মুদ্রণ শিল্প
মুদ্রণ শিল্প প্রযুক্তি হিসেবে সর্বপ্রথম ভারতে চালু করেন পর্তুগিজগণ। প্রথম মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় গোয়ায়। এরপর মুদ্রণ প্রযুক্তি বোম্বাইয়ে চালু হয় ১৬৭০ সালে। ইউরোপীয় মিশনারিদের প্রচেষ্টায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছাপাখানা চালু হয়। এই সকল ছাপাখানার অধিকাংশই অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে স্থাপিত হতে থাকে। পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারকগণ লিসবন থেকে রোমান হরফে বাংলা বই ছাপিয়ে আনেন। সবচেয়ে পুরাতন বাংলা মুদ্রণের নমুনা পাওয়া গেছে ১৬৮২ সালে প্যারিসে মুদ্রিত একটি গ্রন্থে। এসব বাংলা মুদ্রণ ছিল তামার পাতে, তখনও বাংলা অক্ষর ঢালাইয়ের কোন ব্যবস্থা হয়নি। মুদ্রণের জন্য বাংলা অক্ষরের নকশা প্রথম প্রস্ত্তত করেন চার্লস উইলকিন্স। তাঁর ডিজাইনকৃত অক্ষরে ছাপা হয় নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড রচিত A Grammar of the Bengal Language (১৭৭৮) গ্রন্থটি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা উইলকিন্স ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার চুঁচুড়ায় একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। প্রথম দফায় উইলকিন্স যে টাইপ নির্মাণ করেন তাকে পরবর্তী সময়ে পঞ্চানন কর্মকার আরও মার্জিত করে উন্নতমানের টাইপ নির্মাণ করেছিলেন। উইলকিন্সের সহকারী পঞ্চানন কর্মকার ছিলেন বাংলা টাইপ খোদাই করতে জানা প্রথম বাঙালি। বাংলা টাইপকে আরও উন্নত করে লাইনো টাইপে উন্নীত করার কৃতিত্ব সুরেশচন্দ্র মজুমদারের। বিশ শতকের গোড়ার দিকে লাইনো-এর বাংলা অক্ষর বিন্যাস মনোটাইপ, ইস্টার্ন টাইপ এবং টাইপ রাইটার-এ বাংলা অক্ষর বিন্যাসে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে।
উনিশ শতকে ছেনিকাটা ফিক্সড টাইপ দিয়ে বই ছাপা হতো আর ছবি ছাপার জন্য ব্যবহূত হতো কাঠে খোদাই ব্লক। উপেন্দ্রকিশোর উন্নতমানের ছবি ছাপার কৌশল উদ্ভাবন করেন। এসব পদ্ধতির মধ্যে ছিল ষাট ডিগ্রি স্ক্রিন, ডায়াফ্রাম পদ্ধতি, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র, ডায়োটাইপ ও রিপ্রিন্ট। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ১৮৮৫ সালে ইউরোপীয় কোম্পানি নামে ব্লক তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৫ সালে এর নাম দেওয়া হয় ইউ রায় অ্যান্ড সন্স। কাঠের পরিবর্তে তামা ও দস্তার পাতে খোদাই করে ছাপলে সেই ছাপা অনেক উন্নতমানের হয়, এটি বুঝতে পেরে উপেন্দ্রকিশোর অন্ধকার ঘরে বসে তা পরীক্ষা করে দেখতেন। অন্ধকার ঘরে আলোর প্রতিফলনও প্রতিসরণ লক্ষ্য করে তিনি হাফটোন ব্লক তৈরির সূত্র উদ্ভাবন করে স্ক্রিন তৈরির নকশা করেন।
১৮৪৭-৪৮ সালে রংপুরে প্রথম ছাপাখানা বার্তাবহ যন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বপ্রথম একজন ইংরেজ আলেকজান্ডার ফারবেখ ঢাকায় ছাপাখানা স্থাপন করেন। ছাপাখানাটির নাম ছিল ‘ঢাকা প্রেস’। এই ছাপাখানাটিতে অবশ্য বাংলা মুদ্রণের কোন ব্যবস্থা ছিল না। এখান থেকে ঢাকা নিউজ নামে ইংরেজি সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। ১৮৬০ সালে বাংলা প্রেস বা বাংলা যন্ত্র নামে ঢাকায় দ্বিতীয় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ছাপাখানাটি প্রথমদিকে শুধু বাংলা মুদ্রণের কাজ করত। ১৮৬৬ সালে ঢাকায় তিনটি ছাপাখানা ছিল। আর একটি প্রাচীন ছাপাখানা ছিল ফরিদপুরে এবং সেখান থেকে বাংলা অমৃতবাজার পত্রিকা প্রকাশিত হতো।