অসহযোগ আন্দোলন ১৯৭১
অসহযোগ আন্দোলন ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পরিচালিত আন্দোলন। এ আন্দোলনে কেন্দ্রীয় শাসনের বিপরীতে স্বশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে দিগনির্দেশনামূলক ভাষণের মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ বিভিন্ন নির্দেশের মাধ্যমে এ আন্দোলন পরিচালনা করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু সরকার গঠনে আহবান জানানোর পরিবর্তে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এ সিদ্ধান্তকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দেন এবং এর প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহবান করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনগণ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরে সামরিক সরকারের গড়িমসি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপল্স পার্টির সরাসরি অসহযোগিতার ফলে শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এর বিস্তৃতি ছিল সম্পূর্ণ পূর্ব পাকিস্তান ব্যাপী। অসহযোগ আন্দোলনের পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং নয়মাস যুদ্ধের পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতেই ২ মার্চ ছাত্র সংগঠনগুলি ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সরকারি নির্দেশে গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস এম আহসানের পরিবর্তে প্রাদেশিক সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে গর্ভনরের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সরকার সামরিক আইন বিধি জারি করে সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এছাড়া সন্ধ্যা ৭ টা থেকে সকাল ৭ টা পর্যন্ত কার্ফু্য জারি করা হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এতে পরদিন থেকে সকল সরকারি অফিস, সচিবালয়, হাইকোর্ট ও অন্যান্য আদালত, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, পিআইএ, রেলওয়ে এবং অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহে হরতাল ঘোষিত হয়। শেখ মুজিবের উদ্দেশে একটি প্রচারপত্রে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার আহবান জানায়। এছাড়া ন্যাপ, জাতীয় শ্রমিক লীগ আন্দোলনে একাত্মতা জানায়। ন্যাপ (মো) পল্টনে এবং জাতীয় লীগ বায়তুল মোকাররমে প্রতিবাদ সভা করে। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিততে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘স্বাধীনতার ইশতাহার’ ঘোষণা করে। এতে ‘বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং এর তিনটি লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা হয়: বাঙালির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ, বৈষম্যের নিরসন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। আর আন্দোলনের ধারা হিসেবে খাজনা ট্যাক্স বন্ধ এবং সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলা হয়। স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা ...’ গানটি নির্বাচন করা হয়। সমগ্র প্রদেশে ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসার দিন জাতীয় শোক দিবস পালিত হয়। ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন অর্ধবেলা হরতাল আহবান করা হয়। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হতে থাকে। শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্র-শিক্ষক, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক সহ সকল পর্যায়ের জনগন আন্দোলনে যোগ দেয়। সরকার সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সহায়তায় আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। ঢাকা, টঙ্গী, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, যশোর, খুলনাসহ প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সামরিক বাহিনীর গুলিতে বহু লোক হতাহত হয়। ৪ মার্চ ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাঙালির অধিকার দাবি করেন। পিডিপি এবং জামায়াতে ইসলামী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আহুত ১২ তারিখের গোলটেবিল আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। পশ্চিম পাকিস্তানে তেহরিক-ই- ইশতেকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অব) আসগর খান খুব দ্রুত আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানান। এ ছাড়া বেলুচিস্তান ন্যাপ অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে ১২ মার্চ সেখানে হরতাল আহবান করে। এদিন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন অসহযোগ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে। এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক সাহেবজাদা ইয়াকুব খান পদত্যাগ করেন। ৫ মার্চ আওয়ামী লীগ কর্মিরা লাঠি হাতে বিক্ষোভ মিছিল করে। ছাত্রলীগ, বাংলা ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন নিহতদের স্মরণে গায়েবানা জানাজা পড়ে। পাকিস্তান লেখক সংঘ, পূর্ব পাকিস্তান সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি এদিন বিক্ষোভ মিছিল করে। পাকিস্তান পিপল্স পার্টির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়াকে অযৌক্তিক বলে অভিহিত করা হয়। ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় আহবান করেন। তবে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে নিয়োগের ঘোষণা এবং জাতির উদ্দেশে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতায় আন্দোলনকারীদের ওপর সরকারের বর্বরতার পক্ষে সাফাই বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ করে। শেখ মুজিব এদিন দলীয় হাইকমান্ড এবং ছাত্রলীগের সঙ্গে বৈঠক করেন। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে জাতীয় লীগ, মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে ন্যাপ, অলি আহাদ, শ্রমিক নেতা কাজী জাফর আহমদ পৃথকভাবে সমাবেশ করে আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহবান জানায়। সাংবাদিক ইউনিয়ন, শিক্ষক সমিতি, মহিলা পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক-শ্রমিক সমাজবাদী দল প্রতিবাদ সমাবেশ করে। ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী এক দিগনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন। এ ভাষণের মূল বিষয় ছিল চারটি, যথা, ক) চলমান সামরিক আইন প্রত্যাহার, খ) সৈন্যদের ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া, গ) সারাদেশে হত্যাকান্ডের তদন্ত করা এবং ঘ) নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
এ ছাড়া একই দিন তিনি পরবর্তী সপ্তাহের আন্দোলনের জন্য ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। অফিস-আদালত, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সরকারি প্রেসনোটে অসহযোগ আন্দোলনের ৬ দিনে ১৭২ জন নিহত এবং ৩৫৮ জন আহতের কথা প্রচার করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি সংগ্রামের জন্য সকলকে প্রস্ত্তত হতে এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের আহবান জানান।
৭ মার্চের পরে অসহযোগ আন্দোলন নতুন গতি লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সকল শাখা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে তাদের নির্দেশাবলি পালন করতে থাকে। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আহবান জানায়। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আযম এদিন পিপল্স পার্টি এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর সমালোচনা করেন। ৮ মার্চ তাজউদ্দিন আহমদ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সরকারি প্রেসনোট প্রত্যাখ্যান করে একে মিথ্যাচার বলে অভিহিত করেন। ছাত্রলীগ ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। ৯ জন সদস্য এবং আহবায়ক ও সম্পাদকসহ মোট ১১ জনকে নিয়ে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এ সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া এদিন ফরওয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লক ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাঙলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার জন্য ‘বাঙলা মুক্তিফ্রন্ট’ গঠনের আহবান জানিয়ে প্রচারপত্র বিলি করে। এ ছাড়া এদিন গেরিলা যুদ্ধের নিয়মকানুন সম্পর্কিত লিফলেট ছড়ানো হয়। এদিন পিডিপি প্রধান নূরুল আমিন এবং কিউএমএল নেতা আবদুস সবুর খান দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানান। ৯ মার্চ তাজউদ্দিন আহমদ বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১৬ টি নির্দেশ জারি করেন। অসহযোগ আন্দোলনের এ পর্যায়ে প্রদেশের প্রধান বিচারপতি বি.এ সিদ্দিকী নবনিযুক্ত গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ করাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। আতাউর রহমান খান শেখ মুজিবকে জাতীয় সরকার গঠনের আহবান জানান। মওলানা ভাসানী ন্যাপের ১৪ দফা ঘোষণা করেন এবং আজাদী রক্ষায় শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আন্দোলনের কথা বলেন। