ইব্রাহিম, নীলিমা
ইব্রাহিম, নীলিমা (১৯২১-২০০২) শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী। ১৯২১ সালের ১১ অক্টোবর বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামের এক জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রফুল্লকুমার রায়চৌধুরী এবং মাতা কুসুমকুমারী দেবী।
নীলিমা ইব্রাহিম বরাবরই একজন মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তিনি খুলনা করোনেশন বালিকা বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা (১৯৩৫), কলকাতা ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন থেকে আইএ (১৯৩৭) এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএবিটি (১৯৩৯) পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা বিষয়ে এম.এ (১৯৪৩) পাস করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম ‘বিহারীলাল মিত্র গবেষণা’ বৃত্তি লাভ করেন। একই বছর তিনি ইন্ডিয়ান আর্মি মেডিকেল কোরের ক্যাপ্টেন ডাক্তার মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ঢাকায় স্থায়িভাবে বসবাস করতে থাকেন। দীর্ঘকাল পরে ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটক’। একই বছর তিনি ঢাকার আলিয়াঁসে ফ্রাঁসেস থেকে ইন্টারমিডিয়েট ইন ফ্রেন্স-এ ডিপ্লোমা লাভ করেন।
কর্মজীবনের শুরুতে নীলিমা ইব্রাহিম কলকাতার লরেটো হাউজে লেকচারার (১৯৪৩-৪৪) হিসেবে চাকরি করেন। তারপর দুবছর (১৯৪৪-৪৫) তিনি ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনের লেকচারার ছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে যোগদান করেন এবং ১৯৭২ সালে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান (১৯৭১-৭৫), বাংলা একাডেমীর অবৈতনিক মহাপরিচালক (১৯৭৪-৭৫) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ (১৯৭১-৭৭)-এর দায়িত্বও পালন করেন।
নীলিমা ইব্রাহিম বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজকল্যাণ ও নারী-উন্নয়সংস্থা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনের সঙ্গে যু্ক্ত ছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলো এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতি ও বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির জীবন সদস্য ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী এবং কনসার্নড উইমেন ফর ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর বোর্ড অব গবর্নরসের চেয়ারপার্সন হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব উইমেন-এর সভানেত্রী এবং অ্যাসোসিয়েটেড কান্ট্রি উইমেন অব দি ওয়ার্লাল্ড-এর সাউথ ও সেন্ট্রাল এশিয়ার এরিয়া প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি বার্লিন, মিউনিক ও ফ্রাংফুর্টে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক বিশ্বসমবায় সম্মেলন’-এ পূর্বপাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৭৩-এ নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক ওয়ান এশীয় সম্মেলন’-এ অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৪-এ তিনি মস্কোয় অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বশান্তি কংগ্রেস’, হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বনারী বর্ষ’ এবং ১৯৭৫-এ মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বনারী সম্মেলন’-এ যোগ দেন।
নীলিমা ইব্রাহিম বেশকিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর গ্রন্থবদ্ধ রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: গবেষণা শরৎ-প্রতিভা (১৯৬০), বাংলার কবি মধুসূদন (১৯৬১), ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী সমাজ ও বাংলা নাটক (১৯৬৪), বাংলা নাটক : উৎস ও ধারা (১৯৭২), বেগম রোকেয়া (১৯৭৪), বাঙ্গালীমানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৮৭), সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ (১৯৯১); ছোটগল্প রমনা পার্কে (১৯৬৪); উপন্যাস বিশ শতকের মেয়ে (১৯৫৮), এক পথ দুই বাঁক (১৯৫৮), কেয়াবন সঞ্চারিণী (১৯৬২), বহ্নিবলয় (১৯৮৫); নাটক দুয়ে দুয়ে চার (১৯৬৪), যে অরণ্যে আলো নেই (১৯৭৪), রোদ জ্বলা বিকেল (১৯৭৪), সূর্যাস্তের পর (১৯৭৪); কথানাট্য আমি বীরাঙ্গনা বলছি (২ খন্ড ১৯৯৬-৯৭); অনুবাদ এলিনর রুজভেল্ট (১৯৫৫), কথাশিল্পী জেমস ফেনিমোর কুপার (১৯৬৮), বস্টনের পথে (১৯৬৯); ভ্রমণকাহিনী শাহী এলাকার পথে পথে (১৯৬৩); আত্মজীবনী বিন্দু-বিসর্গ (১৯৯১) ইত্যাদি।
নীলিমা ইব্রাহিম আমৃত্যু মানুষের শুভ ও কল্যাণী চেতনায় আস্থাশীল ছিলেন। মুক্তবুদ্ধি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও উদার মানবিকতাবোধই ছিল তাঁর জীবনদর্শন। তিনি সর্বংসহা ধরিত্রীকে স্বর্গের চেয়েও সুন্দর ও কাঙ্ক্ষিত মনে করতেন এবং অধিকতর অস্থাশীল ছিলেন দেবত্বের চেয়ে মানবত্বে।
নীলিমা ইব্রাহিম সমাজকর্ম ও সাহিত্যে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য বহু পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। সেগুলি হলো: বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার (১৯৮৭), লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৯), বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্মৃতিপদক (১৯৯০), অনন্য সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), বঙ্গবন্ধু পুরস্কার (১৯৯৭), শেরে-বাংলা পুরস্কার (১৯৯৭), থিয়েটার সম্মাননা পদক (১৯৯৮) ও একুশে পদক (২০০০)। ২০০২ সালের ১৮ জুন তাঁর মৃত্যু হয়।
[জীনাত ইমতিয়াজ আলী]