মাধ্যমিক শিক্ষা
মাধ্যমিক শিক্ষা প্রাথমিক শিক্ষার পরবর্তী এবং উচ্চ শিক্ষার পূর্ববর্তী সময়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক শিক্ষার তিনটি পর্যায় রয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু হয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিম্ন-মাধ্যমিক বা জুনিয়র পর্যায়ের শিক্ষা, নবম ও দশম শ্রেণিতে মাধ্যমিক বা সেকেন্ডারি পর্যায় এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রদান করা হয়। সাধারণত পাঁচ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষার শুরু ধরা হয় বলে মাধ্যমিক শিক্ষাকে ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও বলা যায়।
প্রাচীনকাল প্রাচীন বৈদিক কালে (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১০০০) শিক্ষা ছিল পারিবারিক এবং তখন সাধারণত পিতা পুত্রকে শিক্ষা দিতেন। পরবর্তী বৈদিক যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০-৫০০) বা উপনিষদ যুগে শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়ে একটি নির্দিষ্ট আকৃতি ধারণ করে। এ সময়ে বাংলায় ব্রাহ্মণীয় শিক্ষার প্রবেশ ঘটে। উপনয়ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গুরু তার শিষ্যকে গ্রহণ করতেন। উপনয়নের জন্য শিক্ষা শুরুর বয়স সাধারণত ব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে ৮ বছর, ক্ষত্রিয়ের ক্ষেত্রে ১১ বছর এবং বৈশ্যের ক্ষেত্রে ১২ বছর নির্ধারিত ছিল। গুরুর গৃহ ছিল বিদ্যালয়। সেখানে ছাত্ররা পারিবারিক সদস্য হিসেবে গোটা শিক্ষাকাল অতিবাহিত করত। অর্থাৎ, প্রাচীন ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা আবাসিক বৈশিষ্ট্য বিরাজমান ছিল। পড়াশোনার জন্য কোন ফি বা বেতন ছিল না। তবে ছাত্ররা ব্যক্তিগতভাবে গুরুর ভূমি কর্ষণে শারীরিক শ্রম দিত। প্রাচীন বৈদিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা শুধু স্বল্পবয়সী ব্রাহ্মণদের জন্য নির্ধারিত ছিল।
পরবর্তী বৈদিক যুগে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত হয় ব্রাহ্মণদের দ্বারা। এই শিক্ষার অভিলক্ষ্য ছিল ছাত্রদের স্ব স্ব গোত্রে তাদের অবস্থান অনুযায়ী ভবিষ্যৎ জীবনের প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি মুখস্থ করা। রাষ্ট্র সাধারণত গুরুর বিদ্যালয়কে লাখেরাজ জমি প্রদান করে সহায়তা দিত। কিন্তু গুরু কী শিক্ষা দিবেন বা কীভাবে দিবেন এতে তার পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। গুরুগৃহে ছাত্ররা সাধারণত তিনটি প্রধান বেদ পড়ত। এগুলি হচ্ছে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ ও সামবেদ এবং কোন কোন সময় অথর্ববেদ। এছাড়া অধিবিদ্যা ও ব্যাকরণের প্রাথমিক পাঠ, যুক্তিবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, জীববিদ্যা, গণিত, উপাসনার মতবাদ, জোতির্বিদ্যা এবং তৎকালে জানা জ্ঞান ও সংস্কৃতির সকল শাখা ছাত্ররা অধ্যয়ন করত। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় ছাত্রদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে একই ধরনের পাঠ্য বিষয় থাকত। উচ্চতর পর্যায়ে পাঠক্রম ভিন্ন হয়ে যেত। ব্রাহ্মণ ছাত্ররা বেদ এবং তাদের পুরোহিত পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চতর বিষয় পড়াশোনা করত। পক্ষান্তরে, ক্ষত্রিয়রা সামরিক কৌশল, তীরবিদ্যা ও রাজনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করত। গুরুর বিদ্যালয়ে সাধারণ এবং পেশাভিত্তিক উভয় প্রকার পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত ছিল। শিক্ষাকাল সাধারণত ১৬ বছর, কখনও কখনও ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত স্থায়ী হতো। গুরু এবং শিষ্যের মধ্যে সম্পর্ক ছিল খুবই আন্তরিক ও ব্যক্তিগত। প্রাচীন ভারতে গুরুকে খুবই সম্মান করা হতো।
সমাজের অন্যদের জন্য শিক্ষা ছিল বৃত্তিমূলক। ব্যবসায়ী অর্থাৎ বৈশ্যরা ব্যাকরণ ও ব্যবসায় পদ্ধতি বিষয়ে পড়াশোনা করত। শিক্ষানবিশ পদ্ধতিতে তাদের শিক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। শূদ্ররা কৃষি ও সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এবং অসংখ্য শিল্প ও বৃত্তির সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের শিক্ষাও ছিল উৎপাদন ও বৃত্তিকেন্দ্রিক।
প্রাচীন যুগের শেষ পর্যায়ে এসে কঠোর বর্ণপ্রথা চালুর ফলে শিক্ষা অনেকটা সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং দুই ধরনের বিদ্যালয়ের উদ্ভব হয়। একটি হচ্ছে টোল বা পাঠশালা এবং অপরটি দেশীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়। টোলগুলি ছিল মাধ্যমিক শিক্ষাসহ উচ্চ শিক্ষার বিদ্যাপীঠ। সেখানে সংস্কৃত ভাষায় পড়ানো হতো এবং ঐতিহ্যবাহী ধ্রুপদী শিক্ষা দেওয়া হতো। প্রাথমিক বৈদিক যুগে ৮ বছর বয়সে উপনয়ন হওয়ার পর বালক-বালিকা উভয়ই শিক্ষাক্ষেত্রে সমানাধিকার ভোগ করত। মেয়েরা গুরুগৃহে তাদের শিষ্যত্ব শুরু করত। কুমারীরা শিক্ষা সমাপনান্তে অনুরূপ জ্ঞানী ব্যক্তিকে বিয়ে করত। বৈদিক সমাজে স্ত্রী স্বামীর সকল ধর্মীয় কাজে নিয়মিত সঙ্গী থাকত। সুতরাং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদনের জন্য তাকে বৈদিক জ্ঞান আহরণ করতে হতো। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের ফলে পরবর্তী সময়ে মহিলারা উদার সামাজিক মর্যাদা ও শিক্ষার সুযোগ হারিয়ে ফেলে। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ শিক্ষার পাশাপাশি ব্রাহ্মণীয় শিক্ষাব্যবস্থা বিস্তৃতি লাভ করে। মুসলমান ও ব্রিটিশ আমলেও এটা অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশে এখন মাধ্যমিক পর্যায়ের যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান সেগুলি ব্রাহ্মণীয় শিক্ষার টোলের সমতুল্য। বৌদ্ধ শিক্ষা ছিল মঠ বা বিহারকেন্দ্রিক। বৌদ্ধধর্মের প্রাথমিক ধারণা ছিল শিক্ষানবিশকে বৌদ্ধ বিশ্বাসের মতবাদের ওপর যথাযথ শিক্ষা প্রদান এবং তার মঠজীবনে অভ্যস্ত হওয়ার সময় স্বীয় আচরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে হবে।
বৌদ্ধ ধর্মে শিক্ষাজীবন প্রবেশের প্রথম ধাপকে বলা হয় পবজ্জা (প্রব্রজ্যা) এবং ভর্তির পর প্রার্থী শিক্ষানবিশরূপে অভিহিত হয়। এরপর তাকে একজন গুরুর অধীনে ন্যস্ত করা হয়। শিক্ষানবিশকাল শেষ করার পর সে সম্প্রদায়ের একজন পূর্ণ সদস্য অর্থাৎ ভিক্ষু হয়ে যায়। শিক্ষানবিশকে শিক্ষাদান থেকেই বৌদ্ধ শিক্ষাপদ্ধতির উৎপত্তি। বৌদ্ধ পদ্ধতিতে শিষ্য সকল দৈহিক কাজ এবং গুরুকে প্রয়োজনীয় সকল সেবা প্রদান করে। বিনিময়ে গুরু শিষ্যকে শিক্ষা ও দীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্য সকল মাধ্যমিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা ও নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। একজন ভিক্ষুর অধীনে সাধারণত দুইজন শিক্ষানবিশ থাকে। যুব ভিক্ষুরা বিহারে দলগতভাবে বসবাস করে। এ ধরনের আবাসিক বিহার ভারতের এবং তৎকালীন বাংলায় বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠে।
বিহারগুলি ছিল উচ্চ শিক্ষার পীঠস্থান। কিন্তু সেগুলিতেও এক ধরনের প্রাথমিক শিক্ষাপদ্ধতি চালু ছিল। সে সময়ে কোন মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। বস্ত্ততপক্ষে, প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠক্রমই ছাত্রদের পরবর্তীকালে বিহারে উচ্চ শিক্ষার জন্য তৈরি করে দিত। সুতরাং ধারণা করা যায় যে, প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় পর্যায়ের শিক্ষার ভূমিকা পালন করত। হিউয়েন-সাং ভারতে ৬২৯ থেকে ৬৪৫ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। তিনি দেখতে পান যে, ৮ বছর বয়সে প্রাথমিক পাঠ শুরু হয় এবং তা ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ পর্যায়ে ব্যাকরণ, চারুকলা ও হস্তশিল্প, আয়ুর্বেদীয় শাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র ও আত্মাবিজ্ঞান পড়ানো হতো। ই-ৎসিঙ (I Tsing) ভারতে অবস্থান করেছিলেন ৬৭৩ থেকে ৬৮৭ সাল পর্যন্ত। তিনি লক্ষ্য করেন যে, ছাত্ররা ৫টি প্রধান বিদ্যা অধ্যয়ন করে। এগুলি হচ্ছে ব্যাকরণ ও বানান বিদ্যা, চারুকলা, আয়ুর্বেদীয় শাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা এবং বিশ্বাত্ম বিজ্ঞান ও দর্শন। এ পর্যায়ের পর বিশেষ উচ্চ শিক্ষাকাল শুরু হতো। বৌদ্ধ মঠগুলিতে প্রাথমিকভাবে ছাত্রদের ধর্মশাস্ত্র শিক্ষাদানের জন্য প্রস্ত্তত করা হতো। কিন্তু ই-ৎসিঙ দেখতে পান যে কিছু কিছু মঠে বস্ত্তগত শাখা ছিল এবং সেখানে ছাত্রদের তাদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াদি পড়ানো হয়। বুদ্ধ গৃহকর্ম পরিত্যাগকারী মেয়েদের শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। ভিক্ষুদের সম্পূর্ণ শাসনাধীনে সন্ন্যাসীদের জীবন নিয়ন্ত্রণের নিয়ম প্রবর্তন করা হয়। ধীরে ধীরে সন্ন্যাসিনীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ম তৈরি করা হয়। কিন্তু ভিক্ষুরা সন্ন্যাসিনীদের মঠে প্রকৃতপক্ষে কী প্রশিক্ষণ দিতেন বা দেওয়া হতো এ বিষয়ে বিস্তারিত কোন দলিলাদি পাওয়া যায়নি। বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় অবদান হচ্ছে বিহারে ধর্মীয় শিক্ষাক্রমের পাশাপাশি বৈষয়িক শিক্ষা চালু এবং এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ মানুষ ও অবৌদ্ধদের ভর্তির সুযোগদান। এর ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে শিক্ষার চাহিদা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ে।
মুসলিম আমল ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার (১২০৪-১২০৬) পর থেকে বাংলা দিল্লি শাসকের একটি প্রদেশ এবং কখনও কখনও স্বাধীন রাজ্য হিসেবে শাসিত হয়েছে। সুবাহদার, স্বাধীন শাসক এবং নওয়াবরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মক্তব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হতো। পক্ষান্তরে, মাদ্রাসা ছিল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার পীঠস্থান। মুসলিম শাসনামলে বাংলায় মাদ্রাসার বিস্তার ঘটে। এগুলি রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত হতো। দানশীল অনেক ব্যক্তি নিজস্ব উদ্যোগে মাদ্রাসা স্থাপন করতেন। মুসলিম বাংলায় বহু বিদগ্ধজন, প্রশাসক এবং কর্মকর্তা মাদ্রাসা ডিগ্রিধারী ছিলেন। সোনারগাঁয়ে শরফ উদ্দিন আবু তাওয়ামা পরিচালিত মাদ্রাসায় বৈষয়িক ও ধর্মীয় বিষয়াদি পড়ানো হতো। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে, জাহাঙ্গীরনগরের মাদ্রাসাগুলি বিজ্ঞান, ঈশ্বরতত্ত্ব, দর্শন এবং গণিত শাস্ত্র শিক্ষার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত ছিল। সে সময়ে সমাজে শিক্ষকদের ছিল উচ্চ মর্যাদা। মাদ্রাসার পাঠক্রমে সাধারণত ধর্মীয় বিষয়সমূহ, যেমন কোরআন হাদিস, ঈশ্বরতত্ত্ব এবং অন্যান্য ইসলামিক বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকত। বৈষয়িক বিষয়, যেমন ইতিহাস, যুক্তিবিদ্যা, ভূগোল, বীজগণিত, জোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যা, রসায়ন শাস্ত্র ও অন্যান্য কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাগত বিষয়ের ওপর কোন কোন কেন্দ্রে বেশি জোর দেওয়া হতো। তৎকালে ফার্সিতে পাঠ দেওয়া হতো। তবে মুসলমান ছাত্রদের জন্য আরবি অবশ্য পাঠ্য ছিল। মুসলমান আমলে ইতিহাসপাঠ ছিল মাদ্রাসা শিক্ষার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এর ফলে এসব শিক্ষাকেন্দ্র উপমহাদেশে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ইতিহাসবিদ তৈরি করেছিল। সম্রাট আকবর হিন্দুদের মাদ্রাসায় পড়াশোনার নীতি গ্রহণ করেন।
মুসলমান শাসনামলে পর্দা প্রথার কারণে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু বাদশাহের হারেমে বাদশাহ, নওয়াব এবং রাজকর্মচারীদের স্ত্রী, কন্যা, ভগ্নি এবং অন্যান্য অভিজাত শ্রেণির মেয়েরা শিক্ষা গ্রহণ করতেন। এদের কেউ কেউ জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষ উৎকর্ষ অর্জন করেন। তবে, বেশির ভাগ মুসলমান মহিলা গৃহকর্ম বিষয়ে কিছু প্রশিক্ষণ ব্যতীত খুব সামান্যই পড়াশোনা করতেন। ব্রিটিশ আমলেও মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রথা অব্যাহত থাকে, তবে এর প্রকৃতি ও চরিত্র অনেকখানি বদলে যায়। উনিশ শতকের গোড়ায় এদেশে বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা ছিল। এসব মাদ্রাসায় ব্যাপকভিত্তিক বিষয়াদি পড়ানো হতো, যেমন ব্যাকরণ, বাগ্মিতা, যুক্তিবিদ্যা, আইন, ইসলামি মতবাদ, জোতির্বিদ্যা, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং সাহিত্য। শিক্ষকের প্রধান লক্ষ্য ছিল ছাত্রকে এসব বিষয়ে নিজের অর্জিত জ্ঞান দান করা।
মুসলিম শাসনের অবসানের সময় সম্পদশালী ও অভিজাত শ্রেণির নিকট থেকে আর্থিক সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং সরকারি ভাষা ফারসি থেকে ইংরেজিতে পরিবর্তন হওয়ায় মাদ্রাসা শিক্ষা একটি রক্ষণশীল চরিত্র ধারণ করে। কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা বাংলাদেশে এখনও অব্যাহত রয়েছে।
ব্রিটিশ আমল ইউরোপীয় ব্যবসায় কোম্পানিগুলি ভারতে ১৬০০ সাল থেকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। পর্যায়ক্রমে পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলন্দাজ ও ইংরেজরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রে বসতি স্থাপন শুরু করে। এদের মধ্যে ব্রিটেনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শেষ পর্যন্ত ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। উনিশ শতকের গোড়া পর্যন্ত তারা কোন সুনির্দিষ্ট শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেনি। ভারতীয় জনগণের শিক্ষার বিষয়টি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দায়িত্ব হিসেবে প্রথমবারের মতো ১৮১৩ সালের আইনে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং শিক্ষা কর্মসূচির জন্য ১০,০০০ পাউন্ড বরাদ্দ করা হয়। অবশ্য এর বেশির ভাগ অর্থই প্রাচ্য শিক্ষার জন্য ব্যয় হয়। বাংলার রামমোহন রায় এবং অন্যান্য প্রগতিশীল সংস্কারবাদী এর তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং এদেশের জন্য পশ্চিমা শিক্ষা চালুর দাবি তোলেন। কোম্পানি তাঁর দাবির প্রতি কোন কর্ণপাত করেনি। অবশ্য ঐ আইনের সনদ অনুযায়ী মিশনারিদের এদেশে কাজ করতে অনুমতি দেওয়া হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি বিদ্যালয় উদ্ভবের পেছনে এই সিদ্ধান্তের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।
এ সময়ের একটি বড় ঘটনা হচেছ ১৮৩৫ সালে ৭ মার্চ লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক কর্তৃক লর্ড মেকলের কার্যবিবরণীর অনুমোদন লাভ। এতে বলা হয়, পশ্চিমা শিক্ষা ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এভাবে, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদানের একটি সুনির্দিষ্ট নীতির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর ফলে বাংলায় একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইংরেজি মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ সরকারি উদ্যোগে এবং সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও ভাষা ও সাহিত্য বিচারে নবপ্রতিষ্ঠিত এসব বিদ্যালয়ের গুণগত মান ছিল অতি উন্নত, কিন্তু বিবিধ বাস্তব বিষয়ের মান ছিল নিম্ন। পাঠক্রম ছিল প্রধানত কেতাবি।
