মুসা খান মসনদ-ই-আলা
মুসা খান মসনদ-ই-আলা ভাটি অঞ্চলের অধিপতি। তিনি ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে পিতা ঈসা খান মসনদ-ই-আলার মৃত্যুর পর সোনারগাঁয়ের মসনদে অধিষ্ঠিত হন। পিতার নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি লাভ করেন এক বিশাল রাজ্য। এ রাজ্য বর্তমান বৃহত্তর ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার প্রায় অর্ধেক, প্রায় গোটা বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং সম্ভবত বৃহত্তর রংপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার অংশবিশেষ জুড়ে বিস্তৃত ছিল। তিনি মুগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁর পিতার অবিরাম প্রতিরোধ ও সংঘর্ষের নীতি অব্যাহত রাখেন এবং ভাটি অঞ্চলে স্বীয় আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য মুগলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সংগ্রাম পরিচালনা করেন।
মুগল আগ্রাসন প্রতিরোধের জন্য ঈসা খান প্রতিবেশী ভূইয়াঁদের (জমিদার) সমন্বয়ে একটি ঐক্যজোট গড়ে তুললেও তাঁর সামরিক শক্তির প্রধান উৎস ছিল বিদ্রোহী আফগান দলপতিদের সমন্বয়ে গঠিত মুগল বিরোধী মৈত্রীজোট। কিন্তু বাংলায় আফগান সংহতির অবক্ষয় ও আফগান শক্তির ক্রমাবনতির নিরীখে মুসা খানকে তাঁর কৌশল পরিবর্তন করতে হয়। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে বাংলার ভূইয়াঁদের সংগঠিত করে একটি ঐক্যজোট গড়ে তোলেন এবং সম্ভবত তাদের মধ্যে সৃষ্টি করেন আঞ্চলিক ঐক্যের অনুভূতি। এই করে তিনি বাংলার শাসকবর্গের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা এবং ঘনিষ্ঠ ঐক্যের সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। মুসা খানের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ ভূইয়াঁরা সাধারণ্যে বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিত হলেও বস্ত্তত ভূইয়াঁদের সংখ্যা ছিল আরও বেশি।
মুসা খানের ছিল শক্তিশালী বিশাল নৌবহর, আর তাঁর মৈত্রীজোটের ভূইয়াঁদের সম্মিলিত নৌবহর নিয়ে তিনি প্রায় এক দশক ব্যাপী নদীমাতৃক ভাটি অঞ্চলে মুগল আগ্রাসন প্রতিহত করেন। মুসা খানের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কেন্দ্রস্থল ছিল বর্তমান ঢাকার দক্ষিণপূর্ব দিকে পদ্মা, শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার সংগমস্থলে সামরিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। খিজিরপুরে মুসা খানের দুর্গটি ছিল দুলাই ও শীতলক্ষ্যার সঙ্গমস্থলের প্রায় কাছাকাছি। এই দুর্গ থেকেই নিয়ন্ত্রিত হতো ঢাকা অভিমুখী একমাত্র জলপথ। খিজিরপুরের বিপরীত দিকে শীতলক্ষ্যার পূর্ব পারে ছিল তাঁর পারিবারিক আবাসস্থল সুরক্ষিত কাত্রাবো নগরী, আর বর্তমান নারায়ণগঞ্জের বিপরীত দিকে শীতলক্ষ্যার পূর্ব পারে ছিল কদম রসুল নামে অপর একটি সুরক্ষিত সামরিক ঘাটি। তাঁর রাজধানী সোনারগাঁও ছিল দেয়াল বেষ্টিত অত্যন্ত সুরক্ষিত নগরী। ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে পদ্মা ধলেশ্বরী ও ইছামতী নদীর সঙ্গমস্থলে যাত্রাপুরে ছিল মুসা খানের অপর একটি দুর্গ ও সামরিক ঘাটি। সামরিক দিক দিয়ে এই যাত্রাপুরের অবস্থান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাত্রাপুর হয়েই ইছামতী নদীপথে ছিল ঢাকা থেকে মুগল সুবাহ বাংলার তখনকার রাজধানী রাজমহল পর্যন্ত বিস্তৃত সচরাচর ব্যবহূত জলপথ।
