পুথি
পুথি হস্তলিখিত প্রাচীন গ্রন্থ। মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে সবকিছুই হাতে লেখা হতো। তখন কোনো গ্রন্থ রচিত হওয়ার পর গুরুত্ব ও চাহিদা অনুযায়ী তার একাধিক অনুলিপি করা হতো।
পুথিকে বর্তমানে ‘পান্ডুলিপি’ (manuscript)-ও বলা হয়। যে উপাদানে পুথি লেখা হতো তার বর্ণ হতো সাধারণত পান্ডু বা ধূসর। তাই হয়তো এর নাম হয়েছে পান্ডুলিপি। এখন অবশ্য মুদ্রণের পূর্বে যেকোনো রচনার খসড়াকেই পান্ডুলিপি বলে।
কাগজ আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে পুথি-লেখার লেখপত্র হিসেবে ব্যবহূত হতো চামড়া, ভূর্জপত্র, তেরেটপত্র, গাছের বাকল, কলাপাতা, তালপাতা ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান। এগুলিকে জলে ভিজিয়ে, সেদ্ধ করে এবং রোদে শুকিয়ে লেখার উপযোগী করা হতো। ফলে এর বর্ণ হতো পান্ডু বা ধূসর এবং এতে সহজে পোকা লাগত না।
পুথি লেখার এসব প্রাকৃতিক উপাদানের দুষ্প্রাপ্যতা এবং নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে এক সময় আবিষ্কৃত হয় তুলট কাগজ। শন, তুলা, তিসির তন্তু, ছেঁড়া কাপড় ইত্যাদি দিয়ে তুলট কাগজ তৈরি করা হতো। এগুলি আকারে হতো বড় এবং তা থেকে প্রয়োজনীয় আকারের পত্র তৈরি করে নেওয়া হতো। গ্রন্থের বিষয়বস্ত্ত বড় হলে পত্রের আকার হতো বড়, আর ছোট হলে ছোট।
তুলট কাগজ তৈরি করার সময় মন্ডের সঙ্গে চুন, নীল বা হলুদের গুঁড়ো মেশানো হতো। এর ফলে কাগজ পোকায় কম কাটত। তবে চুন মেশালে কাগজের স্থায়িত্ব কমে যেত। নীল মেশালে কাগজের রং হতো নীল এবং হলুদ মেশালে হতো পান্ডু বা ধূসর বর্ণ। বাঁশের কঞ্চি, পাখির পালক, শজারুর কাঁটা, নল জাতীয় ঘাসের ডগা ইত্যাদি দিয়ে কলম তৈরি করা হতো। শিমুলের ছাল, লোধ্র, লাক্ষা, জবার কুঁড়ি, কাচা গাব, , আমলকী, জাটির রস, ডালিমের কস, কাঠ-কয়লার গুঁড়ো, ভুসা কালি, পোড়া চালের গুঁড়ো ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হতো কালি। কালির সঙ্গে অনেক সময় লোহার গুঁড়ো মেশানো হতো। এতে কালির ঔজ্জতল্য বৃদ্ধি পেত; তবে এর একটা অসুবিধা ছিল এই যে, লোহায় মরচে পড়ে অল্পদিনেই লেখপত্র নষ্ট হয়ে যেত। অনেক সময় কোনো কোনো বৃক্ষ-লতার পাকা ফল বা বীজ থেকেও লাল রঙের এক ধরনের কালি তৈরি করা হতো। পুথির পত্রসমূহ মাঝখানে ছিদ্র করে সুতা দিয়ে বেঁধে ওপরে-নিচে কাঠের তক্তা দিয়ে আটকে রাখা হতো। এই কাঠের তক্তা এবং পুথির পত্রে অনেক সময় নানা ধরনের চিত্র অঙ্কিত হতো।
