মেয়াদি বন্দোবস্ত
মেয়াদি বন্দোবস্ত ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলায় রাজস্বযোগ্য ভূমি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তখন অধিকাংশ রাজস্বযোগ্য ভূমি অস্থায়ী বা মেয়াদি ভিত্তিতে বন্দোবস্ত দেওয়া হতো। মেয়াদি বন্দোবস্তযোগ্য এসব ভূমি ছিল দুই প্রকার: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের আওতা-বহির্ভূত মালিকের নিয়ন্ত্রণাধীন ভূমি, এবং সরকারের মালিকানাধীন ভূমি।
ব্যক্তিগত মালিকানাভুক্ত সম্পত্তির মেয়াদি বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের অধীনে সকল জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামী মালিক হিসেবে ভূমি ধারণ, ভূমি রাজস্ব নির্ধারণ এবং স্থায়িভাবে বিবিধ সুবিধা ভোগ করতে পারতেন। কিন্তু অধিকাংশ জমিদারই নিজস্ব ভূ-সম্পত্তির রাজস্ব নির্ধারণ ও তা আদায় করতে পারতেন না বলে তারা ভূমি বন্দোবস্ত নিতে অস্বীকৃতি জানান। বরং তারা সরকার থেকে তাদের ১০ ভাগ মালিকানা অথবা মালিকানাভুক্তি ভাতা গ্রহণ করে সরকারের হাতে ভূমির নিয়ন্ত্রণভার রেখে দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। বিশেষ করে পরিত্যক্ত সম্পত্তির ক্ষেত্রে এটি জমিদারদের বিশেষভাবে কাঙ্ক্ষিত ছিল। তবে ভূমি বন্দোবস্ত না চাইলেও তারা ভূমি রাজস্বের বন্দোবস্ত চেয়েছিলেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির ভূমি রাজস্ব বিভিন্ন হারে নির্ধারিত হওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এটি ছিল সরকার কর্তৃক ভূমি রাজস্বের হার বৃদ্ধির একটি সরকারি কৌশল। সেটেলমেন্ট অফিসার জেলা কালেক্টর হিসেবে এসব ভূমির পর্যায়ক্রমিক রাজস্ব জরিপ চালাতেন এবং সেই জরিপের ভিত্তিতে রাজস্বের হার পরিবর্তন করতেন।
ব্যক্তিমালিকানাভুক্ত মেয়াদি বন্দোবস্তকৃত ভূ-সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ১৮২২ সালের ৭নং রেগুলেশন ও ১৮৩৩ সালের ৯নং রেগুলেশনসহ বিশেষ আইনের দ্বারা পরিচালিত হতো। এসব আইনের অধীনে একজন মালিক সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হারে রাজস্ব গ্রহণ সাপেক্ষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য আবেদন করতে পারতেন। ১৭৭২ সাল থেকে সরকার লাখেরাজ ভূমি পুনঃগ্রহণ করে রাজস্বের অধীনে নিয়ে আসে। আইনে এসব লাখেরাজ ভূমির মালিকানা স্বীকৃত হয়, কিন্তু সরকার কর্তৃক দাবিকৃত রাজস্ব মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। যেসব ভূমিমালিক নির্ধারিত ভূমি রাজস্ব মেনে নিতে অস্বীকার করেন তারা মালিকানা হস্তান্তর সাপেক্ষে সরকার কর্তৃক মেয়াদি বন্দোবস্তের আওতায় পরিচালিত হতেন।
সরকারি ভূমি সরকারের এখতিয়ারভুক্ত ভূমির মধ্যে বেশির ভাগই ছিল অব্যবহূত ভূমি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রেগুলেশনসমূহ কেবল জমিদারদের ভূমি এবং ১৭৯৩ সালের মূল মালিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। প্রতিটি এস্টেটে প্রচুর অনাবাদি জমি ছিল এবং এগুলি মূল জমিদারদের ভূমির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এছাড়া বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত বিপুল পরিমাণ অব্যবহূত জমির ওপর কেউ মালিকানা দাবি করত না। চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও বাকেরগঞ্জ জেলায় মালিকানা দাবিবিহীন প্রচুর ভূমি ছিল। সরকার এসব সম্পত্তিকে জনগণের সম্পত্তি (সরকারি সম্পত্তি) হিসেবে ঘোষণা করে। প্রকৃত নিলাম খরিদ্দারের