মুসা খানের শাসনের প্রথম কয়েক বছর তাঁর রাজ্য মুগল আক্রমণ থেকে কতকটা নিরাপদ ছিল। মুসা খান যদিও ১৬০২ খ্রিস্টাব্দ থেকে কুতলু খানের মন্ত্রীর পুত্র ও আফগান দলপতি দাউদের সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্যতার কারণে বিদ্রোহী আফগানদের সহায়তা করে আসছিলেন এবং অপরাপর আফগান দলপতিদের মুগলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করছিলেন, তাঁকে মুগলের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে দেখা যায়নি। বস্ত্তত ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে মুসা খান মুগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁর অব্যাহত যুদ্ধে অবতীর্ণ হননি।
১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের বর্ষাকাল শেষ হতেই মুগল সুবাদার ইসলাম খান গোলন্দাজ বাহিনী ও ২৯৫টি রণতরী সম্বলিত এক নৌবহরসহ বিশাল বাহিনী নিয়ে ভাটি অভিমুখে অভিযান করেন। এ অভিযানের সংবাদ পেয়ে মুসা খান তাঁর মিত্র জমিদারদের নিকট বার্তা পাঠান যেন তারা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে মুগল বাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিহত করেন, এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবিলা করেন।
গৌড় পরগণায় স্থাপিত তাঁর সেনা-ছাউনি থেকে ইসলাম খান ২০০০ অশ্বারোহী ও ৪০০০ পদাতিক সৈন্যের এক বাহিনী শেখ কামালের নেতৃত্বে বীরভূমের জমিদার বীর হামির, পাচেটের জমিদার শামস খান এবং হিজলির জমিদার সলিম খানের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এঁরা সবাই মুগল সেনাপতির নিকট বশ্যতা স্বীকার করেন। ভুষণার জমিদার রাজা ছত্রজিৎ মুগল সেনাপতি ইফতিখার খানের নিকট বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন (১৬০৯ খ্রি)। এ সময় মির্যা মুমিন, দরিয়া খান ও মাধব রায় মুগল অধিকৃত সোনাবাজু পরগণায় সম্মিলিত আক্রমণ পরিচালনা করেন। ইসলাম খান সেনাপতি মির্জা নাথান এর অধীনে সোনাবাজু অভিমুখে এক বাহিনী প্রেরণ করেন। মুগল বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে মুসা খানের সহযোগী জমিদারগণ সোনাবাজুতে তাদের নতুন দুর্গ ত্যাগ করে সোনারগাঁয়ে ফিরে আসেন।
বর্ষাকাল শুরু হতেই স্থানীয় জমিদার রাজা রায় করতোয়া নদীর তীরবর্তী শাহজাদপুরে তুকমাক খানের জায়গির এলাকায় অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তুকমাক খানকে শাহজাদপুর দুর্গে অবরুদ্ধ করেন। তিন দিন পর অবশ্য রাজা রায় অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হন। এ সময় চাঁদপ্রতাপের (মানিকগঞ্জ জেলায়) মুগল জায়গিরদার মিরাক বাহাদুর জালায়ের জমিদারদের এক প্রবল আক্রমণের মোকাবেলা করেন। স্থানীয় জমিদার বিনোদ রায় অপর তিন জমিদার মির্যা মুমিন, দরিয়া খান ও মাধব রায় সহ চাঁদপ্রতাপে সম্মিলিত আক্রমণ পরিচালনা করেন। জমিদারদের লক্ষ্য ছিল চাঁদপ্রতাপ মুক্ত করে ভাটি অভিমুখে মুগল বাহিনীর অগ্রযাত্রায় প্রতিরোধ সৃষ্টি করা। মুসা খানের পক্ষীয় এ জমিদাররা এমন কৌশলে চাঁদপ্রতাপ দুর্গ অবরোধ করেন যে, দুর্গের পতন তখন অনিবার্য হয়ে উঠে। এ সংকটময় অবস্থায় শাহজাদপুরের মুগল জায়গিরদার তুকমাক খান দ্রুত মিরাক বাহাদুরের সাহায্যে অগ্রসর হন। শেষ পর্যন্ত জমিদারগণ অবরোধ তুলে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন।
