চৈতন্য চরিতামৃত
চৈতন্য চরিতামৃত কৃষ্ণদাস কবিরাজ কর্তৃক প্রণীত। এটি কৃষ্ণ চৈতন্যের (১৪৭৮-১৫৩৩) প্রতি নিবেদিত চরিত সাহিত্য ধারার চূড়ান্ত প্রামাণ্য রচনা হিসেবে মর্যাদাময় আসনে অধিষ্ঠিত। গ্রন্থটিকে বৈষ্ণব মতবাদের সংক্ষিপ্ত সার বলা হয় যার মধ্যে আছে চৈতন্য জীবনের অনুপুঙ্খ বর্ণনা, বিশেষ করে তাঁর সন্ন্যাস জীবনের বছরগুলি এবং কিভাবে সে জীবন ভক্তির আদর্শ হিসেবে উদাহরণে পরিণত হলো সে বৃত্তান্ত। গ্রন্থটির মূল পাঠ ষড় গোস্বামীদের দ্বারা বিকশিত অধিবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা ও নন্দনতত্ত্বের মৌলিক তত্ত্বীয় অবস্থানের রূপরেখা দান করে এবং ভক্তজনোচিত ধর্মীয় কৃত্যের সারবস্ত্ত ব্যক্ত করে। এটি যেহেতু বিশ্বকোষের মতো, সে কারণে এটি ঐতিহ্যের ধারায় সবচেয়ে পুনর্গঠিত পাঠ এবং অন্যসব রচনার মাপকাঠিতে বলা যায় যে, এটি ধর্মতাত্ত্বিক রচনার যথার্থ মান সৃষ্টি করেছে। এটিই সে গ্রন্থ যার মধ্যে চৈতন্য ভক্তরা সুসঙ্গত ও সুশৃঙ্খল রচনা হিসেবে গোম্বামীদের শাস্ত্রীয় গ্রন্থাদি ও চৈতন্য জীবনীর সম্পর্ক প্রথম অনুধাবন করতে পারল। এটিও তারা বুঝল, কৃষ্ণদাস ছিলেন মুষ্টিমেয় ভক্তদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ যিনি এগুলি ভালোভাবে অধ্যয়ন করেছেন।
বৃন্দাবনে লেখা শুরু করে কৃষ্ণদাস তাঁর জীবনের উপান্তে এ সুবৃহৎ গ্রন্থ সমাপ্ত করেন, যদিও সম্যকভাবে তখনও যেমন এখনও তেমনি এটি বিদ্বুৎ সমাজে বরাবর আলোচিত। গ্রন্থোদ্ধৃতিগুলি জানিয়ে দেয় যে, বইটির রচনাকাল ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দের পরে। কিন্তু প্রচিলত মত অনুযায়ী এর রচনাকাল আরও পরে ১৬০৯ থেকে ১৬১৫-খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। এ তারিখগুলির যে-কোন একটি গ্রন্থটির রচনাকাল মুরারি গুপ্তের সংস্কৃত রচনা কৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃত অর্থাৎ মুরারি গুপ্তের কড়চা (আনুমানিক ১৫৩৩) এবং বৃন্দাবন দাসের বাংলা রচনা চৈতন্য ভাগবত (আনুমানিক ১৫৪০-এর মাঝামাঝি) দিয়ে সূচিত চৈতন্য চরিতাখ্যানগুলির সৃষ্টিশীল রচনা পর্বের অন্তিম পর্যায়ে স্থাপন করে। যদিও আকৃতিতে বিশাল, গ্রন্থটি তখনও জীবিত গোস্বামীদের ও কৃষ্ণদাসের তিনজন প্রশিক্ষিত শিষ্য শ্রীনিবাস, নরোত্তম দাস ও শ্যামানন্দ দ্বারা সতেরো শতকের প্রথম দিকে বাংলা ও উড়িষ্যায় বারবার অনুলিপিকৃত ও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল।
শুধু বইটির আয়তনই নিঃসন্দেহে এর প্রভাব সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে, কারণ এর সাম্প্রতিক সম্পূর্ণ সংস্করণে রয়েছে অসংখ্য ত্রিপদী চরণসহ প্রধানত দ্বিপদী পয়ার মিল বিশিষ্ট আনুমানিক ২৪,০০০ (চবিবশ হাজার) বাংলা চরণ। অধিকন্তু, গ্রন্থটিতে রয়েছে ইতিহাস ও পুরাণ, বিশেষত ভাগবত ও গীতা ইত্যাদি পঁচাত্তরটি সংস্কৃত উৎস থেকে গৃহীত এক হাজারেরও অধিক সংস্কৃত দ্বিপদী শ্লোক এবং ধর্মীয় কৃত্যের বহুসংখ্যক নির্দেশনামা (তন্ত্র), কাব্য, নন্দনতত্ত্ব (রসশাস্ত্র ও নাটক) এবং বেশ কিছু অধিবিদ্যক, ভাষ্যমূলক ও স্তুতিমূলক রচনা (তত্ত্ব, ভাষ্য, স্তোস্ত্র) ইত্যাদি। আকৃতিক দিক থেকে কিঞ্চিদধিক বড় চৈতন্য ভাগবতের তুলনায় এটি দ্বিতীয় বৃহৎ রচনা এবং এর গঠনরীতি চৈতন্য ভাগবতের অনুরূপ।