অনুপস্থিতিতে সম্পন্ন নিলামের মাধ্যমে সরকার কর্তৃক খরিদকৃত ভূমিও সরকারি সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত হয়। নদী বা সমুদ্র উপকূলে গড়ে ওঠা চর বা দ্বীপসমূহের মধ্যে যেগুলি বিদ্যমান কোন ভূ-সম্পত্তির পলিজ অংশ ছিল না, সেগুলিও সরকারি সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত হয়। এছাড়া রাজস্ব পরিশোধ না করায় অথবা আইনগত উত্তরাধিকারীর অনুপস্থিতিতে বাজেয়াপ্তকৃত ভূমি সরকারি ভূ-সম্পত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
মূলত উল্লিখিত ভূমি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে প্রদান করাই ছিল সরকারের নীতি। অবশ্য এর শর্তসমূহ সংশ্লিষ্ট জমিদার কর্তৃক মেনে নিতে হতো। কিন্তু সরকারের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকর হওয়ার দশ বছরের মধ্যে এই ব্যবস্থা বাংলায় আশানুরূপ ফল বয়ে আনতে পারেনি। ফলে ব্রিটিশ ভারতের অবশিষ্ট অংশের জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধারণা পরিত্যাগ করা হয়। এমনকি পূর্ববঙ্গেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় সরকারি ভূ-সম্পত্তি সাধারণভাবে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বাংলায় সরকারি ভূ-সম্পত্তি মেয়াদি ভিত্তিতে কৃষকদের নিকট ইজারা বা বন্দোবস্ত দেওয়া হতো। সকল ভূ-সম্পত্তির ইজারার জন্য অনুরূপ মেয়াদ ছিল না। প্রতিটি ভূ-সম্পত্তির অবস্থান ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে ৫ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত ইজারার মেয়াদ ছিল। সরকারের সর্বোচ্চ সুবিধার্থে ১৮২২-২৩ সালের রেগুলেশন অনুযায়ী জেলা সেটেলমেন্ট অফিসার খাস জমির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতেন। সরকারি স্বার্থ রক্ষার্থে অনেক সময় সেটেলমেন্ট অফিসার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভিত্তিতে সরকারি সম্পত্তি ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করতেন।
ব্যবস্থাপনা সরকারি মালিকানাধীন সম্পত্তির ক্ষেত্রে জেলা কালেক্টর সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। সরকারি সম্পত্তির নিয়মিত রাজস্ব জরিপ পরিচালনা করার আইনগত প্রয়োজন ছিল। ইতঃপূর্বে ভূ-সম্পত্তির সীমানা নির্ধারিত হতো খসড়া ধারণার ভিত্তিতে। রাজস্ব জরিপের সরাসরি ফল হিসেবেই প্রথমবারের মতো জমিদারদের ভূ-সম্পত্তির সীমানা নির্দিষ্টকরণ, সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি, খাজনার হার নির্ধারণ ও লিপিবদ্ধকরণ, ভূমিতে অধিকার ও স্বার্থ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি বিষয় নির্ধারিত হয়। স্থায়িভাবে বন্দোবস্তকৃত ভূমির ক্ষেত্রেও এসব সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য সরকার জমিদারদের ভূমির ওপরও থাকবস্ত (সীমানা) নির্ধারণ এবং জরিপ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সাধারণ জরিপ আইন (১৮৭০ সালের ৫নং বেঙ্গল অ্যাক্ট) এবং ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে সকল চিরস্থায়ী ও মেয়াদি বা অস্থায়িভাবে বন্দোবস্তকৃত ভূ-সম্পত্তির জরিপ ও সেটেলমেন্ট কার্যক্রম চালু করার বিধান রাখা হয়। কৃষিক্ষেত্রে এসব কার্যক্রমের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে ভূমির বিভিন্ন ধরনের মালিক ও মধ্যস্বত্বের অধিকার সুচিহ্নিত এবং প্রতিষ্ঠিত হয়। ভূমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি খাজনার হারকেও