ইসলাম খান এবার মুসা খানের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর মূল বাহিনী ও নৌবহর নিয়ে শাহজাদপুরের ১৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বোয়ালিয়া (বালিয়া) থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং পদ্মা, ইছামতী ও ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গমস্থলে সম্ভবত জাফরগঞ্জে পৌঁছে পদ্মার তীরে পরিখা নির্মাণ করে অবস্থান নেন। তখন ইসলাম খানের মূল লক্ষ্য ছিল যাত্রাপুরে মুসা খানের দুর্ভেদ্য দুর্গ অধিকার করা। ইসলাম খান জাফরগঞ্জ থেকে তাঁর স্থলবাহিনী নিয়ে যাত্রাপুর অভিমুখে অগ্রসর হন। এ বাহিনী সারাপথে ছোট ছোট দুর্গ তৈরি করে অগ্রসর হতে থাকে, আর এসব দুর্গের ছত্রছায়ায় এবং স্থলবাহিনীর প্রহরায় ইছামতী নদীপথে অগ্রসর হতে থাকে তাদের নৌবহর। যাত্রাপুরে পৌঁছেই মুগল স্থলবাহিনী ও নৌবাহিনী একযোগে যাত্রাপুর দুর্গের উপর আক্রমণ চালায়। মুসা খান এর আগেই তাঁর সুযোগ্য অধিনায়ক মির্যা মুমিন, দরিয়া খান ও মাধব রায়কে যাত্রাপুর দুর্গের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। আর তিনি নিজে তাঁর সহযোগী জমিদারদের নিয়ে ৭০০ রণতরীসহ দ্রুত ইছামতী নদীপথে অগ্রসর হন এবং পদ্মার তীরে শত্রুর পরিখার উপর আক্রমণ চালান।
দিনের যুদ্ধ শেষে মুসা খান তাঁর প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করার লক্ষ্যে যাত্রাপুর থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ইছামতীর তীরবর্তী ডাকচরে একটি নতুন দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এক রাতের মধ্যে তৈরি হয় সুউচ্চ এক দুর্গ। দুর্গের চারপাশ ঘিরে খনন করা হয় গভীর পরিখা, আর পরিখার প্রান্তে চারপাশে বাঁশের খুটি পুঁতে তৈরি করা হয় দুর্ভেদ্য বেষ্টনী। পরদিন এই নতুন দুর্গ থেকে মুসা খান শত্রু বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করেন। শুরুতেই দুর্গ থেকে নিক্ষিপ্ত কামানের গোলা শত্রু বাহিনীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ইসলাম খান তখন তাঁর শিবিরে আহার করছিলেন। কামানের প্রথম গোলায় সুবাদারের খাবার কক্ষের সব তৈজসপত্র ও বাসন-কোসন চুরমার হয়ে যায় এবং তাঁর খাবার টেবিলের জন তিরিশেক খানসামা নিহত হয়। আর কামানের দ্বিতীয় গোলা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয় হাতীর পিঠে আরোহী তাঁর পতাকা বাহককে। অচিরেই মুগল বাহিনী সম্মিলিতভাবে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। গোলন্দাজ বাহিনী নদীর উচু তীর থেকে মুসা খানের নৌবহরের উপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। তাতে মাধব রায়ের এক পুত্র এবং বিনোদ রায়ের এক ভাইসহ বহু নৌসেনা নিহত হয়, বহুসংখ্যক আহত হয়। মুসা খানের কয়েকটি রণতরী কামানের গোলার আঘাতে নদীতে ডুবে যায়। পরদিন দুপক্ষে দীর্ঘক্ষণ তুমুল যুদ্ধ চলে। মুসা খানের বাহিনী মুগল প্রতিরক্ষা-পরিখা দখলের জন্য পুনঃ পুনঃ আক্রমণ পরিচালনা করে এবং এতে করে দুপক্ষে মুখোমুখি যুদ্ধ চলে। শেষ পর্যন্ত মুগল বাহিনী জয়লাভ করে। মুসা খানের বহু সৈন্য নদীতে ডুবে এবং শত্রুর হাতীর পদতলে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করে। শেষ পর্যন্ত মুসা খান তাঁর বাহিনী নিয়ে পশ্চাদপসরণ করে ডাকচর ও যাত্রাপুর দুর্গে অবস্থান নেন।