১৮৫৪ সালে উড্স-এর রিপোর্টে মাধ্যমিক শিক্ষা নতুন মাত্রা পায়। এতে প্রাদেশিক সরকারকে কয়েকটি শর্তপূরণ সাপেক্ষে মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে অনুদান সাহায্য দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। শর্তগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল অনুদানপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে বৈষয়িক বিষয়ে শিক্ষাদানের প্রসঙ্গ। এই নীতি শেষপর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম থেকে সরকারকে প্রত্যাহার করে নিতে সাহায্য করে এবং ভারতীয়দের ওপর সেই দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। তবে, অনুদান পদ্ধতি, সকল পর্যায়ে ছাত্রদের জন্য বৃত্তি প্রকল্প প্রভৃতি বাংলায় মাধ্যমিক শিক্ষাবিস্তারে যথেষ্ট সাহায্য করে।
১৮৮২ সালের ভারতীয় শিক্ষা কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্যাদি সমাধানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। সরকার এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সকল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেসরকারি সংস্থাকে হস্তান্তর এবং জেলা সদরে একটি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলায় মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। ১৯০১-১৯০২ সালে সারা ভারতে ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৩,০৯৭। এর প্রায় অর্ধেকই ছিল বাংলায়। জেলা পর্যায়ে বাংলায় অন্য যে কোন প্রদেশের তুলনায় বেশিসংখ্যক বিদ্যালয় ছিল। প্রতি ১০৪.৩ বর্গমাইলে অন্তত একটি ইংরেজি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল। বাংলায় অনুদানহীন বিদ্যালয়ের সংখ্যাও ছিল সবচেয়ে বেশি। স্বল্প বেতন ও সহজ ভর্তি পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে এসব বিদ্যালয় পশ্চিমা শিক্ষার চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়।
১৯০১ সালে সিমলা সম্মেলনের ওপর ভিত্তি করে লর্ড কার্জন নিবর্তনমূলক শিক্ষানীতি গ্রহণ করলে মাধ্যমিক শিক্ষা অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। এই শিক্ষানীতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা বিভাগকে বিদ্যালয়গুলির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণাধিকার দেওয়া হয়। অবশ্য কার্জনের সময়ে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গে শিক্ষা সম্প্রসারণের খানিকটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। পূর্ববঙ্গের সরকারি শিক্ষা বিভাগের প্রথম পরিচালক হেনরি শার্প একটি শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি প্রতিটি পর্যায়ে মুসলমান ছাত্রদের জন্য বৃত্তি প্রদানের মতো বিশেষ সহায়তা কর্মসূচি চালু করেন এবং সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে ৮ শতাংশ আসন মুসলমান ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত রাখার বিধান করেন। বেশিসংখ্যক ছাত্র আকর্ষণের জন্য প্রতিটি সরকারি বিদ্যালয়ে একটি করে মুসলিম ছাত্রাবাস স্থাপন করা হয়। এর ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রসংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ছাত্রসংখ্যা ১৯০৬-১৯০৭ শিক্ষাবর্ষে ৪,২৫,৮০০ থেকে ১৯১১-১৯১২ শিক্ষাবর্ষে ৫,৭৫,৭০০-তে উন্নীত হয়। গোটা ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত বাংলার পূর্ববঙ্গে শিক্ষাবিস্তার নীতি অব্যাহত থাকে।
১৯২১ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত পল্লী অঞ্চলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যাবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। এ সময়ে মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ব্যাপক প্রসার ঘটে। মাতৃভাষায় শিক্ষাদান পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও চাকরির অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়নে ভাটা পড়ে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে বৃত্তিমূলক পাঠ চালু, কারিগরি, বাণিজ্যিক ও কৃষিবিষয়ক উচ্চচ বিদ্যালয় স্থাপনের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালে বাংলা বিভক্ত হওয়ার সময় মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয়- এই দুই ধরনের বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা দেওয়া হতো। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গ্রেড প্রথম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত এবং উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হতো। এ সময়ে প্রায় ২০,০০০ মাধ্যমিক ও ২,০০০ উচ্চ বিদ্যালয় ছিল। এর অর্ধেকেরও বেশি পরিচালিত হতো জনগণের সহায়তা ও অনুদানের মাধ্যমে। ৪০% এরও কম উচ্চ বিদ্যালয় রাষ্ট্রের নিকট থেকে অনুদান পেতো। ৪০টি বিদ্যালয় সরাসরি রাষ্ট্রীয় সহায়তায় চলত। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ৫টি বিদ্যালয় ছিল। উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ২টি প্রশিক্ষণ কলেজ ছিল। এগুলির একটি ছিল কলকাতায়, অপরটি ঢাকায়।
১৮৪৯ সালে জে.ই.ডি বেথুন মাত্র ৬ জন ছাত্রী নিয়ে কলকাতায় প্রথম নিয়মিত ধর্মনিরপেক্ষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বেথুনের পরীক্ষা এতটাই সফল ছিল যে ভারতের অন্যান্য প্রদেশে তা একটি মডেল হিসেবে গৃহীত হয়। তবে বালিকাদের মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসার ছিল খুবই মন্থর। ঐ শতাব্দী শেষে বাংলায় মাত্র দুটি বালিকা ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় ছিল। এর একটি কলকাতায় বেথুন স্কুল, অপরটি ঢাকায় ইডেন স্কুল।
