কাচবালি
কাচবালি (Glass Sand) বিশেষ ধরনের বালি যা কাচ তৈরীতে ব্যবহূত হয়। উচ্চমাত্রার সিলিকা (শতকরা ৯৩ থেকে ৯৯ ভাগেরও অধিক) এবং নিম্নমাত্রায় আয়রন অক্সাইড, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট ও অন্যান্য কোলোরান্ট-এর উপস্থিতির কারণে এ বালি কাচ তৈরীর ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপযোগী। বাংলাদেশে শেরপুর জেলার বালিজুরীতে, হবিগঞ্জ জেলার শাহজীবাজার ও তেলিয়াপাড়ায়, কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় এবং চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার দক্ষিণ জঙ্গল নামক স্থানে ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে এবং ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি গভীরতায় কাচবালির সন্ধান পাওয়া গেছে। দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়া, বড়পুকুরিয়া, দীঘিপাড়া এবং রংপুর জেলার খালাশপীরে ভূগর্ভস্থ কাচবালির সন্ধান পাওয়া গেছে। এ বালিতে প্রায় ৮৮% থেকে ৯০% সিলিকা এবং এর সঙ্গে সামান্য পরিমাণে লৌহ, টিটানিয়াম, কোবাল্ট ও অন্যান্য উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে।
জিওলজিক্যাল সার্ভে অব পাকিস্তান (জি.এস.পি) ১৯৬০ সালে শেরপুর জেলার শ্রীবর্দি উপজেলার বালিজুরী এলাকায় সর্বপ্রথম কাচবালি আবিষ্কার করে। ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে এবং ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দু’দুবার এ এলাকায় বিস্তারিত অনুসন্ধানকার্য চালানো হয়। বিক্ষিপ্তভাবে বিস্তৃত ০.১৫ মিটার থেকে ২.১৩ মিটার পুরুত্ববিশিষ্ট ৩০টি অনিয়মিত স্তর বা লেন্সে এ কাচবালি মজুত রয়েছে। প্রায় ০.৫৯৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত এ মজুতের মোট পরিমাণ ০.৬৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন (৬ লক্ষ ৪০ হাজার টন)। জি.এস.পি ১৯৭০-৭১ সালে হবিগঞ্জ জেলার নোয়াপাড়া এলাকায় অনুসন্ধানকার্য পরিচালনা করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২-৭৩ সালে এবং ১৯৭৪-৭৬ সালে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জরিপকার্য সম্পন্ন করা হয়।
এলাকায় ০.১৫ মিটার থেকে ১.৮০ মিটার পুরু কাচবালির সঞ্চয় রয়েছে যার সর্বমোট পরিমাণ ১.৪০ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং এ সঞ্চয়নের বিস্তৃতি ০.৯৮১১ বর্গ কিলোমিটার। ন্যাশনাল মাইনিং ইনস্টিটিউশন ১৯৬৮ সালে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় অবস্থিত বাতিসা এলাকায় কাচবালির সন্ধান পায়। জি.এস.পি ১৯৬৮-৭০ সালে এ এলাকায় বিস্তারিত জরিপকার্য পরিচালনা করে এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে জি.এস.পি-এর উত্তরসূরী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এ জরিপকার্য অব্যাহত রাখে। এখানে উত্তরে নোয়াপাড়া থেকে দক্ষিণে দত্তেশ্বর নামক স্থান পর্যন্ত ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং পূর্ব-পশ্চিমে ০.৫ থেকে ১.৫ কিলোমিটার প্রশস্ত এলাকা বরাবর পর্বত পাদদেশীয় পলির মধ্যে কাচবালির অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে এবং ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি (০.৫ মিটার থেকে ৩.৫ মিটার গভীরতায়) এ বালি পাওয়া যায়। সর্বমোট ৩৪টি লেন্স বা স্তরে সঞ্চিত এ কাচবালির মোট মজুত ০.২৮৫ মিলিয়ন (২ লক্ষ ৮৫ হাজার) মেট্রিক টন।
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার লালঘাট-লামাকাটায় বাংলাদেশ-ভারত (মেঘালয়) সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় ১৯৯১ সালে ভূমি থেকে ২৩.৭৮ মিটার থেকে ৭২.৯৫ মিটার গভীরতায় কাচবালির সন্ধান পাওয়া গেছে। এ বালি ১.২২ মিটার থেকে ১.৮৩ মিটার পুরুত্ববিশিষ্ট দুটি স্তরে সঞ্চিত রয়েছে। স্তরসমূহের ১৬৪ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মজুতের পরিমাণ ২৫ লক্ষ ৫০ হাজার টন। অপর একটি ভূগর্ভস্থ কাচবালির স্তর ১৯৭৪ সালে মধ্যপাড়ায় আবিষ্কৃত হয়। ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগ থেকে এর গভীরতা ১২৮ মিটার। এ খনির অবস্থান পুরাজীবীয় ভিত্তিস্তরের উপরে। কর্দম স্তরসহ কাচবালির স্তরের পুরুত্ব ৫.২ মিটার থেকে ১৬ মিটার এবং গড় পুরুত্ব ৪ মিটার। প্রায় ১ বর্গ কিমি এলাকাব্যাপী বিস্তৃত এ কাচবালি সঞ্চয়ের পরিমাণ ১৭.২৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ১৯৮৫ সালে বড়পুকুরিয়াতে কয়লার জন্য খননকার্য পরিচালনার সময় ভূ-পৃষ্ঠের ১১৮ মিটার থেকে ১৮০ মিটার গভীরতায় কাচবালির সন্ধান পাওয়া যায়। এ বালিস্তরের গড় পুরুত্ব ২১.৯০ মিটার এবং মজুত এলাকার বিস্তৃতি ১ বর্গ কিমি যাতে পরিমাপকৃত মজুতের পরিমাণ ৯০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এ সকল মজুত ছাড়াও দীঘিপাড়ায় ১৯৯৪ সালে আবিষ্কৃত হয়েছে ভূগর্ভস্থ কাচবালির মজুত। ভূ-পৃষ্ঠের ৬২.১৯ মিটার থেকে ৩২৫.৩০ মিটার গভীরতায় ৫টি স্তরে এ কাচবালি সঞ্চিত রয়েছে। স্তরসমূহের মোট পুরুত্ব ৭৭.১৩ মিটার, তবে মজুতের পরিমাণ এখন পর্যন্ত নির্ণয় করা হয় নি। চৌদ্দগ্রাম-নয়াপাড়া-দত্তেশ্বর এলাকার কাচবালি আহরণ করা হচ্ছে এবং চট্টগ্রামের ওসমানিয়া গ্লাস শীট কারখানায় তা ব্যবহূত হচ্ছে। ভবিষ্যতে রংপুর প্লাটফর্ম এলাকায় কয়লা অথবা কঠিন শিলা উত্তোলনের কাজ শুরু হলে এ এলাকায় আবিষ্কৃত ভূগর্ভস্থ কাচবালির মজুত থেকে কাচবালি আহরণ করারও সম্ভাবনা রয়েছে। [কিউ.এম আরিফুর রহমান]
মানচিত্রের জন্য দেখুন খনিজ সম্পদ।