অখন্ড বঙ্গ এবং বর্তমান বাংলাদেশে যে পুথিগুলি পাওয়া গেছে সেগুলির প্রায় সবই প্রাচীন বাংলা লিপিতে লিখিত, তবে ভাষা ও বাংলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, বাংলা একাডেমী সংগ্রহশালা, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, রামমালা গ্রন্থাগার (কুমিল্লা), মহারাজা লাইব্রেরি (দিনাজপুর), দীনবন্ধু লাইব্রেরি (সিলেট), বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামসহ (রাজশাহী) দেশের অন্যান্য গ্রন্থাগার এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহে ন্যূনপক্ষে ষাট হাজার পুথি সংগৃহীত আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পুথিটি গাছের বাকলে লিখিত সারদাতিলক (১৪৩৯ খ্রি)।
সেকালে পুথি লিপি করার জন্য এক শ্রেণীর পেশাজীবী লোক ছিলেন, যাঁদের বলা হতো লিপিকর। তাঁরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পুথি নকল করতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের পদবি হতো ‘শর্মা’, তবে অন্যান্য পদবিও ছিল। লিপিকরদের কেউ কেউ পুথির শেষে শ্লোকাকারে সংক্ষিপ্ত আত্মপরিচয় ও পুথির লিপিকাল লিখে রাখতেন। যেমন, কৌতুকরত্নাকর নামক একটি সংস্কৃত নাটকের পুথির লিপিকর রামলোচন শর্মা আত্মপরিচয় দিয়ে লিখেছেন: ‘ইতি রত্নাকরং পুস্তং রামলোচনশর্মণা। লিখিতং বহুযত্নেন বর্ণাশুদ্ধং ত্যজেদ্বুধঃ\ (ঢা.বি- ১৮২১) [অর্থ: রামলোচন শর্মা কর্তৃক বহু যত্নে এই রত্নাকর (কৌতুকরত্নাকর) নামক পুস্তকটি লেখা হলো; পন্ডিতগণ এর বর্ণাশুদ্ধি পরিহার করবেন।] অনুরূপ বাংলা পুথির একটি নমুনা: ‘আবদুল্লার পুত্র আমি সবা হন্তে হীন। হাওলা গেরাম জান উদ্দেশিয়া চিন\ ... যেই মতো দেখি আমি সেই মতো লেখি। অপরাধ ক্ষেম মোর গুণিগণে দেখি\ বিংশ আষ্ট মঘী জান আর বারশত। তারিখ আষাঢ় জান বার দিন হৈল। সেইদিন এই পুস্তক লেখা হৈল\ ’ (ঢা.বি- ৬২৪)
লিপিকরদের ক্ষেত্রে সুন্দর ও নির্ভুল হস্তলিখন ছিল কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা; সেই সঙ্গে ভাষাজ্ঞানও অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হতো। মূলের নকল করা লিপিকরদের প্রধান কর্তব্য হলেও কেউ কেউ পুথিতে নতুন সংযোজনও করতেন, যে কারণে একই গ্রন্থের ভিন্ন ভিন্ন পুথিতে পাঠান্তরের সৃষ্টি হতো। পুথি যাতে কেউ চুরি না করে সেজন্য কোনো কোনো লিপিকর শেষপত্রে অনেক কটূক্তি বা অভিশম্পাত বাক্য লিখে রাখতেন। যেমন: ‘যত্নেন লিখিতং গ্রন্থং যশ্চোরয়তি মানবঃ। মাতা চ শূকরী তস্য পিতা গর্দভঃ\ ’ [অর্থ: অতিশয় যত্নে এই গ্রন্থ লিখিত হলো; যে এটি চুরি করবে তার মা শূকরী এবং পিতা গর্দভ।]