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) অসহযোগ আন্দোলনের পরিবর্তে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার আহবান জানায়। এছাড়া পুলিশ, ইপিআর, আইবি, সিআইডিকে সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহবান জানানো হয়। ১০ মার্চ অভিনেতা ও কলাকুশলীরা ‘বিক্ষুদ্ধ শিল্পী সমাজ’ নামে গোলাম মোস্তফা এবং খান আতার নেতৃত্বে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। সরকার আন্দোলন মোকাবেলায় সামরিক বিধি জারি করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন এবং সশস্ত্রবাহিনীর গতিবিধিতে অন্তরায় সৃষ্টি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করে। ১১ মার্চ তাজউদ্দিন আহমদ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা সংক্রান্ত আরও কিছু নির্দেশ জারি করেন। প্রদেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং কেন্দ্রের সকল নির্দেশ সমগ্র প্রদেশে পালিত হতে থাকে। কবি আহসান হাবীব, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন প্রমুখ সরকারের খেতাবপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ খেতাব বর্জন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-যুবক সশন্ত্র প্রস্ত্ততি ও প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি সৈন্য এবং আধাসামরিক বাহিনী তথা ইপিআর, পুলিশ, আনসারদের মধ্যেও আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনার জন্য প্রত্যেক জেলা, মহকুমা, থানা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে সংগ্রাম-প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। সারা প্রদেশের প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, খাজনা-ট্যাক্স আদায় বন্ধ হয়ে যায়। সরকার নতুন নতুন সামরিক আইন জারি করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। কিন্তু সরকারের আদেশ অমান্য করে আন্দোলন অব্যাহত থাকে। শুধু দেশে নয় বহির্বিশ্বেও অসহযোগ আন্দোলন ব্যাপক প্রচার পায়। ১১ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতিসংঘের সকল কর্মচারীকে সদরদপ্তরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
১২ মার্চ আওয়ামী লীগ প্রদেশের প্রতিটি ইউনিয়নে সংগ্রাম কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। পূর্ব পকিস্তানের সিএসপি অফিসার এবং প্রথম শ্রেণির ইপিসিএস কর্মকর্তাবৃন্দ অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করেন। এদিন সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা আন্দোলনে যোগ দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র প্রদর্শকগণ অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। ১৩ মার্চ সরকার সামরিক বিধি জারি করে প্রতিরক্ষা খাতের বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৫ মার্চ সকাল ১০ টায় চাকরিতে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয় এবং অমান্যকারীদের বরখাস্ত এবং সামরিক আদালতে বিচারের ঘোষণা দেয়। ১৪ মার্চ করাচিতে জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব ও পশ্চিমের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলসমূহের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করেন যা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। প্রাক্তন গভর্নর আযম খান, ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান, জমিয়াতুল উলেমা-ই- ইসলাম নেতা মুফতি মাহমুদ, কাউন্সিল লীগ নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা, সরদার শওকত হায়াত খান, মওলানা শাহ আহমদ নূরানী, কনভেনশন লীগের জামাল মোহাম্মদ কোরেজা, জামায়াতে ইসলামীর আবদুল গফুর, সরদার মওলা বক্স সুমরো প্রমুখ পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা শেখ মুজিবকে সমর্থন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানান। তবে মুসলিম লীগের আবদুল কাইয়ূম খান আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন। শেখ মুজিব সামরিক নির্দেশের জবাবে জীবনের বিনিময়ে ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বাধীনভাবে আত্মমর্যাদার সঙ্গে বসবাসের নিশ্চয়তার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এদিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাজউদ্দিন আহমদ সরকার পরিচালনার জন্য ৩৫ দফা ভিত্তিক নির্দেশনামা জারি করেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সম্পদ পাচার রোধের অংশ হিসেবে ঢাকার কয়েকটি স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করে। ঢাকার পত্রিকাগুলি ‘আর সময় নেই’/ ‘Time is Running Out’ শিরোনামে যৌথ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ভুট্টোর দুই