রাজস্ব জরিপ

রাজস্ব জরিপ  ভারতের ঔপনিবেশিক প্রশাসন, বিশেষ করে কোম্পানি আমলে (১৭৫৭-১৮৫৭), রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। তার মধ্যে প্রথমে শুরু হয় জমি জরিপ করা ও তার ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ণয় করার প্রক্রিয়া। পলাশীর যুদ্ধ-এর পর ক্লাইভ, রবার্ট-এর (১৭২৫-১৭৭৪) নেতৃত্বে কোম্পানি কলকাতা থেকে কুলপি পর্যন্ত ২৪টি পরগনার জমিদারি পায়। ক্লাইভ এই জমিদারি মাপজোকের জন্য একদল জরিপবিদ নিয়োগ দেন। ফ্র্যাঙ্কল্যান্ডের নেতৃত্বে এই জমিদারির জমি জরিপের কাজ শুরু হলেও জরিপ চলাকালীন ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড মারা গেলে জরিপের কাজ শেষ করেন হগ ক্যামেরন। বাংলার নদীপথগুলির জরিপ করেন জেমস রেনেল(১৭৪২-১৮৩০)। কোম্পানি তাঁকে ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল বা জরিপ বিভাগের প্রধান হিসেবে ১৭৬৭ সালে নিয়োগ দেয়। বাংলার নদীপথগুলি জরিপ করে রেনেল বাংলার নদী গতিপথের ১৬টি মানচিত্র তৈরি করেন। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধ জয় ও ১৭৬৫ সালে দেওয়ানী লাভের পর কোম্পানি বাংলার জমি জরিপের মাধ্যমে রাজস্ব নির্ণয়ে উদ্যোগী হয়। এই লক্ষ্যে মুর্শিদাবাদে গঠিত হয় কম্পট্রোলিং কাউন্সিল অব রেভনিউ নামের একটি কমিটি এবং পরে গঠন করা হয় কমিটি অব রেভেনিউ। মূলত এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২৪ সালে বোর্ড অব রেভিনিউ এবং বেঙ্গল ট্যারিফ বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হলেও এ দু প্রতিষ্ঠানের কাছে ভূমি রাজস্ব আদায়ের পরিবর্তে শুল্ক ও কর রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পিত হয়।

ব্রিটিশ সরকার বাংলার মৌজা ও পরগনাসমূহের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক বিবরণ এবং কৃষির পরিস্থিতি নিয়ে নিবিড় অনুসন্ধান কাজ চালায়। রাজস্ব জরিপ শুরুর পূর্বে পরিচালিত থাকবস্ত জরিপ গ্রামাঞ্চলে বৈজ্ঞানিক জরিপের ভিত্তি প্রস্তুত করেছিল। ১৮৪৫ সাল থেকে থাকবস্ত উপাত্তের ভিত্তিতে রাজস্ব জরিপ কাজ আরম্ভ হয়। নিয়মানুযায়ী একটি মৌজায় থাকবস্ত জরিপ শেষ হওয়ার পরপরই রাজস্ব জরিপ কাজ শুরু হওয়ার কথা। রাজস্ব জরিপের প্রধান লক্ষ্যগুলি ছিল: (ক) গ্রাম ও ভূসম্পত্তির সীমানা নির্ধারণ নিশ্চিত করা এবং এসব সীমানা নির্দেশ করে সঠিকভাবে পরগনা-মানচিত্র প্রস্তুত করা; (খ) প্রাকৃতিক বিবরণের অনুপুঙ্খ তালিকা করা; (গ) প্রশাসনিক প্রয়োজনে লাভজনকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে এমন পরিসংখ্যানগত উপাত্ত সংগ্রহ করা; এবং (ঘ) কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৌজার মাঠ (খসড়া) জরিপ করা।

পরগনা ছিল রাজস্ব জরিপ মানচিত্র ও অন্যান্য তথ্যের একক। পরগনা মানচিত্রে সত্তরটি জরিপ বিষয়ে তথ্য পরিবেশিত হয় যাতে নগর, শহর, গ্রাম, পরিত্যক্ত গ্রাম, হাটবাজার, পাকা ও কাঁচা রাস্তা, খাল ও নদী, জলাভূমি, সেতু ও কালভার্ট, চাষযোগ্য ও অকর্ষিত জমি, বনভূমি, হিন্দু ও মুসলিম জনসংখ্যা এবং গাছপালা সম্পর্কে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়। রাজস্ব জরিপ মানচিত্রগুলির সবক’টি এখন ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে (প্রাচ্য রেকর্ড) সংরক্ষিত। মানচিত্রগুলির অনুলিপি পুরানো সকল জেলায় বিভিন্ন কালেক্টরেট রেকর্ড রুমেও অনিয়মিতভাবে সংরক্ষিত আছে।

ব্রিটিশ কোম্পানি নিলামে সবথেকে বেশি খাজনা দেওয়া ব্যক্তির সঙ্গে জমি বন্দোবস্ত প্রদান করে, পাঁচ বছর মেয়াদি এই বন্দোবস্তের নাম ইজারাদারি বা পাঁচসালা বন্দোবস্ত। ধার্য রাজস্ব অনেক বেশি হওয়ায় ইজারাদারদের অনেকে দেয় রাজস্ব শোধে ব্যর্থ হয়। তাই কোম্পানি প্রথমে দশসালা বন্দোবস্ত চালু করে এবং পরে তা তুলে দিয়ে ১৭৯৩ সালে লর্ড চার্লস কর্নওয়ালিস-এর (১৭৩৮-১৮০৫) সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে।

ভূমি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে ভূমিতে জমিদার ও রায়তের অধিকার শনাক্তকরণের উদ্যোগ নেয়া হয় বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ১৮৮৫-এর অধীনে ১৮৮৮ সাল থেকে ভূমি জরিপের মাধ্যেমে। ভূমি জরিপের মাধ্যমে বন্দোবস্ত দিয়ে ভূমিতে সকল স্বার্থসংশ্লিষ্ট শ্রেণীর দায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস শুরু হয়। ব্রিটিশ শাসনের অবসান পর্যন্ত এ পদ্ধতি ও প্রয়াস অব্যাহত থাকে, ব্রিটিশ শাসন এর অবসানের পর ১৯৫০ সালের স্টেট একুইজিশন অ্যাক্ট-এর আওতায় পাকিস্তান আমলে এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশেও ভূমি জরিপের কাজ ভিন্নরূপে এখনো অব্যাহত আছে। [সিরাজুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আবদুল মজিদ]

আরও দেখুন জরিপ ও বন্দোবস্ত