পুথি কীভাবে রক্ষা করতে হয় সে সম্পর্কেও শেষপত্রে নানা উপদেশ-বাক্য লেখা থাকত। যথা: ‘যস্য হস্তগতং ভুয়াদেত্তস্মৈ নিবেদয়ে। প্রাণতুল্যমিদং বক্ষ্যং পন্ডিতস্যৈব পুস্তকম্\ ’ [অর্থ: এই পুস্তক যার হস্তগত হবে তার উদ্দেশে বলছি, পুস্তক প্রাণতুল্য এ কথা পন্ডিতের।]; ‘পুথিকে পুত্রের ন্যায় পালবে, শত্রুর ন্যায় বাঁধবে।’ ইত্যাদি।
সেকালে পুথির রচনাকাল বা লিপিকাল সরাসরি গাণিতিক সংখ্যায় না লিখে প্রায়শই কতগুলি সংখ্যাবাচক শব্দের মাধ্যমে শ্লোকাকারে লেখা হতো। যেমন সংস্কৃত পুথি: ‘হরিপদমধুধারাং বেদযুগ্মাব্ধিচন্দ্রে। মিলিতগণিতশাকে পূর্ণতাং যাতি পীত্বা\ ’ (ঢা.বি- ২৩৬০)। এখানে বেদ = ৪, যুগ্ম = ২, অব্ধি (সমুদ্র) = ৭ এবং চন্দ্র = ১; অতএব সনটি ১৭২৪ শকাব্দ বা ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ। বাংলা পুথি: ‘মুনি রস বেদ শশী শকে রহে সন। শেখ ফয়জুল্লা ভনে ভাবি দেখ মন\ ’ (ঢা.বি- ৪২৪)। এখানে মুনি = ৭, রস = ৬, বেদ = ৪, শশী = ১; অতএব সনটি ১৪৬৭ শকাব্দ বা ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ। এভাবে সংখ্যাবাচক শব্দের মাধ্যমে কাল নির্ণয়ের পদ্ধতিকে হেঁয়ালিও বলা হয়।
পুথির যে অংশে এভাবে লেখক বা লিপিকরের আত্মবিবরণী, পুথির নাম, রচনাকাল/লিপিকাল, কার নির্দেশে এবং কার প্রয়োজনে পুথিটি রচিত/লিপিকৃত হয়েছে এসব তথ্য লিপিবদ্ধ হতো তাকে বলা হয় পুষ্পিকা। পুষ্পিকা সাধারণত পুথির প্রথম পত্রে, অধ্যায় বা অঙ্কশেষে এবং শেষ পত্রে থাকে। প্রথম পত্র এবং অধ্যায় বা অঙ্কশেষের পুষ্পিকায় থাকে সাধারণত লেখকের নাম-পরিচয় এবং গ্রন্থের নাম; আর শেষপত্রের পুষ্পিকায় থাকে লেখক, লিপিকর ও গ্রন্থের নাম এবং রচনাকাল/লিপিকাল। বাংলা পুথিতে ‘ভণিতা’ নামে একটি বিষয় আছে, যা পুষ্পিকারই নামান্তর। এখানেও গ্রন্থনাম এবং লেখকের নাম পাওয়া যায়। যথা: ‘মহাভারতের কথা অমৃতসমান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান\ ’
সেকালে সংস্কৃত ও বাংলা উভয় ভাষার পুথিই লিপিকরদের মাধ্যমে লিপিকৃত হয়ে শিক্ষার্থী এবং সাধারণ পাঠকের হাতে পৌঁছে যেত। আঠার শতকে মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে এই পেশার বিলুপ্তি ঘটে। হস্তলিখিত সেই প্রাচীন পুথিগুলি ক্রমশ সম্পাদিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতে থাকে। যেগুলি এখন পর্যন্ত গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি, সেগুলিকে সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ মাইক্রোফিল্ম করে বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে এই ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে এবং দেশি-বিদেশি গবেষকরা এসব পুথি নিয়ে গবেষণা করছেন। [দুলাল ভৌমিক]
আরও দেখুন পাল চিত্রকলা; বৌদ্ধ চিত্রালঙ্কৃত পান্ডুলিপি।