সংখ্যাগরিষ্ঠতার সমালোচনা করে নূরুল আমীন, আবুল হাশিম, ওয়ালী খান প্রমূখ এ দাবি বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশের পর পূর্ব পাকিস্তানে সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ মূলত অকেজো হয়ে যায়। সেনাবাহিনী ছাড়া সর্বত্র আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রবল আন্দোলনের চাপে সরকার এ সময় আলোচনার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল এস জি এম পীরজাদা, মেজর জেনারেল খোদাদাদ খান, মেজর জেনারেল গোলাম ওমর, বিচারপতি এ আর কার্নেলিয়াস, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এম এম আহমদ এবং কর্নেল হাসান সহ ঢাকায় আসেন। ১৬ মার্চ থেকে ঢাকায় ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনা শুরু হয়। তবে বৈঠকের বাইরে অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেন। ১৭ মার্চ পুনরায় আলোচনা চলে। তবে এ সম্পর্কে সরকার কিংবা আওয়ামী লীগ বিস্তারিত কিছু প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। মওলানা ভাসানী এদিন চট্টগ্রামের জনসভায় ২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসের পরিবর্তে ‘স্বাধীন পূর্ববাংলা দিবস’ পালনের আহবান জানান।
সরকার সেনাবাহিনী তলব ও হত্যাকান্ড সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত একজন বিচারপতি, একজন ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তা, একজন সিএসপি অফিসার, একজন পুলিশ অফিসার এবং ইপিআরের কর্নেল পদমর্যাদার একজনকে নিয়ে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে।
১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট পেশের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করে। পক্ষান্তরে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং আবিদুর রেজার সমন্বয়ে ৩ সদস্য বিশিষ্ট পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তেজগাঁয়ে গুলিবর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে এ ধরনের উস্কানি বাঙালিরা সহ্য করবে না বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এদিন ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকের বিরতি। ১৯ মার্চ ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক হয় এবং পরদিন উভয় পক্ষের উপদেষ্টাসহ আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়। পৃথকভাবে উভয়পক্ষের উপদেষ্টামন্ডলীর বৈঠক হয়। প্রেসিডেন্টের পক্ষে এ আর কার্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামাল হোসেন এবং তাজউদ্দিন আহমদ অংশ নেন। পরদিনের আলোচনার ভিত্তি সম্পর্কে তাঁরা এ বৈঠক করেন বলে জানানো হয়। আলোচনা চলা অবস্থায় রংপুর ও সৈয়দপুরে পাকিস্তানি সৈন্যরা সাধারণ জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ করে। তবে জয়দেবপুরে জনতা পাকসৈন্যদের গুলিবর্ষণের মুখে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করতে গেলে তারাও প্রতিবাদে অংশ নেয়।
২০ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের ৬ জন প্রতিনিধি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, কামাল হোসেন, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও এম মনসুর আলী এবং ইয়াহিয়া খান ও তাঁর প্রতিনিধি এ আর কার্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসানের সঙ্গে দুবার বৈঠক হয়। শেখ মুজিব আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতির কথা বলেন এবং পরদিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক ও উপদেষ্টাদের পুনঃবৈঠকের কথা জানানো হয়। সরকার এদিন বেসামরিক জনগণের কাছে থাকা লাইসেন্সকৃত অস্ত্র থানায় জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। শেখ মুজিব এদিন মমতাজ দৌলতানা, মুফতি মাহমুদ প্রমুখের সঙ্গে বৈঠক করেন।
২১ মার্চ ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকে তাজউদ্দিন আহমদ শেখ মুজিবকে সহায়তা করেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো ১২ জন উপদেষ্টাসহ আলোচনায় যোগ দিতে ঢাকা আসেন। শেখ মুজিব এদিন মওলানা ভাসানীর কাছে দূত পাঠান। ভাসানী চট্টগ্রামের পোলো গ্রাউন্ডে জনগণকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১ দফার আন্দোলনে যোগ দেয়ার আহবান জানান। ন্যাপ ২৩ মার্চ ‘স্বাধীন পূর্ববাংলা দিবস’ এবং ছাত্রলীগ ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালন উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় পথসভা করে।