১৮৮২ সালের ভারতীয় শিক্ষা কমিশন নারী শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেয়। কমিশনের বেশ কয়েকটি সুপারিশ অনুসারে বাংলা সরকার বালিকা বিদ্যালয়গুলির জন্য অধিক হারে অনুদান দেওয়া শুরু করে। শিক্ষাক্রমে মেয়েদের জন্য উপযোগী বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সহশিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। জেলা ও মিউনিসিপ্যাল বোর্ডগুলি বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য একটি মোটা অংক বরাদ্দ করতে থাকে। নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ও বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনএর প্রচেষ্টায় মুসলিম নারীশিক্ষা একটি নতুন দিগন্তে প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে মহিলা প্রশিক্ষণ বিদ্যালয় স্থাপন, বেতন হ্রাস, পুরস্কার ও বৃত্তি প্রবর্তন বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
পাকিস্তান আমল পাকিস্তান সরকারের প্রথম কাজ ছিল পূর্ববাংলার হিন্দু শিক্ষক, প্রশাসক ও কর্মচারীদের ব্যাপকহারে ভারতে গমনের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল তা পূরণ করা। দেশ বিভাগের ফলে পূর্ববাংলার বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলির ওপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এই শূন্যতা পূরণের জন্য পূর্ববাংলা সরকার পূর্ববাংলা শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৯৪৭ প্রণয়ন করে এবং এর ফলে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড পূর্ববাংলা মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার মাধ্যমিক শিক্ষা সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্য তেমন উল্লেখযোগ্য কোন নীতি গ্রহণ করেনি। অবশ্য সরকারি কিছু পদক্ষেপ প্রদেশের শিক্ষা উন্নয়নে প্রভাব ফেলে। ১৯৪৭ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং যেসব অঞ্চলে উর্দু শিক্ষা প্রদানের মাধ্যম ছিল না, সেখানে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে উর্দুকে অবশ্য পাঠ্য হিসেবে চালু করার প্রস্তাব করা হয়। এই প্রস্তাব পূর্ববাংলায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে একটি গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। অবশেষে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা পাকিস্তানের দুটি রাষ্ট্রভাষার মধ্যে একটি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর ফলে পূর্ববাংলায় মাধ্যমিক পর্যায়ে উর্দু শিক্ষার বিষয়টি শিথিল হয়ে যায়।
মাধ্যমিক শিক্ষাকে একটি আলাদা শিক্ষা ও প্রশাসনিক একক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং এর ব্যপ্তিকাল ৩টি উপ-পর্যায়ের মাধ্যমে ৫ থেকে ৭ বছরে বিস্তৃত করা হয়। এগুলি হচ্ছে নিম্ন-মাধ্যমিক পর্যায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী, মাধ্যমিক পর্যায় নবম-দশম শ্রেণি এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি। জুনিয়র স্কুল বা নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে একটি সুষম পাঠক্রম অনুসরণ করা হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয় চালু করা হয়। আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ছাত্ররা মানবিক, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টস, গার্হস্থ্য অর্থনীতি এবং কৃষি থেকে যে কোনো একটি কোর্স বেছে নিতে পারতো। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হয়। এ পর্যায়ের শিক্ষাক্রমে মাতৃভাষা ও ইংরেজিকে সকলের জন্য আবশ্যিক করা হয়। ছাত্ররা মানবিক, বাণিজ্য, চিত্রকলা, ইসলামিক শিক্ষা, কৃষি বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কোর্স নির্বাচন করতে পারত। মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসন পরিচালিত হতো প্রাদেশিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে। এর প্রধান ছিলেন পরিচালক জনশিক্ষা (ডিপিআই)।
এর আগে মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের শিক্ষা কার্যক্রম একটি শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হতো। নতুন নীতির আওতায় এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষা পরিচালনার জন্য ৪টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যবিষয় প্রস্ত্তত ও সুপারিশের দায়িত্ব পড়ে বোর্ডগুলির ওপর। প্রাদেশিক শিক্ষা বিভাগ মধ্য পর্যায়ের শিক্ষাক্রম প্রস্ত্তত করে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি মাধ্যমিক শিক্ষার অর্থ যোগানের দায়িত্ব পালন করে। মাত্র কিছুসংখ্যক বিদ্যালয় সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। পাকিস্তান শিক্ষা কমিশন এবং দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৬০-৬৫) সরকারি সম্পদের চেয়ে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে বেসরকারি বিদ্যালয় পরিচালনার খরচ অনেক বেড়ে যায়। বিদ্যালয়গুলি শিক্ষকদের সামান্য বেতন দিত। এত কম বেতনে উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদের এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আকর্ষণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর ফলে মাধ্যমিক শিক্ষার মান নিম্নগামী হয়।
