আসাম অববাহিকা
আসাম অববাহিকা (Assam Basin) আসাম অঞ্চলে অবস্থিত অববাহিকা যাহা ভারতের দুটি প্রধান পেট্রোলীয় অববাহিকার মধ্যে একটি। অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী আসাম অববাহিকার গঠন পাহাড়, পর্বত ও অধিত্যকা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পূর্ব হিমালয়ের প্রধান সীমান্ত সংঘটনের উত্তরাঞ্চলীয় সীমানা আর শিলং মালভূমি ও মিশমি পাহাড় দক্ষিণ সীমান্ত নির্ধারণ করেছে। এর পূর্ব দিকে মিকির পাহাড় ও মিজো পাহাড় আর পশ্চিমে এটি ভারতীয় গাঙ্গেয় সমভূমি কর্তৃক অধিকৃত অব-হিমালয় পুরঃখাতে (Sub-Himalayan Foredeep) উন্মুক্ত।
অববাহিকাটি ব্রহ্মপুত্র নদীপ্রণালী দ্বারা সঞ্চয়কৃত পলল দ্বারা পূর্ণ একটি বিস্তীর্ণ পলিভূমি। উচ্চ আসামে ব্রহ্মপুত্র নদ, শিলং মালভূমির উত্তরে পশ্চিমমুখী বাঁক নেওয়ার পূর্বে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, পরে ধুবরির কাছে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে অবশেষে গোয়ালন্দের কাছে গঙ্গা নদীর সঙ্গে এসে মিশেছে। অববাহিকাটির অভ্যন্তরে ও আশেপাশে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ থেকে বোঝা যায় যে, চতুর্দিকের স্থলভাগ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নদীর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৮৯৭ ও ১৯৫০ সালের দুটি ভয়াবহ ভূমিকম্প অববাহিকীয় প্রকৃতিকে প্রভাবিত করেছে। ভূমির বড় ধরনের কম্পন ১৯৫০ সালে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথই শুধু বদলায় নি, উপরিভাগের ভূমিরূপে পরিবর্তন এনেছে এবং নদীর প্রশস্ততা আড়াই কিলোমিটার থেকে ১০ কিলোমিটারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘন ঘন বন্যা সংঘটিত হচ্ছে। ভূ-প্রাকৃতিক সমীক্ষা থেকে এটা পরিষ্কার যে, নাগা পাহাড় ও অরুণাচল প্রদেশে হিমালয়ের সংকোচনের ফলে আসাম অববাহিকা নদীর প্রচরণ (migration) নাগা পাহাড়ের উত্থানের কারণেই ঘটেছে। আর নদী-উপত্যকার সংকীর্ণ হওয়ার বিষয়টি শিলং অধিত্যকার উত্তরাঞ্চলে সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান, বিশেষ করে মিকির পাহাড় ও ইটানগর পর্বতমালার মধ্যবর্তী অংশে। এখানে সিওয়ালিক পাদদেশীয় পাহাড়সমূহ নদী অধিত্যকায় এ প্রচরণের ছবিটি খুবই স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। নদীর উপর দিয়ে ভূ-পৃষ্ঠে উত্থিত প্রাক-ক্যাম্ব্রীয় শিলাসমূহ ভুটান পাদদেশীয় পাহাড়ের মাত্র ৩৫ কিমি দক্ষিণে।
আসাম অববাহিকা প্রাক-ক্যামব্রীয় আগ্নেয় ও রূপান্তরজ বুনিয়াদের উপর প্রায় ৫ কিমি পুরু মৃন্ময় টারশিয়ারী অবক্ষেপে পূর্ণ। অবক্ষেপের এ পুরুত্ব উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশে ৭ কিমি ঊর্ধ্বে হতে পারে। কারণ এ স্থানে উচ্চ প্যালিওজোয়িক ও মেসোজোয়িক স্তর থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, যদিও এর চূড়ান্ত প্রমাণ এখনও পাওয়া যায় নি।