প্রভাবিত করে। ইচ্ছামতো খাজনার হার বৃদ্ধির বিষয়টি জমিদারদের নিকট জটিল মনে হয়। জরিপ ও বন্দোবস্ত কার্যক্রমের মাধ্যমে আরও আবিষ্কৃত হয় যে, জমিদারি ভূমির চেয়ে মেয়াদিভাবে বন্দোবস্তকৃত ভূমির খাজনার হার অনেক বেশি। তাই রায়ত বা প্রজাগণ সরকারের ভূ-সম্পত্তির চেয়ে জমিদারদের ভূ-সম্পত্তির কার্যক্রম পরিচালনায় অধিক আগ্রহী ছিলেন। মেয়াদিভাবে বন্দোবস্তকৃত সরকারি ভূমির মালিক কে তা নিশ্চিতভাবে নির্ধারিত না থাকার ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও শস্যহানির সময়ে রায়তদের দুর্ভোগ বেড়ে যায়।
সুন্দরবন এলাকায় মেয়াদি বন্দোবস্ত সুন্দরবন অঞ্চল সংলগ্ন জমিদার ও তালুকদারগণ যেসব জমিতে পুনঃমালিকানা দাবি করতে পারতেন, সেগুলির ওপর তাদের মালিকানা দাবি করার ও সেগুলিকে চাষের অধীনে আনার অনুমতি ছিল। ১৮২৫ সালে পতিত ভূমি বিধিমালা প্রয়োগ করার পূর্বপর্যন্ত জমিদারগণ এই স্বাধীনতা ভোগ করতেন। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী ১৭৯০ থেকে ১৮২০ সাল পর্যন্ত যেসব ভূমি নিকটবর্তী মালিকগণ কর্তৃক দাবি করা হতো এবং বস্ত্তত যেগুলি তাদের দখলে চলে যেতো, সেগুলি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে তাদের জমিদারিস্বত্ব হিসেবে চিহ্নিত হতো। অন্যদিকে এই জাতীয় জমিদারদের সীমানা-বহির্ভূত অঞ্চল খাসভূমি বা সরকারি ভূমি হিসেবে চিহ্নিত হতো। সরকার পতিত ভূমি মেয়াদি বন্দোবস্তের ভিত্তিতে হস্তান্তরের চেষ্টা করে। সুন্দরবনের পতিত ভূমির ওপর যে কোন ভূমিমালিক, পুঁজিপতি বা রায়ত পুনঃমালিকানা দাবি করলে তাকে প্রাথমিকভাবে ১০ বছরের জন্য কোনপ্রকার রাজস্ব ব্যতীত বন্দোবস্ত দেওয়া হতো। এসব ভূমির ওপর ধার্যকৃত করের পরিমাণও ছিল অতি সামান্য।
১৮৫৩ ও ১৮৬৩ সালের পতিত ভূমি বিধিমালার আওতায় সুন্দরবন এলাকার ভূমি মালিকদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে মালিক হিসেবে এবং মেয়াদি বন্দোবস্ত বিধিমালার অধীনে ইজারাগ্রহীতা হিসেবে মালিকানার স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। পুনঃদাবি উত্থাপনকারীরা মেয়াদি বন্দোবস্তকেই পছন্দ করে, কারণ এতে তাদের কেবল নির্ধারিত হারে রাজস্ব প্রদান করতে হতো। ১৮৭৯ সালের পতিত ভূমি বিধিমালার আওতায় মেয়াদি বন্দোবস্তের অধীনে মূল ইজারার মেয়াদ ৪০ বছর নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে ৩০ বছর পর নতুন রাজস্ব হার নির্ধারণের মাধ্যমে বন্দোবস্ত নবায়নের বিধান রাখা হয়। এই বিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৫,০০০ বিঘা (৬৬৯ হেক্টর) এবং সর্বনিম্ন ২০০ হেক্টর ভূমি প্রদান করা হয়। ভূমির ইজারা ব্যবস্থা উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে হস্তান্তরযোগ্য প্রজাস্বত্ব অধিকার সৃষ্টি করে। বিক্রয়ের জন্য উচ্চতর অধিকার পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বা তা না হলে কৃষক পর্যায়ে প্রজাস্বত্ব অধিকার অব্যাহত থাকে এবং এ নিয়মের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ভূ-সম্পত্তির মেয়াদি বন্দোবস্তের জন্য ১৮৭৯ সালের পতিত ভূমি বিধিমালা এবং ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ছিল দিকনির্দেশক বিধান। তবে এটি পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০-এর অধীনে প্রকৃত রায়তদের মালিক হিসেবে ঘোষণার এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ সকল প্রকার বন্দোবস্ত রহিত করার পূর্ব পর্যন্ত কার্যকর ছিল। [সিরাজুল ইসলাম]