পাকিস্তান আমলে মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়গুলি যথেষ্ট প্রসার লাভ করে। ১৯৪৭ সালে যেখানে ২০০ বালিকা বিদ্যালয় ছিল, সেখানে ১৯৭০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৭০০-তে উন্নীত হয়। এছাড়া, মেয়েদেরকে বিশেষ করে, গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের সহশিক্ষা বিদ্যালয়ে যেতে দেখা যায়। ১৯৭২-৭৩ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রীর সংখ্যা ২,৭০,০০০ অর্থাৎ মোট ছাত্রসংখ্যার ১৬% দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ আমল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নতুন সরকার দেশকে একটি নতুন শিক্ষানীতি উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ড. কুদরাত-ই-খুদাকে চেয়ারম্যান করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। কমিশন জাতীয় শিক্ষার সকল দিক বিবেচনা করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যাপারে কমিশন একটি দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ পেশ করে। কিন্তু, কমিশনের প্রতিবেদন অনুমোদনের পূর্বেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশের রাষ্ট্রপতি হত্যার মাধ্যমে এদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়ে যায়। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে জাতীয় শিক্ষা ও পাঠক্রম কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি কর্তৃক প্রস্ত্ততকৃত শিক্ষাক্রম ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হয়। এটি ১৯৯৬ সালে নতুন পাঠক্রম চালুর পূর্বপর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখে। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়। এগুলি হচ্ছে ১৯৭৮ সালের উপদেষ্টা পরিষদ, ১৯৮৩ সালের নতুন শিক্ষা নীতি, ১৯৮৭ সালের বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৩ সালের জাতীয় পাঠক্রম সমন্বয় কমিটি, ১৯৯৭ সালের শিক্ষা কমিশন, ২০০১ সালের শিক্ষা কমিশন এবং ২০০৯ সালের শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটি। দেশে বর্তমানে প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যসূচি ১৯৯৬ শিক্ষাবছর থেকে চালু হয়েছিল।
বর্তমান মাধ্যমিক শিক্ষায় তিনটি উপ-পর্যায় আছে। নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক। এটিকে ৩+২+২ পরিকল্পনা বলা যেতে পারে। জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ে নিম্ন মাধ্যমিক ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হয়। তবে ২০১০ সালের সর্বশেষ শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া পঞ্চম শ্রেণির পাঠদানশেষে সারা দেশে একযোগে প্রাথমিকশিক্ষা সমাপনী এবং অষ্টম শ্রেণির পাঠদানশেষে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা জেএসসি নামে একটি পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং ২০১০ সাল থেকে জেএসসি পরীক্ষা চালু হয়েছে। ২০১৮ সালের মধ্যে এ শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে, তা পুরোপুরি অর্জিত হলে মাধ্যমিক পর্যায়ে দুটি ধাপ থাকবে।
বর্তমানে অনেক উচ্চ বিদ্যালয় ও কয়েকটি ইন্টারমিডিয়েট কলেজেও নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা চালু আছে। বেশির ভাগ জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রাথমিক শ্রেণিসমূহ সংযুক্ত আছে। বেশ কয়েক প্রকারের বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা দেওয়া হয়। এগুলির কোন কোনটি প্রথম শ্রেণি থেকে দশম বা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা দেয়। কোনটিতে ৩য় থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত, আবার কোনটিতে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত চালু আছে। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা (একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি) দেওয়া হয় কিছু কিছু উচ্চ বিদ্যালয়ে, ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও ডিগ্রি কলেজে। নতুন শিক্ষানীতি অনুসারে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে পর্যায়ক্রমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করা হলে নিম্ন মাধ্যমিক বা জুনিয়র স্কুল আর থাকবে না। এছাড়া বর্তমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতেও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় অর্থাৎ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের ব্যবস্থা করা হবে।
