বছর পর্যন্ত কৃষিকাজের অনুপযুক্ত থাকে। অবশ্য এসময়ের মধ্যে এখানে বিভিন্ন ধরনের রবি শস্য ও  চীনাবাদাম চাষের চেষ্টা করা হয়। পরবর্তী কয়েক বছরে যদি নতুন করে  বালি সঞ্চিত না হয় এবং পলি সঞ্চয়ন ও উর্বরতা বৃদ্ধির সুযোগ পায়, তবে তা কৃষির জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হতে পারে। যে সকল ফসলে হালকা সেচের প্রয়োজন এবং বালিযুক্ত পলিমাটিতে ভাল জন্মায় সেগুলি চাষের ক্ষেত্রেই কৃষকেরা কান্দাকে ব্যবহার করে থাকে। মধ্য পদ্মা-মেঘনা অববাহিকার কান্দাসমূহ গম, চীনাবাদাম, সরিষা, তরমুজ, শসা, মিষ্টি আলু, কাচামরিচ এবং তিল চাষের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়।

নদীর অপেক্ষাকৃত পুরাতন প্রাকৃতিক পাড় বা প্লাবনভূমির উচ্চতর অংশও সচরাচর কান্দা নামে পরিচিত। যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলে এ ভূমিরূপকে ‘ডাঙ্গা’ নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। চাষাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এ কান্দা বা ডাঙ্গার জমিগুলি (স্থানীয়ভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কান্দিলা জমিও বলা হয়ে থাকে) আদর্শ স্থানীয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ সকল জমিতে বছরে তিন ফসলও ফলানো হয়। কান্দার জমিগুলি সাধারণত গভীর পলি দোঅাঁশ ও পলি কর্দম দোঅাঁশ মৃত্তিকা দ্বারা গঠিত। এ জমি উত্তমরূপে নিষ্কাশিত ও মৃত্তিকা ঝুরঝুরে থাকে এবং যথেষ্ট পরিমাণে আর্দ্রতা ধরে রাখতে সক্ষম। চাষাবাদ ব্যবস্থা ও শস্যের ধরন মৃত্তিকার আর্দ্রতা ও অন্যান্য গুণাগুণ দ্বারা নির্ণীত হয়। সাধারণত অক্টোবর মাসের শেষদিকে অথবা নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে বর্ষার পানি সরে গেলে কান্দার জমিগুলি সবার আগে জেগে ওঠে এবং আলু, সরিষা, মটরশুঁটি,  মাষকলাই, গম ইত্যাদি রোপণের মাধ্যমে রবি শস্যের আবাদ শুরু হয়। রবি শস্যের পর শুরু হয় খরিপ-১ শস্য যেমন, কাউন, চীনা, মিষ্টি আলু, বাদাম, আউশ ধান,  তিসি, সীম, কাচামরিচ প্রভৃতি শস্যের আবাদ। খরিপ-১ এর পর খরিপ-২ এর শস্য হিসেবে কান্দার জমিতে সাধারণত আমন,  পাট অথবা আউশ ধান লাগানো হয়ে থাকে। কান্দাগুলি শুধু উর্বর শস্য আবাদক্ষেত্রই নয়, বসতি গড়ে তোলার জন্যও আদর্শ স্থানীয়। কান্দা বা ডাঙ্গাতে গড়ে ওঠা বসতি এলাকার নামের শেষের অংশ হিসেবেও কান্দা ও ডাঙ্গা শব্দ দুটি ব্যবহূত হয়, যেমন: আলমডাঙ্গা, আলফাডাঙ্গা, বালিয়াডাঙ্গি, চুয়াডাঙ্গা এবং নগরকান্দা, কলমাকান্দা ইত্যাদি।

নদীমাতৃক নিচু প্লাবন এলাকাকে আঞ্চলিকভাবে ‘দহ’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। গাঙ্গেয় মৃতপ্রায় বদ্বীপ এলাকার বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর জেলা ও তার আশপাশের অঞ্চলে এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় এবং স্থানের নামের শেষ অংশ হিসেবে দহ শব্দটি ব্যবহূত হয়; যেমন: পোড়াদহ, শিলাইদহ, ঝিনাইদহ, ঘুঘুদহ ইত্যাদি। ডাঙ্গা এবং দহ উভয়ই কাছাকাছি সংযুক্ত প্লাবনভূমির দুটি ভিন্ন অংশ।

প্লাবনভূমির নিম্মাংশকে অপর একটি স্থানীয় নাম ‘কান্দি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে এবং নিম্মতর উপত্যকায় গড়ে ওঠা বসতিকে নামকরণ করতে মূল নামের অংশ হিসেবে কান্দি নামটি জুড়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। নদীতীর বরাবর গড়ে ওঠা এ ধরনের বসতিকে প্রারম্ভিক পর্যায়ে বসতি স্থাপনকারীরা বিশেষ কোনো একটি নামে আখ্যায়িত করে থাকে, যেমন- নামোকান্দি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বসতি সম্প্রসারিত হতে থাকে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার জল-ভূরূপতাত্ত্বিক (hydro-geomorphological) অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভূমির বিবর্তন সাধিত হয় কিংবা নদীর গতি পরিবর্তনের কারণেও অনেক সময় এলাকার পরিবর্তন ঘটে থাকে। এলাকার বিভিন্ন মাত্রিক পরিবর্তন সাধিত হলেও কান্দির বসতি সেখানেই বহাল থেকে যায়। এভাবে কান্দি নামকরণ থেকে একটি এলাকার বসতির আদি উৎসের পরিচয় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা ও মেঘনা নদীর নিমাঞ্চলে নামের সঙ্গে কান্দি সংযুক্ত বহু  গ্রাম রয়েছে। যদিও নামকরণের ক্ষেত্রে কোনো সাধারণ নিয়ম নেই, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নামকরণের বেলায় স্থানীয় সংস্কৃতিকে বা মূল জনগোষ্ঠীর পেশাকে অনুসরণ করা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়: ঋষিকান্দি, জেলেকান্দি, বেপারীকান্দি প্রভৃতি গ্রামের নাম। এসকল গ্রামে বসতি গড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায়ে নামের অংশ হিসেবে উল্লিখিত পেশার লোকজনের প্রাধান্য থাকলেও পরবর্তী পর্যায়ে হয়ত এদের অনেকেই তাদের মূল পেশা পরিবর্তন করেছে তথাপি গ্রামের নামের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এলাকার প্রভাবশালী কোনো পরিবারের নামানুসারেও কান্দির নামকরণ করা হয়েছে, যেমন: মিয়াকান্দি, ভূঁইয়াকান্দি, মনারকান্দি, খোনকারকান্দি ইত্যাদি। বাংলাদেশে বেশ কিছু উপজেলা রয়েছে যেগুলির নামের শেষে কান্দি যুক্ত রয়েছে; যেমন: বালিয়াকান্দি, দাউদকান্দি, সারিয়াকান্দি প্রভৃতি।  [মোহা. শামসুল আলম]