২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় স্থগিত করেন। এদিন মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টো আলোচনা হয়। প্রেসিডেন্টের ৪ জন উপদেষ্টার সঙ্গে পিপল্স পার্টির ৫ জন আইন বিশেষজ্ঞের আলোচনা হয়। তাঁরা আইনগত জটিলতার কথা বলে অধিবেশনের পূর্বেই প্রেসিডেন্টের ঘোষণার মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও ক্ষমতা হস্তান্তরে আওয়ামী লীগের দাবির বিরোধিতা করেন। এছাড়া ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানি অন্য নেতাদের সঙ্গেও এদিন আলোচনা করেন।
২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দিনটিকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ এবং ন্যাপ (ভাসানী) ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা দিবস’ হিসেবে পালন করে। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। ‘জয়বাংলা বাহিনী’র সদস্যরা ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে নতুন পতাকাকে অভিবাদন জানায়। ন্যাপ (ভাসানী), জাতীয় লীগ, ছাত্র সংগঠনগুলো এবং পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনে শরিক হয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে প্রেসিডেন্ট এদিন জাতীয় দিবসের নির্ধারিত বেতার ভাষণ বাতিল করেন। ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার অংশ হিসেবে এদিন আওয়ামী লীগের আলোচকবৃন্দ এবং প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে আলোচনা হয়। আওয়ামী প্রতিনিধি দলে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং কামাল হোসেন। আর প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন এ আর কার্নেলিয়াস, এস জি এম পীরজাদা এবং কর্নেল হাসান। আওয়ামী প্রতিনিধিরা এদিন প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের খসড়া উপস্থাপন করেন। ৬ দফার ভিত্তিতে প্রণীত এ খসড়ায় প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বাণিজ্য, পররাষ্ট্র, মুদ্রা, নাগরিকত্ব, কেন্দ্রীয় ঋণ, ওজন ও পরিমাপের মানদন্ড, কেন্দ্রীয় সম্পদ, আন্তর্জাতিক ও আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগ কেন্দ্রের হাতে রেখে এর বাইরে অন্য সকল বিষয় প্রদেশের অধীনে রাখার সুপারিশ করা হয়। খসড়ার অর্থনৈতিক বিষয়াবলি নিয়ে এদিন সন্ধ্যায় তাদের মধ্যে পুনরায় বৈঠক হয়।
২৪ মার্চ খসড়া শাসনতন্ত্রের অর্থনৈতিক বিষয়াবলি নিয়ে সকাল এবং সন্ধ্যায় উভয় প্রতিনিধিদলের মধ্যে দুদফা আলোচনা হয়। এ সময় আওয়ামী প্রতিনিধিরা খসড়ায় ‘ফেডারেশন’-এর পরিবর্তে ‘কনফেডারেশন’ প্রস্তাব করলে এতে আওয়ামী লীগের নীতিগত মৌলিক পরিবর্তন বলে সরকার পক্ষ প্রতিবাদ করে। এদিন উভয়পক্ষের বিশেষজ্ঞদের খসড়ার সব অনুচ্ছেদ ও তফসিলের ওপর দফাওয়ারি আলোচনা শেষ হয়। এরপর তাজউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন যে, বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে, তাই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আর আলোচনার প্রয়োজন নেই। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক তৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিব সাংবাদিক সম্মেলনে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে, চাপের মুখে কোনো সিদ্ধান্ত বাঙালিরা মেনে নেবে না। তিনি আন্দোলন আরো দৃঢভাবে পরিচালনার নির্দেশ দেন। এদিন জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনা হয়। তবে অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিক, বিশেষজ্ঞ ও উপদেষ্টা এদিন পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন।
২৫ মার্চ আওয়ামী লীগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পূর্বে জারিকৃত প্রশাসন পরিচালনার নির্দেশে সংযোজন-সংশোধন করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের সময় জনতার বাধায় পাকবাহিনী গুলি চালায়। এ ঘটনায় বিক্ষোভ চরম রূপ নিলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গুলিবর্ষণ ও সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। সৈয়দপুর, রংপুর ও জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ২৭ মার্চ সমগ্র প্রদেশে হরতাল আহবান করে। এদিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে খসড়া শাসনতন্ত্রের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপনের নির্ধারিত বৈঠক হয় নি। সংকটের সমাধানের পরিবর্তে ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। আন্দোলন দমনের নামে অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ সমগ্র প্রদেশে জনগনের উপর নির্বিচার আক্রমণ চালায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে।
[আবু মো. দেলোয়ার হোসেন এবং এ.টি.এম যায়েদ হোসেন]