বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উন্নত বৈশিষ্ট্যের ধানের জাত ও বিভিন্ন বাস্ত্ততন্ত্রে তাদের ব্যবস্থাপনা-প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গবেষণা পরিচালনার জন্য ১৯৭০ সালে গাজীপুরের জয়দেবপুরে প্রতিষ্ঠিত একটি স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের প্রধান মহাপরিচালক।
জয়দেবপুরে সদর দপ্তর ও কেন্দ্রীয় স্টেশন ছাড়াও ইনস্টিটিউটকে সহায়তা করে ১০টি আঞ্চলিক স্টেশন যেগুলি বরিশাল, ভাঙ্গা, খুলনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, রংপুর, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, সোনাগাজী ও রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত। বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা পরিচালনার জন্য ১৮টি গবেষণা বিভাগ রয়েছে: উদ্ভিদ প্রজনন, কৌলিতাত্ত্বিক সম্পদ ও বীজ, জৈবপ্রযুক্তি, শস্যের মান ও পুষ্টি, কৃষিতত্ত্ব, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা, উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব, কীটতত্ত্ব, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, ধান চাষ ব্যবস্থা (Rice Farming Systems), কৃষি পরিসংখ্যান, কৃষি অর্থনীতি, খামার ব্যবস্থাপনা, খামার যন্ত্রপাতি ও শস্য উত্তোলনোত্তর প্রযুক্তি, ওয়ার্কশপ যন্ত্রপাতি ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং ফলিত গবেষণা ও প্রশিক্ষণ (Adaptive Research and Training)। গবেষণা কার্যক্রম চালানো হয় সাতটি কর্মসূচির ভিত্তিতে। সেগুলি হলো জাত উন্নয়ন, ফসল-মাটি-পানি ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা, ধানভিত্তিক চাষাবাদ ব্যবস্থা, খামার যান্ত্রিকীকরণ, সামাজিক অর্থনীতি ও নীতি, এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর। ইনস্টিটিউটের সার্বিক ব্যবস্থাপনা মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে ১৩ সদস্যের ব্যবস্থাপনা বোর্ডের ওপর ন্যস্ত। মহাপরিচালককে সহায়তার জন্য রয়েছে দুজন পরিচালক, এর একজন গবেষণা কর্মকান্ড এবং অন্যজন প্রশাসন ও অর্থায়নের জন্য।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বড় ধরনের সাফল্য দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশে চাষের উপযোগী ৩৭টি উচ্চফলনশীল আধুনিক জাতের ধান উদ্ভাবন। সেগুলির মধ্যে ১৩টি বোরো ও আউশ উভয় মৌসুমের, ৭টি বোরো মৌসুমের, ৫টি আউশ মৌসুমের এবং ১২টি রোপা আমন মৌসুমের উপযোগী। যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও অনুকূল মৃত্তিকা পরিবেশগত অবস্থায় এসব আধুনিক ধানের জাত বোরো মৌসুমে ৫-৬ মে টন/হে, আউশ মৌসুমে ৩-৪ মে টন/হে এবং রোপা আমন মৌসুমে ৪-৫ মে টন/হে ফলন দিতে পারে।
গবেষণার প্রথমদিকের বছরগুলিতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কিছুটা খর্বাকৃতির আলোক নিরপেক্ষ জাত উদ্ভাবনে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে অনুসরণ করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা অধিক ফলনের জন্য আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ধারণা থেকে সরে আসে এবং স্থানীয় কৃষি বাস্তুসংস্থানিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য IR8 প্লান্ট-টাইপকে পুনর্গঠন করে। স্থানীয় কৃষি বাসুতসংস্থানিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে এবং কৃষকদের আর্থ-সামাজিক চাহিদা পূরণ করতে অপেক্ষাকৃত ছোট বৃদ্ধিচক্র ও মৃদু আলোকদিবস সংবেদনশীলতা সম্পন্ন ধান গাছ উদ্ভাবন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত আধুনিক ধানের জাতসমূহ বর্তমানে বাংলাদেশের বোরোর (শীতকালীন ধান) প্রায় ৯০%, আউশের (গ্রীষ্মকালীন ধান) ২৫-৩০% এবং রোপা আমন ধানের (বর্ষাকালীন ধান) ৫০-৫৫% এলাকায় আবাদ করা হয়। এসব জাত সম্মিলিতভাবে দেশের মোট ধানের জমির প্রায় ৫৬%-এ আবাদ হয় এবং উৎপন্ন করে দেশের মোট বার্ষিক ধান উৎপাদনের প্রায় ৭৪%। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট আধুনিক ধানের জাত ও আধুনিক ধান উৎপাদন প্রযুক্তিসমূহের বাংলাদেশে চালের উৎপাদন ১৯৭২-৭৩ সালে ৯৯ লক্ষ ৩০ হাজার মে টন থেকে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ মে টনে বৃদ্ধিকরণে মূল ভূমিকা রেখেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত বেশ কিছু আধুনিক জাতের ধান অন্যান্য দেশে যেমন ভারত, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, ভিয়েতনাম ও পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়।
এ ইনস্টিটিউটের রসায়নবিদগণ নিয়মিতভাবে চালের স্বাদ, রান্নাগুণ, ধান ভানার পর প্রাপ্ত চালের অনুপাত (milling outturn), ঘ্রাণ, আমিষ ও অ্যামাইলেজের পরিমাণ ইত্যাদি মূল্যায়ন করে প্রত্যাশিত গুণাগুণসম্পন্ন জাত উদ্ভাবনে উদ্ভিদ-প্রজননবিদদের সহায়তা করেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ-প্রজননবিদগণ প্রায় ৫,০০০ স্থানীয় জার্মপ্লাজমসহ প্রায় ৭,৫০০ জার্মপ্লাজম সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছে। সম্প্রতি হাইব্রিড ধান উদ্ভাবন ও উৎপাদনকৌশলের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জয়দেবপুর সদরদপ্তর ও ৯টি আঞ্চলিক স্টেশনে বর্তমানে ১৩৪ জন বিজ্ঞানী ও ৩৪৪ জন সহায়ক স্টাফ কর্মরত। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে ইনস্টিটিউটের গবেষণা সহযোগিতা কার্যক্রম চালু রয়েছে। [এম আবদুল হামিদ মিয়া]
আরও দেখুন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন; ধান।