পুনঃ পুনঃ আক্রমণ সত্ত্বেও যাত্রাপুর দুর্গ অধিকারে ব্যর্থ হয়ে ইসলাম খান এক নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি ডাকচর দুর্গের উপর অনবরত আক্রমণ চালান এবং এ দুর্গ রক্ষায় মুসা খানকে ব্যস্ত রেখে গভীর রাতে যাত্রাপুর দুর্গের উপর আকস্মিক আক্রমণ পরিচালনা করেন। মুগল সৈন্যরা গভীর রাতে তাদের রণতরী ও হাতীতে চড়ে ইছামতী নদী পার হয়ে যাত্রাপুর দুর্গের উপর প্রবল আক্রমণ পরিচালনা করে। কিছুকাল যুদ্ধের পর মুসা খান দুর্গ পরিত্যাগ করেন। মুগলবাহিনী সঙ্গে সঙ্গে যাত্রাপুর দুর্গ দখল করে নেয় (জুন, ১৬১০)।
ইসলাম খান এবার ডাকচর দুর্গ অধিকারের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। কিন্তু এ কাজটি ছিল খুবই দুরুহ। এ দুর্গের তিনদিকে ছিল নিচু জলাভূমি এবং একদিকে নদী। এই প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষার কারণে সরাসরি দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছাও সম্ভব ছিল না। রণতরী নিয়ে দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে মুগল সৈন্যরা রাতে সঙ্গোপনে একটি শুষ্ক মরা খাল পুনঃখনন করে এই খালপথে তাদের নৌবহর নিয়ে ইছামতী নদীতে পৌঁছে। কিন্তু এই করেও দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছার সকল চেষ্টাই তাদের ব্যর্থ হয় এবং এতে বহু সৈন্য হতাহত হয়। দুর্গের বুরুজ থেকে অনবরত কামানের গোলাবর্ষণ চলতে থাকে, আর ওদিকে পদ্মায় মুসা খানের নৌবহর থেকে গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণও সমভাবে অব্যাহত থাকে। এই প্রবল প্রতিরোধের মুখে দুর্গ অভিমুখে শত্রুবাহিনীর অগ্রগতি অসম্ভব হয়ে পড়ে। মুগলরা এবার রাতে গোপনে দুর্গের সন্নিকটে পৌঁছার উদ্যোগ নেয়। তারা দুর্গের পরিখার অপেক্ষাকৃত কম সুরক্ষিত অংশটি বেছে নেয় যেখানে কাদামাটির আস্তর ছিল কম প্রশস্ত। পদাতিক সৈন্যরা তখন দুর্গ থেকে এবং মুসা খানের রণতরী থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণের মধ্যে নিজেদের ঢালের আড়ালে অন্ধকারে অগ্রসর হতে থাকে। ঝুকিপূর্ণ এই প্রচেষ্টায় বহুসংখ্যক মুগল সৈন্য নিহত হয়। এ পরিস্থিতিতে মুগল সৈন্যরা তাদের রণতরী থেকে কিছু সংখ্যক গার্দুনহা (চাকাবিশিষ্ট ওয়াগন) অকুস্থলে নিয়ে আসে। এগুলো সাধারণত রণতরীতে পর পর সাজিয়ে চলমান সেতু তৈরি করার কাজে ব্যবহূত হতো। এরপর তারা এই গার্দুনহাগুলো পর পর সাজিয়ে এর পাশে খড় ও কাদামাটির স্তূপ দিয়ে তৈরি করে কৃত্রিম প্রতিরোধ বেষ্টনী। আর এ বেষ্টনীর আড়ালে রাতের অন্ধকারে তারা পৌঁছে যায় দুর্গ প্রাচীরের কাছাকাছি। এরপর মুগল সৈন্যরা প্রত্যুষের আগেই দুর্গ প্রাকার ভেঙে ডাকচর দুর্গে ঢুকে পড়ে (১৫ জুলাই, ১৬১০)। এক মাসেরও অধিককাল অবরোধের পর ডাকচর দুর্গ মুগল করতলগত হয়। যাত্রাপুর ও ডাকচর দুর্গের পতনের ফলে মুসা খানের অগ্রবর্তী প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এবং তিনি সোনারগাঁয়ে পশ্চাদপসরণ করেন।
