শেখ অাঁখি সিরাজউদ্দীন উসমান (রঃ)
শেখ অাঁখি সিরাজউদ্দীন উসমান (রঃ) তেরো শতকের বাংলার বিখ্যাত সুফি-সাধক। শেখ নিজামউদ্দীন আউলিয়া (রঃ)-এর শিষ্য অাঁখি সিরাজ শেখ ফখরুদ্দীন জাররাদীর সঙ্গে ইসলামি শাস্ত্রসমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে শিক্ষা করেন। মওলানা রকনুদ্দীনের একজন ছাত্র হিসেবে তিনি কাফিয়াত, কুদুরি, মুফাসসল এবং মাজমা-উল-বাহরাইন শিক্ষা করেন এবং একজন সুদক্ষ পন্ডিতে পরিণত হন। শেখ নিজামউদ্দীন আউলিয়া তাঁকে খিলাফত (আধ্যাত্মিক প্রতিনিধিত্ব) প্রদান করেন এবং তাঁকে আয়না-ই-হিন্দুস্থান (হিন্দুস্থানের আয়না) বলে অভিহিত করতেন।
তাঁর আধ্যাত্মিক গুরুর মৃত্যুর পর অাঁখি সিরাজউদ্দীন বাংলায় চলে আসেন এবং রাজধানী শহর গৌড় ও পান্ডুয়ায় ধর্মীয় প্রচারকার্য শুরু করেন। তিনি ছিলেন বাংলায় চিশতিয়া তরিকার (আরাধনার পথ) প্রতিষ্ঠাতা। পান্ডুয়ার শেখ আলাউল হক (রঃ) ছিলেন তাঁর প্রধান শিষ্য। কথিত আছে যে, শেখ অাঁখি শেখ নিজামউদ্দীন আউলিয়ার কাছ থেকে গৃহীত পোশাক গৌড়ের সাগর দিঘির উত্তর-পশ্চিম কোণায় এক স্থানে মাটির নিচে পুঁতে রেখেছিলেন। তাঁর ইচ্ছামতো তাঁকে তাঁর পোশাকের প্রোথিত স্থানের কাছে সমাহিত করা হয়েছিল। তাঁর কবরের উপর একটি সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছিল।
স্থানীয় জনগণ তাঁকে পুরানা পীর বা পীরান-ই-পীর বলে ডাকতেন। পূর্বোক্ত শব্দের অর্থ প্রবীণ সুফি-সাধক এবং শেষোক্ত শব্দের অর্থ সুফিদের প্রাণ। এ দুয়ের মধ্যে, পুরানা পীরই অধিকতর গ্রহণযোগ্য, কারণ তিনিই হচ্ছেন বাংলায় চিশতিয়া তরিকার প্রাচীনতম সুফি-সাধক। তাছাড়া, পীরান-ই-পীর উপাধিটি বড় পীর হিসেবে বিবেচিত বিখ্যাত আবদুল কাদের জিলানী (রঃ)-এর জন্য ভারতীয় মুসলমান কর্তৃক নির্দিষ্ট হয়ে আছে। সমাধিসৌধটির নির্মাণকাল জানা যায় না। কিন্তু সমাধিসৌধটির ফটকগুলিতে সংযোজিত দুটি উৎকীর্ণ লিপি প্রমাণ দেয় যে, ফটকগুলি যথাক্রমে সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ এবং সুলতান নাসিরউদ্দীন নুসরত শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। হোসেন শাহ সুফি-সাধকের দরগাহে একটি সিকায়া বা পানীয় পানের জন্য একটি ছাউনি নির্মাণ করেছিলেন। সুফি-সাধকের মৃত্যুর তারিখ ৭৫৮ হিজরি/ ১৩৫৭ খিস্টাব্দ বলে বর্ণিত।
প্রতিবছর ঈদ-উল-ফিতর এর দিন এই সুফি-সাধকের মৃত্যুবার্ষিকী উদ্যাপিত হয়। এ অনুষ্ঠানে পান্ডুয়ায় শেখ আলাউল হক (রঃ) এর সমাধিসৌধে সংরক্ষিত মখদুম জাহানিয়া জাহানগাশত্-এর ঝান্ডা এবং পান্ডুয়া থেকে শেখ নূর কুতুব আলম-এর পাঞ্জা (হাতের ছাপ) শ্রদ্ধার নির্দশন হিসেবে গৌড়ে শেখ অাঁখির সমাধিসৌধে প্রেরণ করা হয়।
সাধারণত বিশ্বাস করা হয় যে, শেখ অাঁখি সিরাজউদ্দীন আদিতে বদাউন থেকে এসেছিলেন এবং তাঁর নামের সঙ্গে বদাউনি বিশেষণটি সংযুক্ত রয়েছে। কিন্তু আধুনিক গবেষণায় দেখা যায় একথা ঠিক নয়। শেখ আবদুল হক দেহলভি তাঁর আখবর-উল-আখিয়ার ফি আসরার-উল-আবরার গ্রন্থে তাঁকে অাঁখি সিরাজ গৌড়ি বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ তিনি বাংলার গৌড়ের অধিবাসী ছিলেন। একই পন্ডিত বলেন যে, শেখ অাঁখি দিল্লিতে শেখ নিজামউদ্দীনের খানকায় থাকাকালে বাংলায় অবস্থানরত তাঁর মাকে দেখতে যেতেন। তিনি বাংলায় চিরনিদ্রায় রয়েছেন এবং সেখানে তাঁর শিষ্য চিশতিয়া সুফিদের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাও সংরক্ষিত আছে। [আবদুল করিম]