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পূর্ববাংলায় যে মুদ্রণ শিল্পের অস্তিত্ব ছিল তা ছিল নিতান্তই ক্ষুদ্রাকৃতির। তখন অধিকাংশ প্রকাশনা কলকাতা থেকে মুদ্রিত হতো। ক্রমে ঢাকায় নিজের প্রয়োজনে আধুনিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। সরকারি ফরম, গেজেট, নানাপ্রকার পুস্তক-পুস্তিকা ছাপার প্রয়োজন তো ছিলই, সেই সঙ্গে পাঠ্যপুস্তক ও সংবাদপত্র মুদ্রণের বিপুল চাহিদা থাকার কারণে সরকারি ও বেসরকারি উভয়ক্ষেত্রে দ্রুত মুদ্রণ শিল্পের প্রসার ঘটতে থাকে। বিদেশ থেকে আধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশলসহ যন্ত্রপাতি সরকারি ও বেসরকারি খাতে আমদানি হয়ে মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল। অবশ্য বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে এই সকল যন্ত্রপাতি আমদানি সহজ ছিল না। উন্নতমানের মুদ্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তিরও অভাব ছিল। ঢাকার ইডেন প্রেসে সর্বপ্রথম বাংলা লাইনো টাইপ মেশিন স্থাপিত হয়েছিল। মনোটাইপ মেশিন স্থাপিত হয়েছিল প্যারামাউন্ট প্রেসে ও বলিয়াদি প্রেসে। তারা মনো সুপার কাস্টিং মেশিন বসিয়ে তাতে তৈরি নানাপ্রকার ইংরেজি-বাংলা টাইপ অন্যান্য প্রেসের নিকট বিক্রয় করত। অন্যান্য প্রেস সেই টাইপ দিয়ে কম্পোজ করে প্লাটেন অথবা ফ্লাটবেড মুদ্রণযন্ত্রে বই ও পত্র-পত্রিকা ছাপত। পঞ্চাশের দশক থেকে যে সকল প্রেস উন্নতমানের মুদ্রণের জন্য খ্যাতি লাভ করেছিল তারা হচ্ছে আলেকজান্ডার মেশিন প্রেস, স্টার প্রেস, জিনাত প্রেস ইত্যাদি।
দৈনিক আজাদ পত্রিকা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই কলকাতা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হতো। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর বেশ কিছুদিন কলকাতা থেকেই এই পত্রিকা মুদ্রিত হয়ে আসত। অবশেষে যন্ত্রপাতি কলকাতা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং ঢাকা থেকে পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। এদিকে হামিদুল হক চৌধুরী ‘আল হেলাল প্রিন্টিং প্রেস’ নাম দিয়ে একটি ছাপাখানা স্থাপন করে দ্য পাকিস্তান অবজারভার নামে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করতে আরম্ভ করেন। প্রেসের ম্যানেজার ছিলেন আবদুল গনি হাজারী। হাজারী মুদ্রণ বিষয়ে স্বশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন। প্রেসের যন্ত্রপাতি আমদানি করতে গিয়ে কোন যন্ত্রের কী ক্ষমতা ও গুণাগুণ সে সম্পর্কে তিনি বিশেষভাবে পড়াশোনা করে অবহিত হতেন আর এভাবেই তিনি মুদ্রণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। কবি সিকান্ন্দার আবু জাফর সমকাল মুদ্রণ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই ছাপাখানা থেকে সেকালের পূর্ব পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকা সমকাল প্রকাশিত হতো। সিকান্দার আবু জাফর হাতে কম্পোজ করা টাইপ দিয়ে উন্নতমানের রুচিসম্মত পত্রিকা ছাপতেন। সে সময়ের অধিকাংশ মুদ্রাকর একই সঙ্গে ছিলেন শিক্ষিত পন্ডিত ও মুদ্রাকর বা প্রকৌশলবিদ। বাংলাদেশে একই গুণে গুণান্বিত ছিলেন আবদুল গনি হাজারী ও সিকান্দার আবু জাফর। ফোনেটিক ও গাণিতিক চিহ্ন-সম্বলিত জটিল মুদ্রণ কাজের জন্য খ্যাতি লাভ করেছিল এশিয়াটিক প্রেস।
পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা মুদ্রিত হতো প্রধানত লেটার প্রেসে। সেজন্য ছবি মুদ্রণের জন্য ব্লকের প্রয়োজন হতো। লাইন ব্লক অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারিগররা হাতে তৈরি করতেন। হাফটোন ব্লকের জন্য প্রয়োজন হতো ক্যামেরা ও স্ক্রিনের, সেইসঙ্গে দক্ষ কারিগরের। পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে এই কাজে সবচেয়ে নামকরা প্রতিষ্ঠান ছিল লিঙ্কম্যান, ইস্ট অ্যান্ড প্রসেস ও স্ট্যান্ডার্ড ব্লক কোম্পানি। প্রায় একই সময়ে অফসেট প্রেস স্থাপন করে সেকালের ইস্ট পাকিস্তান কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি প্রেস ও পাইওনিয়ার প্রিন্টিং প্রেস। মুদ্রণ শিল্প সমিতির হিসাবমতো বর্তমানে মাঝারি ও ছোট আকারের ছাপাখানার সংখ্যা প্রায় আটশত।
১৯৬৭ সালে ঢাকায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় মুদ্রণ প্রযুক্তি বিষয়ক দেশের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউট। এখানে মুদ্রণের প্রাথমিক স্তরের মুভেবল টাইপ, লাইনো টাইপ মেশিন ও লেটার প্রেস, গ্যালারি টাইপ ক্যামেরা থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তির অফসেট লিথোগ্রাফি, গ্র্যাভিউর, স্ক্রিন প্রিন্টিং, অত্যাধুনিক প্রসেস ক্যামেরা (হরাইজন্টাল ও ভার্টিক্যাল), অটোপ্লেট প্রসেসর, লিথো ফিল্ম, প্যানক্রোমাটিক ফিল্ম প্রযুক্তিসহ উন্নত ধরনের মেকানিজম সংযোগ করা হয়েছে। বর্তমানে আধুনিক বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে কম্পিউটার মুদ্রণকৌশল বিষয়ক নতুন কারিকুলাম প্রবর্তন করা হয়, যেখানে ইমেজ সেটার, ড্রাম স্ক্যানার, ফ্লাটবেড স্ক্যানার, লেজার প্রিন্টার, ইন্ক জেট প্রিন্টারসহ আধুনিক মুদ্রণ প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়।
উনিশ শতকে আশির দশকে মুদ্রণ শিল্পে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। যে সিসার হরফ গত পাঁচশ বছর মুদ্রণ শিল্পে দোর্দন্ড প্রতাপে রাজত্ব করেছে তাকে প্রায় রাতারাতি নির্বাসিত করা হয়েছে কম্পিউটারের বদৌলতে। পুরানো আমলের ঐতিহ্যবাহী মুদ্রণকৌশল এখন গ্রামাঞ্চলেও নেই। বাংলায় কম্পিউটার কম্পোজ এবং মুদ্রণের জন্য বেশকিছু সফটওয়্যার আবিষ্কৃত হয়েছে।
কম্পিউটারে বাংলা অক্ষর বিন্যাসের জন্য কয়েকটি ভিন্ন ধরনের কি-বোর্ড আছে। কম্পিউটারে বাংলা হরফ সংযোজন করার কৃতিত্ব বেশ কয়েকজনের। ১৯৮৪ সালে সর্বপ্রথম সাইফ-উদ-দোহা শহীদ বাংলা হরফের ডিজাইন করেন অ্যাপেল ম্যাকিনটশ কম্পিউটারের জন্য। ১৯৮৬ সালে মাইনুল আরেক ধাপ অগ্রসর হয়ে বাংলা হরফের ডিজাইন করেন। ১৯৯৪ সালে মোস্তফা জববার অ্যাপেল ম্যাকিনটশ কম্পিউটারে নতুন কি-বোর্ডে বাংলা হরফ তৈরি করেন; এবং কি-বোর্ডের নাম বিজয় কি-বোর্ড আর ফন্টের নাম দেন তন্বী, সুতন্বী। পরবর্তীকালে তিনি আইবিএম কম্পিউটারেও বিজয় বাংলা সফটওয়্যার উদ্ভাবন করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের মুদ্রণশিল্পে এ সফটওয়্যার ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে।
ডিজিটাল প্রিন্টিং-এ সরাসরি কম্পিউটার টু প্লেট (সিটিপি) ব্যাপকভাবে মুদ্রণশিল্পে ব্যবহূত হচ্ছে। সিটিপি প্রযুক্তি আসার ফলে পজেটিভ প্রসেসিং করে প্লেট তৈরির করার ঝামেলা দূর হয়েছে এতে খরচ অনেক কম। বর্তমানে উন্নতবিশ্বে কম্পিউটার থেকে ডিজাইন, কম্পোজ ও বহুরঙা ছবিসহ মেকআপ শেষে সরাসরি প্রিন্টার থেকে রঙিন মুদ্রণের কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে, যাতে পজেটিভ ও প্লেট মেকিং-এর প্রয়োজন হয় না। প্রাচীন পদ্ধতির মুদ্রণকৌশল বাংলাদেশে আসতে সময় লেগেছিল কয়েক দশক। সেক্ষেত্রে কম্পিউটার প্রযুক্তিনির্ভর মুদ্রণকৌশল উন্নত দেশগুলি থেকে এদেশে এসেছে মাত্র এক দশকে। [ফজলে রাবিব এবং মো. জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া]