এবার ইসলাম খান সরাসরি মুসা খানের রাজধানী সোনারগাঁও আক্রমণের প্রস্ত্ততি নেন। তিনি তাঁর নৌবহর, গোলন্দাজ বাহিনী ও পদাতিক বাহিনীসহ জুলাই মাসের শেষদিকে (১৬১০ খ্রি্র) ঢাকায় পৌছেন। তিনি নতুনভাবে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা তৈরি করেন এবং সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে তাঁর সেনাধ্যক্ষদের নিয়োজিত করেন। শত্রুপক্ষের রণপ্রস্ত্ততির সংবাদ পেয়ে মুসা খানও দ্বিতীয়বার যুদ্ধের জন্য ব্যাপক প্রস্ত্ততি নেন। হাজী শামসুদ্দিন বাগদাদীকে তাঁর রাজধানীর দায়িত্বে নিয়োজিত রেখে তিনি শত্রু বাহিনীর মোকাবিলার জন্য অগ্রসর হন। শীতলক্ষ্যা নদীকে প্রতিরোধের প্রান্তসীমা নির্ধারণ করে তিনি এর পূর্ব তীরে অবস্থান নেন। তিনি নিজে বন্দর খালের মুখে সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নেন। বন্দর খালের দুই তীরে দুটি দুর্গের মধ্যে মুসা খান নিজে মির্যা মুমিনসহ একটি দুর্গের দায়িত্ব নেন এবং অপর দুর্গটির দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয় তাঁর চাচাতো ভাই আলাওল খানকে। তাঁর ভাইদের মধ্যে আব্দুল্লাহ খানকে সুরক্ষিত কদম রসুল দুর্গের এবং দাউদ খানকে কাত্রাবো দুর্গের দায়িত্ব দেয়া হয়। ডেমরায় দুলাই ও শীতলক্ষ্যা নদীর সংগমস্থলে অপর একটি সামরিক ঘাটির দায়িত্ব দেয়া হয় মাহমুদ খানকে, আর বাহাদুর গাজীকে ২০০ রণতরীসহ আরও উত্তরদিকে শীতলক্ষ্যায় তাঁর পৈত্রিক নিবাস চৌরার নিকটে মোতায়েন করা হয়। শ্রীপুর ও বিক্রমপুরে মাত্র কয়েকটি সামরিক ঘাটি সচল রাখা হয়। এ ছাড়া শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বেশিরভাগ সৈন্য মোতায়েন করা হয়। সম্ভবত মুসা খান দুলাই ও শীতলক্ষ্যার সংগমস্থলে শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে অবস্থিত দুর্ভেদ্য খিজিরপুর নগরী স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করেন।
ইসলাম খান তাঁর বাহিনী নিয়ে শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে অবস্থান নেন। তিনি খিজিরপুরকে আরোও দুর্ভেদ্য ও সুরক্ষিত করে তোলেন এবং সেখানে তাঁর নৌবহর ও গোলন্দাজ বাহিনীর ঘাটি স্থাপন করেন। মির্জা নাথান কাত্রাবো নগরীর উপর রাত্রিতে অতর্কিত আক্রমণের মাধ্যমে যুদ্ধের সূচনা করেন (১২ মার্চ, ১৬১১)। গভীর রাতে ১৪০ জন অশ্বারোহী ও ৩০০ সৈন্য ঘোড়ার পিঠে এবং মির্জা নাথান তাঁর বাহিনী নিয়ে হাতীতে চড়ে গোপনে সাঁতরে শীতলক্ষ্যা নদী পার হন এবং দাউদ খানের ঘাটি আক্রমণ করেন। দুই পক্ষে তুমুল মুখোমুখি যুদ্ধের পর দাউদ খান দুর্গ পরিত্যাগ করে তার বাহিনী নিয়ে মুসা খানের সঙ্গে যোগ দেন।
মুগল নৌঅধ্যক্ষ ইহতিমাম খান তার গোটা নৌবহর নিয়ে দুলাই নদী থেকে শীতলক্ষ্যায় এসে কদম রসুল ঘাটির উপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। মির্যা নাথান তার নৌবহর এবং বিপুল সংখ্যক পদাতিক, অশ্বারোহী, বন্দুকধারী ও তীরন্দাজ সৈন্যসহ দ্রুত ইহতিমাম খানের সাহায্যে অগ্রসর হন। এই আকস্মিক আক্রমণ মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে আব্দুল্লাহ খান কদম রসুল দুর্গ ছেড়ে পশ্চাদপসরণ করেন। মির্জা নাথান এ সময় বন্দর খালের মোহনার নিকটে মুসা খানের দুটি দুর্গের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। এই আকস্মিক আক্রমণ মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে মুসা খান দুর্গ পরিত্যাগ করেন। মির্যা মুমিন তার কিছু সংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্যসহ বন্দর খাল অতিক্রম করে মুসা খানের সঙ্গে মিলিত হন। মির্জা নাথান তখন সহজেই খাল অতিক্রম করে আলাউল খানের অধীনস্থ অপর দুর্গটিও অধিকার করেন।