১৯৭৫ সালের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠক্রম কমিটির উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথম শিক্ষাক্রম প্রণয়ণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে এ পাঠক্রম চালু করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৩ সালের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও সমন্বয় কমিটির সুপারিশমালার ওপর ভিত্তি করে বর্তমান মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলি প্রণয়ন করা হয়। এর বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৯৬ সাল থেকে। বর্তমান পাঠক্রমের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে পারদর্শী করা, আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈজ্ঞানিক মনোভাব গড়ে তোলা, স্বনির্ভর হওয়ার জন্য দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা এবং তাদেরকে দেশপ্রেম, ধর্মীয়, চারিত্রিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে উজ্জীবিত ও সচেতন করা। তবে নতুন শিক্ষানীতিতে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলী পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছে। এ নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে।
বর্তমান মাধ্যমিক শিক্ষার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমতা, যথাযথ মান ও সচলতা বজায় রাখার জন্য সাধারণ মাধ্যমিক শিক্ষা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকে (দাখিল, আলিম পর্যায়) একটি একক পদ্ধতির আওতায় আনয়ন। পাকিস্তান আমলের চারটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডকে পুনর্বিন্যস্ত করে বর্তমানে সারা দেশে সাতটি শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের আওতায় ইসলামী শিক্ষা এবং কারিগরী শিক্ষা বোর্ডের আওতায় বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত হয়। এছাড়া নানা কারণে যাদের পক্ষে নিয়মিত স্কুল-কলেজে শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হয় না সেই সব ঝরে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় অভিন্ন পাঠক্রমের এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
শিক্ষার সাধারণ উপ-পদ্ধতিতে নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা পাঠক্রমে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ধর্মীয় শিক্ষা, সামাজিক বিজ্ঞান, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, হস্তশিল্প, শরীরচর্চা এবং স্বাস্থ্য আবশ্যিক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। ছাত্ররা আরবি, উচ্চতর বাংলা ও উচ্চতর ইংরেজি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে নিতে পারে। মাধ্যমিক পর্যায়ে সাধারণ স্কুলের পাঠক্রমে পাঁচটি আবশ্যিক বিষয় আছে। এগুলি হচ্ছে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ধর্মীয় শিক্ষা এবং সামাজিক বিজ্ঞান অথবা সাধারণ বিজ্ঞান। এর সঙ্গে ছাত্ররা তিনটি ভিন্ন শাখা বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য শিক্ষার আওতায় আরো তিনটি ঐচ্ছিক বিষয় এবং একটি অতিরিক্ত বিষয় বেছে নিতে পারে। বর্তমানে এস.এস.সি পরীক্ষায় পূর্ণমান ১১০০।
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠক্রম সাতটি শাখায় বিভক্ত। এগুলি হলো: মানবিক, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, ইসলামি শিক্ষা, গার্হস্থ অর্থনীতি, কারিগরি শিক্ষা এবং চারুকলা ও সংগীত। এ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ও ইংরেজি বিষয়দুটি বাধ্যতামূলক, এছাড়া শাখাভেদে আরো তিনটি করে ঐচ্ছিক এবং একটি করে অতিরিক্ত বিষয় পড়ার সুযোগ রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের এইচ.এস.সি পরীক্ষার পূর্ণমান ১২০০।
তবে একক পদ্ধতির আওতায় আনা হলেও সাধারণ স্কুল-কলেজ এবং মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পাঠক্রম অভিন্ন নয়। এছাড়াও দেশে বেশ কিছু ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মূলত ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জিসিই (জেনারেল সার্টিফিকেট অফ এডুকেশন) পাঠক্রম অনুসারে মাধ্যমিকের সমতূল্য ও-লেভেল এবং উচ্চ মাধ্যমিকের সমতূল্য এ-লেভেল পর্যায়ের শিক্ষা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম মূলত বাংলা হলেও বর্তমানে এ রকম বেশ কিছু ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলকে জাতীয় পাঠক্রমের আওতায় ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলি নিজস্ব নিয়মকানুনের দ্বারা পরিচালিত হয়। জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে। ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের জন্য এসব বিদ্যালয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের নিয়মকানুন মেনে চলে। বেসরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজগুলিও স্ব স্ব বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মকানুন দ্বারা পরিচালিত হয়।
মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরীক্ষা পদ্ধতি এবং এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষা প্রশাসন ও পরিচালনা স্বাধীনতাপূর্ব দিনগুলির মতোই প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। এই দুই পর্যায়ের পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান করা হয়ে থাকে। পূর্বে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠদানশেষে পৃথকভাবে প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হতো, তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং জেএসসি পরীক্ষা চালুর পর থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার মতো এ দুই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতেই বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হয়। দেশের ১১টি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট বা বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের একটি পেশাগত প্রশিক্ষণ থাকতে হয়। ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণিতে পড়ানোর জন্য স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আবশ্যক।
শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকার নারী শিক্ষাকে উৎসাহ দিয়ে আসছে। সকল পর্যায়ে মেয়েদের অংশগ্রহণের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা প্রকল্প গ্রহণ ও ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করায় ১৯৯৪ সালের পর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে মেয়েদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য অধিক হারে মহিলা শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১২,০০০ মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয় ছিল। ২০০৯ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে এ সংখ্যা ১৯,০৮৩। এর মধ্যে ৩৪৯৪টি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১৫,৫৮৯টি উচ্চ বিদ্যালয়। এছাড়া ১২৭৫টি উচ্চ মাধ্যমিক মহাবিদ্যালয়, ৬৫৭টি স্কুল ও কলেজসহ সরকারি ও বেসরকারি বেশিরভাগ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদানের ব্যবস্থা রয়েছে। নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলির সবকটি বেসরকারি। সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্র ৩১৭টি, স্কুল ও কলেজের সংখ্যা চারটি আর উচ্চ মাধ্যমিক মহাবিদ্যালয়ের সংখ্যা ২১টি। এছাড়াও রয়েছে ৬,৭৭১টি দাখিল ও ১৪৮৭টি আলিম মাদরাসা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে শতকরা ৭৭ ভাগই সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এছাড়া ১৮.৮৬ শতাংশ বিদ্যালয়ে কেবল মেয়েদের জন্য এবং ২.৩১ শতাংশ বিদ্যালয়ে কেবল ছেলেদের পাঠদানের ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ ৮৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। দুই দশক আগে এই সংখ্যা ৫০% শতাংশের নিচে ছিল। সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি প্রবর্তনের ফলে এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। ২০০৮ সালে ৬৮ লাখ ১৯ হাজার ৭৪৮ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তি হয়। এর মধ্যে ৫৩.৬৯ শতাংশই মেয়ে। এ সময়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ৪৯৬ জন; এর মধ্যে ২২.৩৩ শতাংশ ছিলেন মহিলা। এ সময়ে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ছিল ১:৩৩, বিদ্যালয়-শিক্ষক ১:১১ এবং বিদ্যালয় শিক্ষার্থী অনুপাত ১: ৩৬৪। এছাড়া ২০০৮ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি প্রোগ্রামে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, যার মধ্যে ৪৪ হাজার অর্থাৎ
পাকিস্তান আমলে যুগোপযোগী শিক্ষানীতি ও আর্থিক বরাদ্দের অভাবে মধ্যম পর্যায়ের দক্ষ জনশক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে খুব বেশি অবদান লক্ষ্য করা যায়নি। বাংলাদেশ সরকার তার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মাধ্যমিক শিক্ষাকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সঙ্গে সংযুক্ত করার ওপর জোর দেয়। তবে মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সাফল্য নিশ্চিত হয় চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৯০-১৯৯৫)। এ পরিকল্পনার বিভিন্ন ক্ষেত্র হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রম নবায়ন ও আধুনিকায়ন এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন (এসইডিপি) প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষক প্রশিক্ষণ। এ প্রকল্পের আওতায় আরেকটি বড় সাফল্য হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি। অধিকসংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক তৈরির উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ কলেজগুলিতে দ্বিতীয় শিফ্ট চালু হয়েছে। বি এডুকেশন ও এম এডুকেশন শিক্ষাক্রম আধুনিকায়ন করা হয়। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন মনিটর করা ও সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য এবং মানসম্মত শিক্ষক নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও তথ্য পদ্ধতি (ইএমআইএস) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
এছাড়া ২০১০ সালে অনুমোদিত নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত এক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ পরিকল্পনার আওতায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে পর্যায়ক্রমে অষ্টমশ্রেণি পর্যন্ত এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠদানের ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। [শরীফা খাতুন]