চৈতন্য ভাগবত-এর মতো চৈতন্য চরিতামৃতও তিনটি খন্ডে বিভক্ত আদি, মধ্য ও অন্ত্য; এবং এগুলির সর্গসংখ্যা যথাক্রমে ১৭, ২৫ ও ২০। কৃষ্ণদাস সুস্পষ্টভাবে চৈতন্য ভাগবত ও তাঁর নিজের রচনার মধ্যে অসংখ্যবার তুলনা করেছেন যাতে মনে হয় যে, অবিকল গঠন রূপ একান্তই ইচ্ছাকৃত। রচনারীতির এ কৌশল পরিশেষে পাঠকদের মনে এ ধারণা দেয় যে, প্রায় সাত অথবা আট দশক আগে চৈতন্য ভাগবত যে কাহিনী শুরু করেছিল চৈতন্য চরিতামৃত কেবল তারই ধারাবাহিকতা। চৈতন্য ভাগবতের কাহিনী যেখানে নবদ্বীপে গৃহী চৈতন্যের জীবনকাহিনী নিয়ে কেন্দ্রীভূত থেকেছে, সেখানে চৈতন্য চরিতামৃত পুরীতে সন্ন্যাস গ্রহণের পরে চৈতন্যের জীবন ও তাঁর তীর্থ ভ্রমণের উপর আলোক সম্পাত করেছে। এসব তুলনাবাচক বিবরণের ফল চৈতন্য চরিতামৃতকে চৈতন্য জীবনী রচনার পরিসমাপ্তি রূপে স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দেয়।
অ-বিরোধ ও সৌহার্দ্যের কৌশল অনুসরণ করে কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রত্যেকটি চলমান আধ্যত্মিক তত্ত্বকে শ্রেয়োতর রূপের অগ্রগতিশীল ও ব্যাপক ক্রমাধিকারে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন (১.১-৪, ২.২০-২১)। যেমন, অংশ বা আংশিক অবতার, কলিযুগের যুগাবতার এবং অন্যসব দৈবী রূপ যথা মন্বন্তর, দশাবতার, ব্যূহ এবং এ রকম আরও। এরূপ নির্বিশেষত্ব সম্ভব ছিল, কারণ চৈতন্য ভাগবতের অনুসরণে কৃষ্ণদাস চৈতন্যকে কেবল ঈশ্বরের সাধারণ এক অবতার হিসেবে নয়, বরং স্বয়ং ভগবান অর্থাৎ পূর্ণ ঈশ্বর রূপে ঘোষণা করেছিলেন। এর অর্থ হলো, চৈতন্য হলেন সে অবতর যা পূর্ববর্তী সব অবতারকে যোগ রূঢ় করে। ভক্তির এ বিস্তৃত রূপ ব্যাখ্যাকে ফলপ্রসূ করতে যে কলাকৌশল ছিল তা হলো চৈতন্যকে পরিবৃত বৈষ্ণব সম্প্রদায় কর্তৃক চৈতন্যকে ভক্তদের প্রতিনিধিত্বকারী চৈতন্য, অদ্বৈত আচার্য, নিত্যানন্দ, গদাধর ও শ্রীবাসকে পক্ষতত্ত্ব রূপে জ্ঞান করা। কিন্তু এ ধর্মতত্ত্বের মহত্তম দিক হলো এ রকম ধারণা যে, স্বয়ং কৃষ্ণই চৈতন্যরূপ নিয়েছেন নিজের মধ্যে রাধাপ্রেম অনুভব করার জন্য, যাকে বলা যেতে পারে, তথাকথিত দ্বৈতাদ্বৈত বা যুগলাবতার। রাধা ও কৃষ্ণ অভিন্ন সত্তায় বিলীন; চিরদিন বিচ্ছিন্ন ও চিরদিন মিলিত। এ দৃষ্টিভঙ্গি ভক্তির স্বরূপ ব্যাখ্যায় রামানন্দ রায়ের বিখ্যাত প্রশ্নোত্তরমূলক আলেখ্যে উন্মোচিত হয়েছে (২.৮), কিন্তু এ তত্ত্ব চৈতন্যের জীবনের শেষাংশে পুরীতে চৈতন্যের অনুলেখক স্বরূপ দামোদরের উপর আরোপিত। এ মহান ধর্মতত্ত্ব চৈতন্যের অবতারত্ব সম্পর্কে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের পরবর্তী সকল ব্যাখ্যায় যথোপযুক্ত মান তৈরি করেছে।