একের পর এক পরাজয়ে মুসা খান এতোটাই বিচলিত হয়ে পড়েন যে, তিনি তাঁর রাজধানীতে অবস্থান করাও তখন নিরাপদ মনে করেননি। তিনি সোনারগাঁও নগর পরিত্যাগ করে ইবরাহিমপুর চরাঞ্চলে পশ্চাদপসরণ করেন। সোনারগাঁও নগরের দায়িত্বে নিয়োজিত হাজী শামসুদ্দিন বাগদাদী পরে ইসলাম খানের নিকট আত্মসমর্পন করেন এবং তাঁর নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে নগরের দায়িত্ব প্রত্যর্পন করেন (মধ্য এপ্রিল, ১৬১১)।
স্বীয় রাজধানী শহরের পতন মুসা খানের প্রতিরোধ ক্ষমতার গোটা ভিত্তিকেই বানচাল করে দেয়। রাজধানীর পতন ছিল বস্ত্তত তাঁর ব্যর্থতার স্মারক। অবশ্য তিনি তাঁর হূত অবস্থান পুনরুদ্ধারের জন্য বেপরোয়া হয়ে কয়েকবারই মুগলের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করেছেন। কিন্তু এসব অভিযানে পুনঃপুনঃ ব্যর্থতা পরিণামে তাঁর আত্মসমর্পনকেই ত্বরাণ্বিত করেছে।
ইবরাহিমপুরে তাঁর আশ্রয়স্থল থেকে মুসা খান মুগল সেনানায়ক শেখ কামালের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনা শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর ভাইদের এবং মৈত্রী জোটের জমিদারদের নিয়ে ইসলাম খানের নিকট আনুগত্য স্বীকার করেন। জাহাঙ্গীরনগরে মুসা খান ও তাঁর পরিবারের লোকজনকে অবাঞ্ছিত বাধ্যবাধকতা এবং কড়া নজরদারিতে রাখা হয়। মুসা খান ও তাঁর মিত্র জমিদারদের নামে মাত্র তাদের জমিদারি জায়গির হিসেবে ফিরিয়ে দেয়া হলেও বস্ত্তত তারা তাদের জমিদারি অধিকার থেকে বঞ্চিত হন এবং মুগল বাহিনীতে ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণে বাধ্য হন। তাদের জমিদারির অধীনস্থ এলাকা দখল করে নেয়া হয়, তাদের সেনাবাহিনী সম্ভবত ভেঙে দেয়া হয়, গোটা নৌবহর বাজেয়াপ্ত করে রাজকীয় নৌবহরের সঙ্গে অতিরিক্ত বহর হিসেবে যুক্ত করা হয়।
মুগল সুবাহদার ইবরাহিম খান ফতেহ জঙ্গ, মুসা খানের নেতৃত্বাধীন বিশিষ্ট জমিদারদের ব্যাপারে সমঝোতা সৌহার্দ্যের নীতি গ্রহণ করেন। তিনি ১৬১৮ খ্রিস্টাব্দে মুসা খান ও অপরাপর জমিদারদের পূর্ণ স্বাধীনতায় বহাল করেন। এরপর থেকে মুসা খান বিশ্বস্ততার সঙ্গে বাংলায় মুগল সরকারের অধীনে কাজ করেন এবং মুগলদের ত্রিপুরা বিজয় এবং কামরুপে রাজা লক্ষ্মীনারায়ণের ভ্রাতুষ্পত্র মধুসূদনের বিদ্রোহ দমনে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন (১৬১৮)।
দীর্ঘকাল কঠিন রোগভোগের পর ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ঢাকায় মুসা খানের মৃত্যু হয়। ঢাকার ’বাগ-ই-মুসা খান’ এ অবস্থিত মুসা খান মসজিদের সন্নিকটে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর শহীদুল্লাহ হল প্রাঙ্গণে) তিনি সমাহিত আছেন। [মুয়ায্যম হুসায়ন খান]
গ্রন্থপঞ্জি Muazzam Hussain Khan, Thousand Years of Sonarganw, Dhaka , 2009.