সিদ্দিকী, বদরুদ্দীন আহমদ
সিদ্দিকী, বদরুদ্দীন আহমদ (১৯১৫-১৯৯১) আইনজীবী, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি, মানবহিতৈষী এবং একজন কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯১৫ সালের ৪ জানুয়ারি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার বলিয়াদি জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বোরহানুদ্দীন আহমদ সিদ্দিকীর তিন পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন জ্যেষ্ঠ। কাজেমউদ্দীন আহমদ সিদ্দিকী ছিলেন তাঁর পিতৃব্য।
বদরুদ্দীন আহমদ সিদ্দিকী গালিমপুর স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং ১৯৩২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই.এ পাস করেন। রাজনীতির প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল এবং ১৯৩৫ সালে ছাত্রাবস্থাতেই তিনি সর্বভারতীয় মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছর তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জুনিয়র হিসেবে আইন ব্যবসায় প্রবেশ করেন। পরবর্তীকালে ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে অ্যাডভোকেট হিসেবে যোগদান করেন এবং কলকাতার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা কমিশনের সাথে জড়িত হন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তিনি ঢাকা চলে আসেন এবং ঢাকা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
১৯৫২ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে তিনি স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির আইন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৬০ সালের মার্চ মাসে তাঁকে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি আর্ল ওয়ারেনের সভাপতিত্বে ১৯৬৭ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড জাজেস কনফারেন্সে তিনি কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৬৭ সালের ১৬ নভেম্বর তাঁকে পূর্ব-পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করা হয়।
বদরুদ্দীন আহমদ সিদ্দিকী ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান রেডক্রসের চেয়ারম্যান এবং ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান রেডক্রসের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন এবং একই সময়ে তিনি International League of Red Cross (ICRC) এর চারজন ভাইস চেয়ারম্যানের একজন হিসেবে চার বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে সুইস রেডক্রসের সাহায্যে কক্সবাজারে দেশের সর্বপ্রথম রাডার ব্যবস্থা নির্মাণে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রলয়ংকরী সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের সময় রেডক্রসের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দেশবাসীর জন্য ত্রাণ কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ অবাদন রাখেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বের দিনগুলিতে বিচারপতি সিদ্দিকী এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে স্বাধীনতার পথকে সুগম করেন। মার্চের ৯ তারিখে প্রধান বিচারপতি সিদ্দিকীকে পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে সামরিক শাসনকর্তা লেঃ জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ গ্রহণ করানোর জন্য বলা হলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। ঐদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের আদেশ পালনে তাঁকে বাধ্য করার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা বিচারপতি সিদ্দিকীর সরকারি বাসভবন ঘেরাও করা হয়। গভর্নরকে শপথ গ্রহণ করাতে রাজি হলে তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে নিরাপদে পাকিস্তানে পৌঁছানোর আশ্বাস দেওয়া হয়। পুনরায় বিচারপতি সিদ্দিকী শপথ গ্রহণ করাতে তাঁর অপারগতা প্রকাশের মাধ্যমে সরাসরি পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতা করেন। বিচারপতি সিদ্দিকীর এই সাহসী পদক্ষেপ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিচারপতি সিদ্দিকী স্বাধীনতার প্রয়াসে সরাসরি কোন ভূমিকা পালন করতে না পারলেও পাকিস্তান রেডক্রসের চেয়ারম্যান এবং ICRC-এর ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সমগ্র দেশে ত্রাণকার্যের সমন্বয় করে দেশবাসীকে সাহায্য করেন।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির অনুরোধে বিচারপতি সিদ্দিকী বাংলাদেশ রেডক্রসের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের জনগণের জন্য ত্রাণ-ব্যবস্থা পুনর্গঠনে তাঁর অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল।
১৯৮৬ সালে তিনি একজন মন্ত্রীর পদ ও মর্যাদাসহ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ১৯৮৬-৮৮ সালে তিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির পদ অলঙ্কৃত করেন।
বিচারপতি বি.এ সিদ্দিকী ১৯৮৮ সালে অবসর গ্রহণ করে ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ১৯৯১ সালের ৩ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। [লায়লা রাশিদা সিদ্দিকী]