ভক্তি কল্পতরুর রূপকসংগঠনের সাহয্যে আদি লীলার সর্গগুলি চৈতন্যের পরিচয় ও বংশধারা (১. ১-৪, ১-১০), তাঁর ঘনিষ্ঠতম পরিকরেরা এবং তাদের পরম্পরা যেমন নিত্যানন্দ (১.৫ ; ১.১১), অদ্বৈত আচার্য (১.৬ ; ১.১২), গদাধর (১.৭ ; ১.১২) এবং অন্যান্য ভক্তের (১.৮-৯) প্রতি নিবেদিত। এ খন্ডে গৃহত্যাগ করে চৈতন্যের সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ পর্যন্ত কাহিনী সংক্ষিপ্ত বর্ণনার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে (১. ১৩-১৭)। এটি চৈতন্যভাগবতের বিষয়বস্ত্তর কার্যকর রোমন্থন।
মধ্য লীলায় রয়েছে চৈতন্যের সন্ন্যাস গ্রহণের বিশদ বিবরণ (২. ১-৩), মাধবেন্দ্র পুরীর আখ্যান (২. ৪-৫), চৈতন্য কর্তৃক পন্ডিত সার্বভৌম-এর ধর্মান্তরণ (২.৬), দক্ষিণে চৈতন্যের তীর্থভ্রমণ (২. ৭-১০)। মধ্য লীলার মধ্য-অংশে পাওয়া যায় জগন্নাথের রথযাত্রা ও অন্যান্য উৎসবের কালে চৈতন্য ও তাঁর ভক্তদের প্রাত্যহিক ও বাৎসরিক কর্মকান্ড। মধ্য লীলার শেষাংশে আছে রূপ ও সনাতনের সঙ্গে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারের বিশদ বর্ণনা (২. ১৭-২৫), যার মধ্যে রয়েছে পার্থিব ভক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ষড় গোস্বামীদের দ্বারা বিকশিত ধর্মতত্ত্ব ও নান্দনিক তত্ত্বের অবস্থান।
অন্ত্যলীলা ভক্তিরস সৃষ্টির বাহন হিসেবে রূপ গোস্বামী প্রণীত নাটকগুলির জরিপ দিয়ে শুরু হয়েছে। চৈতন্যের জীবনের অন্তিম পর্বে অসংখ্য ভক্তের ও কখনও কখনও ভাষ্যকারের কর্মাবলি এবং চৈতন্যের সঙ্গে তাঁদের পারস্পরিক ভাব বিনিময় বিশেষত হরিদাস, রঘুনাথ দাস ও জগদানন্দের তাৎপর্যপূর্ণ কাহিনী গল্পকাহিনী আকারে পরিবেশিত হয়েছে। বিরহ অর্থাৎ কৃষ্ণ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার আকুল উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ার পরে রয়েছে চৈতন্য জীবনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ। খন্ডটি সমাপ্ত হয়েছে চৈতন্যের নামে আরোপিত বিখ্যাত ‘শিক্ষাষ্টক’ অর্থাৎ আটটি শ্লোকে ব্যক্ত চৈতন্যের নির্দেশ দিয়ে।
চৈতন্য চরিতামৃতের পান্ডুলিপিগুলি একই রকমের এবং মুদ্রিত সংস্করণে অতি সামান্য হেরফের হয়েছে। একইভাবে এটি ষোল শতকে জীবনী রচনায় গুরু-পরম্পরার আদর্শ তৈরীতে তাৎপর্য সৃষ্টি করেছে। আর টীকাভাষ্য দিয়ে পুথির মুদ্রণে উনিশ ও বিশ শতকের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করেছে। এটি এমনই রীতি যা আজ পর্যন্ত অনুসৃত হয়ে চলেছে এবং একটি বৃহত্তর গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন দলকে একাত্ম করার ব্যবস্থা করেছে। [টনি কে. স্টুয়ার্ট]
গ্রন্থপঞ্জি Bhaktikevala Audulomi Maharaja (ed), Chaitanya Charitamrta of Krsnadasa Kaviraja, 5th edn, Calcutta, 1364 BS; Radhagovinda Natha (ed), Chaitanya Charitamrta of Krsnadasa Kaviraja, 6 vols, Calcutta, 1369-70 BS; Bimanbihari Majumdara, Sri Chaitanyacharitera upadana, Calcutta, 1959; Tony K Stewart (ed & tr), Chaitanya Caritamrta of Krsnadasa Kaviraja, Harvard Oriental Series no. 56, Cambridge, MA, 1999.