একটি বৃহৎ অসঙ্গতি (unconformity) টারশিয়ারী স্তরক্রমকে নাগা ও ব্রহ্মপুত্র এ দুটি সুপার গ্রুপে বিভক্ত করেছে। জৈন্তিয়া গ্রুপ ও বড়াইল গ্রুপ নিয়ে গঠিত প্যালিওজিন কালের অগভীর সামুদ্রিক ও উপকূলীয় অবক্ষেপ নাগা সুপার গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। এ গ্রুপে রয়েছে টিওক স্তরসমষ্টি, সিলেট চুনাপাথর (মধ্য ইয়োসিন) ও কপিলি স্তরসমষ্টি (উচ্চ ইয়োসিন)। বড়াইল গ্রুপে রয়েছে নওগাঁ সোপান ও রুদ্রসাগর স্তরসমষ্টি। ব্রহ্মপুত্র সুপার গ্রুপের প্রবাহজ ও বদ্বীপীয় নিওজিন অবক্ষেপসমূহ সুরমা গ্রুপ (নিম্ন মায়োসিন), তিপাম গ্রুপ (মধ্য মায়োসিন) ও মোরান গ্রুপ নিয়ে গঠিত। গেলেকি বেলেপাথর (Geleki Sandstone) সুরমা গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। টিপাম গ্রুপে রয়েছে তিনটি স্তরসমষ্টি- লাকওয়া বেলেপাথর, গিরুজান কর্দম ও নাজিরা বেলেপাথর। মোরাম গ্রুপের রয়েছে দুটি স্তরসমষ্টি- নামসাং ও ডেকিয়াজুলি। গেলেকি বেলেপাথরকে সুরমা উপত্যকায় নমুনা অঞ্চলের সুরমা সিরিজের সমতুল্য মনে করা হয়।
অববাহিকা জুড়ে ভূ-অবনমনের কারণে আসাম অববাহিকা ধীরে ধীরে প্যালিওসিন সাগর দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায় যার ফলে টিওক স্তরসমষ্টি ও পরবর্তী সময়ে অনুক্রমিকভাবে মধ্য ও উচ্চ ইয়োসিন যুগের সিলেট চুনাপাথরের অঙ্গারী শিলা (৯০-২৭০ মিটার) ও কপিলি কর্দম শিলা (৩৫০-৪৬০ মিটার) গঠিত হয়েছে। ওলিগোসিন যুগের সূচনালগ্নে অববাহিকা জুড়ে ইতিবাচক বিচলনের কারণে আরাকান-চীন পর্বতমালার উত্থানের দ্বারা আসাম অববাহিকা বার্মা অববাহিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নওগাঁ বেলেপাথর (১৮০-৬৭০ মিটার) লবণাক্ত পরিবেশে উপলেপিত হয়েছিল এবং রুদ্রসাগর স্তরসমষ্টি (৩০-৫২০ মিটার) যা কর্দম শিলা ও কয়লা দ্বারা গঠিত তা অবক্ষেপের লবণাক্ত উপহ্রদীয় পরিবেশে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। ওলিগোসিন যুগের শেষে সমুদ্রের পূর্ণ প্রত্যাহার শুরু হয় যা ব্যাপক ভূমিধসর ও সুস্পষ্ট অসঙ্গতির সূচনা করে। গেলেকি বেলেপাথর (২০০-৭৮০ মিটার) লবণাক্ত জলীয় আবহে উপলেপিত হয় যা লাকওয়া বেলেপাথর (১৬০-৫৫০ মিটার) দ্বারা অনুসরিত। সোপান অঞ্চলের দক্ষিণাঞ্চলে স্বাদু পানির কর্বুরিত কর্দম (mottled clay) বা গিরুজান কর্দমের (০-৮৫০ মিটার) একটি ঘন স্তরক্রম অবক্ষেপিত হয়। মধ্য মায়োসিন যুগে প্রবাহজ পরিবেশে নাজিরা বেলেপাথর (০-৫৮০ মিটার) উপলেপিত হয়। বেলেপাথর ও কর্দম দ্বারা গঠিত নামসাং স্তরসমষ্টিও (২৫০-৫২০ মিটার) প্রবাহজ পরিবেশে মজুদকৃত ডেকিয়াজুলি বেলেপাথর দ্বারা অধিশায়িত। এখানে হলোসিন পাললিক অবক্ষেপের পুরুত্বের পার্থক্য ৩০০-৬৫০ মিটার। আসাম অববাহিকায় তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে ১৮২৫ সালে। সর্ববৃহৎ তেলক্ষেত্রটি হলো ‘ডিগবয়’ যেখানে বর্তমান উৎপাদন প্রতিদিন প্রায় ২৪০ ব্যারেল। ১০০০ এরও বেশী কূপ এখানে খনন করা হয়েছে। নাহারকাটিয়া, মোরেন এবং রুদ্রসাগর এগুলি আসাম অববাহিকার উল্লেখযোগ্য তেলক্ষেত্র। শিলালক্ষণের সাদৃশ্য থাকার দরুণ বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্তরসমষ্টি বর্ণনা করার ক্ষেত্রে আসাম অববাহিকার স্তরসমষ্টিকে মডেল ধরা হয়। [ডি.কে গুহ]
আরও দেখুন ভূতাত্ত্বিক বিবর্তন।
মানচিত্রের জন্য দেখুন বাংলাদেশের ভূতত্ত্ব।